X
মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫
৩০ বৈশাখ ১৪৩২

রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং তৎপরবর্তী শিক্ষণ

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
০৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১৭:২৮আপডেট : ০৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১৭:২৮

গত বছরের (২০২২) ২৭ ডিসেম্বর হয়ে গেলো রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। এতে ৪ লাখ ২৬ হাজার ৪৬৯ জনের মধ্যে ২ লাখ ৮০ হাজার ৯৭২ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। তেমন কোনও অনিয়ম ও সংঘর্ষ ছাড়াই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে ইভিএমের মাধ্যমে। নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা ১ লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৮ ভোট পেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া ২২ হাজার ৩০৬ ভোট পেয়ে চতুর্থ হয়ে জামানত হারিয়েছেন।

অন্যদিকে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আমিরুজ্জামান জামান ৪৯ হাজার ৮৯২ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন। ৩৩ হাজার ৮৮৩ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী লতিফুর রহমান।

২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের নির্বাচনের ঠিক এক বছর আগে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে বলে রাখা ভালো, রংপুরকে মূলত জাতীয় পার্টির দুর্গ হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ, রংপুর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের  জন্মভূমি। তাছাড়া এই সিটি করপোরেশনে জাতীয় পার্টির মেয়র ক্ষমতাসীন ছিলেন। তারপরও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট আলোচনার অবকাশ রয়েছে। তবে, এই আলোচনায় যাবার আগে সার্বিকভাবে নির্বাচনের পরিস্থিতি নিয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ের অবতারণা করা প্রয়োজন।

রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ইভিএমে। অর্থাৎ যারা ইভিএমের বিরোধিতা করেছিলেন তাদের জন্য এটি একটি শিক্ষণ হওয়া উচিত। ইন্টারনেটের ধীরগতির কারণে কোথাও কোথাও কিছু সমস্যা তৈরি হলেও ভোট খুবই শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। বিকাল চারটার মধ্যে যারা কেন্দ্রে পৌঁছাতে পেরেছিলেন তারা ভোট দিতে পেরেছেন। কোথাও কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। বলা যায় নির্বাচন কমিশন সফলভাবে নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষম হয়েছে। এ জন্য তাদের বাহবা দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে ইভিএমে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব, তা-ও প্রমাণিত হলো।

ভোটারের আঙুলের ছাপ এবং ভোটার আইডি কার্ড একসঙ্গে দেওয়ার পরেই ইভিএমে ভোট দেওয়া সম্ভব। ইভিএমকে যারা বিতর্কিত করতে চায় তারা এবার নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করবে বলে আশা করি। পাশাপাশি ইন্টারনেটের ধীরগতি কিংবা সার্ভার সমস্যায় যদি কোনও সমস্যা তৈরি হয়, এই নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে আগামীতে ইসি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আমার বিশ্বাস।

রংপুর জাতীয় পার্টির দুর্গ হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু এর আগে রংপুর সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু মেয়র নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি খুবই জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। এখন রংপুরের রাজনীতিতে এ ধরনের ফলাফল আওয়ামী লীগের জন্য খুব সুখকর নয়। অনেকেই যুক্তি উপস্থাপন করেন, দলের একজন বিদ্রোহী প্রার্থীও নির্বাচন করে প্রায় ৩৩ হাজার ভোট পেয়েছেন। বিদ্রোহী প্রার্থী নৌকার প্রার্থীর চেয়ে প্রায় ১১ হাজার ভোট বেশি পেয়েছেন। ফলে, তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর চেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন বলা যায়।  তাহলে কি এই নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগে কি ভুল করেছিল? একটি নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে যেমন সার্বিকভাবে নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করা যায় না, ঠিক তেমনিভাবে যে ধরনের ফলাফল আওয়ামী লীগের প্রার্থী রংপুরে করেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিষয়ে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, জনগণের মধ্যে দলীয় প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা কম ছিল।

গত কয়েক বছরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই এলাকায় পরিচিত এবং ত্যাগী নেতারা মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হলেও সিটি করপোরেশন কিংবা পৌরসভার ক্ষেত্রে অতটা ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এই ক্ষোভগুলো আস্তে আস্তে দানা বাঁধছে যা আগামী দিনে নির্বাচনে ভয়ংকর আকার ধারণ করতে পারে। এমপি এবং স্থানীয় নেতাদের দৌরাত্ম্যের কারণে মনোনয়ন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা শোনা যায়। স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের প্রধান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হলেও তাঁর সামনে হয়তো মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সম্পর্কে তথ্যগুলো সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে না। যেভাবে তথ্যে উপস্থাপন করা হয় তার ওপর ভিত্তি করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে তা মনোনয়ন বোর্ড কিংবা দল কারোর জন্যই খুব সুখকর নয়।

আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি ছিলেন। পত্রপত্রিকা কিংবা মিডিয়া রিপোর্টে যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হলো, তিনি কখনোই আসলে জনগণের পাশে ছিলেন না এবং তেমন পরিচিত মুখ নন। তাছাড়া, নির্বাচনের আগে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির তেমন কোনও কার্যক্রম তার মাধ্যমে পরিচালিত হয়নি বিধায় দলের নেতাকর্মীরাও তার পক্ষে শক্তভাবে অবস্থান গ্রহণ করেননি। অনেক মিডিয়া রিপোর্টে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনার তেমন কোনও প্রস্তুতি ছিল না। অন্যদিকে, যে ৩-৪ জন নেতা দুই বছর ধরে মেয়র পদে গণসংযোগ করেছেন তারা মনোনয়ন না পাওয়ায় নির্বাচন থেকে দূরে থেকেছেন। এই নেতাদের ক্ষোভ প্রশমিত করে নির্বাচনের মাঠে নিয়ে আসতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সফল হননি। এই দায় রংপুর মহানগর কমিটির নেতারাও এড়াতে পারেন না।

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ২২৯টি কেন্দ্রের মধ্যে প্রায় ১৫০টি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট ছিল না। যেসব কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট ছিল তারাও অনেক আগেই ভোটকেন্দ্র ছেড়ে চলে গেছেন। এমনকি, অনেক জায়গায় প্রার্থীর পোস্টার পর্যন্ত দেখা যায়নি (বাংলা ট্রিবিউন, ২৮/১২/২০২২)। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও নেতাকর্মীদের একাংশ তার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, কেউ গোপনে, কেউ সরাসরি। একদিকে যেমন দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান করা নেতাকর্মীদের কাছে কাম্য নয়, ঠিক তেমনিভাবে স্থানীয় নির্বাচনে তাদের নিরুৎসাহিত করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, অনেক সময় দলের বিভিন্ন কার্যক্রমে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে নেতাকর্মীরা হয়তো বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নেয়। তবে এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে দল মনোনীত প্রার্থীকে আরেকটু বেশি পরিশ্রম করতে হয়। যারা মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন তাদের মধ্যে ক্ষোভ থাকে। দলীয় প্রার্থীর উচিত তাদের আস্থায়  নিয়ে একসঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনা করা। এই কাজটি করা সম্ভব হলে পরিস্থিতি ভিন্নতর হতে পারতো।

তবে যে কারণেই হোক না কেন, রংপুরে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। একদিকে প্রার্থী মনোনয়নে সমস্যা ছিল, অন্যদিকে সাংগঠনিকভাবে সবাইকে এক করে নির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনে স্থানীয় সরকার কিংবা জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলের নেতৃত্বকে আরও বেশি সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।

২৮ ডিসেম্বর, ২০২২ দেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হয়ে থাকবে। এই দিনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় মেট্রোরেল উদ্বোধন করেছেন। পদ্মা সেতু যেমন বাংলাদেশের আত্মসম্মানের প্রতীক, ঠিক তেমনিভাবে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের তালিকায় আর একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে মেট্রোরেল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রচেষ্টার ফলে গত ১৪ বছরে বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে, সেই ধারাবাহিকতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এবং ‘উন্নত বাংলাদেশ’ গড়তে হলে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে হবে।

নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে হলে প্রার্থী বাছাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ে আরেকটু সতর্কতার সঙ্গে কাজ করবেন। যোগ্যতা এবং জনসমর্থন বিচার করেই প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া উচিত। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একাংশ কিংবা এমপিদের স্থানীয় বলয়কে শক্তিশালী করার যে প্রচেষ্টা দলের অভ্যন্তরে অব্যাহত রয়েছে, সেই প্রচেষ্টা রুখে দিতে হবে। প্রার্থীর জনপ্রিয়তা এবং যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হলে ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ অবশ্যই সব নির্বাচনে বিজয়ী হবে এবং আগামী দিনে সরকার গঠন করবে।

লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বৃহৎ বিনিয়োগের আশায় ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর শুরু, পৌঁছালেন সৌদি আরব
বৃহৎ বিনিয়োগের আশায় ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর শুরু, পৌঁছালেন সৌদি আরব
চিকিৎসাসেবার পরিবেশ নিরাপদ রাখতে সরকার বদ্ধপরিকর: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
চিকিৎসাসেবার পরিবেশ নিরাপদ রাখতে সরকার বদ্ধপরিকর: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
কান উৎসবে নিষিদ্ধ হলো ‘নগ্নতা’
কান উৎসবে নিষিদ্ধ হলো ‘নগ্নতা’
বাংলা ট্রিবিউনের এক যুগে পদার্পণে বাংলাদেশ ন্যাপের শুভেচ্ছা
বাংলা ট্রিবিউনের এক যুগে পদার্পণে বাংলাদেশ ন্যাপের শুভেচ্ছা
সর্বশেষসর্বাধিক