X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তালিকা তো আছে, এবার তবে ধরা হোক

প্রভাষ আমিন
২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১৮:২১আপডেট : ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১৮:২১

আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যার একটি হলো ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ফেরত না দেওয়া। আর বাংলাদেশে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায়ও হলো ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে মেরে দেওয়া। শুনে নিশ্চয়ই বেশিরভাগ মানুষ ভয় পেয়েছেন। কারও কাছ থেকে নিয়ে টাকা মেরে দেওয়া তো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর সেটা যদি ব্যাংক থেকে হয়, তাহলে তো আরও বড় শাস্তি হওয়ার কথা। কিন্তু ঋণ নিয়ে মেরে দেওয়ার অপরাধে কারও শাস্তি হওয়ার কথা শুনেছেন কখনও। আর শাস্তি হয় না বলে ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়াকে কেউ আর অপরাধ মনে করে না।

ব্যাংকের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে ভালো পরিচয় থাকলেই হলো। এমনকি কাগুজে কোম্পানি বানিয়েও চাইলে আপনি ঋণ পেয়ে যাবেন। ধরুন একটা কাগুজে কোম্পানি বানিয়ে কোনও ব্যাংক থেকে আপনি ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিলেন। ব্যস, আপনার জীবন বদলে গেলো। আপনি বড়লোক হয়ে গেলেন। ব্যাংক থেকে পাওয়া ঋণ থেকে ব্যাংক কর্মকর্তাদের কিছু দিয়ে দেন। প্রথম কয়েক মাস নিয়মিত কিস্তিও দেন। আপনি ব্যাংকে বেশ ভালো গ্রাহক হিসেবেই পরিচিত হবেন। তারপর আস্তে আস্তে ঋণের কথা ভুলে যাবেন। খুব ঝামেলা হলে ব্যাংকই আপনাকে রিশিডিউল করে দেবেন। আবার কিছু টাকা দিলেন। এভাবেই চলতে থাকুক। এমনকি ব্যাংকের টাকা মেরে দিলেও আপনার নাম হয়তো ঋণখেলাপির তালিকায়ও উঠবে না। ব্যাংকাররা চাইলে নানান ফাঁকফোকরে আপনাকে ক্লিয়ার রাখতে পারবেন। আর ব্যাংক থেকে নেওয়া টাকায় আপনি দেশে-বিদেশে বাড়ি কিনুন, বিলাসবহুল গাড়ি কিনুন, সমাজসেবা করুন, দান-খয়রাত করুন। সমাজে আপনার খুব সুনাম হবে। টাকা কিন্তু ব্যাংকের।

আপনারা পড়ে হয়তো অবাক হচ্ছেন, বড়লোক হওয়া যদি এতই সহজ, তাহলে আর বসে আছি কেন। দৌড়ে ব্যাংকে চলে যান। বাংলাদেশে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া সবচেয়ে সহজ আবার সবচেয়ে কঠিনও বটে। গত ২৫ বছর ধরেই আমি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সংসারের নানা পণ্য কিনি। সংসার শুরু করার পর টেলিভিশন, ফ্রিজ, সোফা, ল্যান্ডফোন, মোবাইল ফোন, এসির মতো পণ্য আমি ব্যাংক লোনেই কিনেছি। ঋণ না পেলে এই পণ্যগুলো কিনতে আমার অনেক সময় লাগতো। প্রত্যেকবার ঋণ নিতে গেলেই ব্যাংক আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীর নাড়ি-নক্ষত্র খোঁজ নেয়।

সাধারণত আমি নিয়মিত কিস্তি শোধ করি। ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রেও আমি নিয়মিত বিল শোধ করি। একজন ব্যাংকার অব দ্য রেকর্ড বলেছেন, কাগজে-কলমে ভালো ক্লায়েন্ট হলেও বাস্তবে আপনি ব্যাংকের জন্য ভালো নন। আপনি দুয়েকটা কিস্তি মিস করবেন, ব্যাংক আপনাকে জরিমানা করবে; তাহলেই না ব্যাংকের লাভ। আমার মতো সাধারণ গ্রাহকদের ক্ষেত্রে ব্যাংকের নিয়ম হলো, পর পর তিন মাস কিস্তি না দিলে আমার নাম বাংলাদেশ ব্যাংকের কালো তালিকায় উঠে যাবে এবং কালো তালিকায় নাম থাকলে আমি আর কোনও ব্যাংক থেকে ঋণ পাবো না। আমি একবার একজনের গ্যারান্টার হয়েছিলাম। তার কিস্তি অনিয়মিত ছিল বলে আমার ঋণ অনুমোদন হয়নি। আর আপনি কিস্তি মিস করলে ব্যাংক থেকে ফোন করে আপনাকে তাগাদা দিতেই থাকবে। শুরুতে তাগাদার ভাষা ভদ্র হলেও আস্তে আস্তে তা বদলে যায়। এমনকি ব্যাংকের পক্ষ থেকে বাসায় বা অফিসে মাস্তান পাঠানোর ঘটনাও ঘটে।

এটুক পড়ে মনে হতে পারে, ব্যাংক ঋণ পাওয়া বুঝি অনেক কঠিন কাজ, ফেরত না দেওয়ারও কোনও সুযোগ নেই। আর ঋণ দেওয়াই ব্যাংকের অন্যতম ব্যবসা। আমানতের সুদের হারের চেয়ে ঋণের সুদের হার বেশি। এটাই ব্যাংকের লাভ। ব্যাংক আসলে এক গ্রাহকের কাছ থেকে কম সুদে টাকা নেন, আরেক গ্রাহককে বেশি সুদে ঋণ দেয়। নিয়মিত আদায় হলে ব্যাংকের ঋণ দিতে তো কোনও সমস্যা থাকার কথা নয়। তাহলে গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে যে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা; এটা কীভাবে সম্ভব? সংশ্লিষ্টরা বলেন, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ নাকি আরও অনেক বেশি। ব্যাংক ব্যবস্থাকে ভালো দেখাতে নানান কায়দা করে ব্যাংক অনেক ঋণের তথ্য আড়াল করে রাখে। অল্প কিছু টাকা নিয়ে রিশিডিউল করে দেয়। আমরা ধরে নিচ্ছি, ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকাই খেলাপি। কিন্তু এই টাকা কীভাবে খেলাপি হতে পারলো? ব্যাংক কী দেখে তাদের ঋণ দিলো? শোধ না করার পর ব্যাংক তাদের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিলো? শুনি ব্যাংক ঋণ পেতে হলে সম্পত্তি বন্ধক রাখতে হয়। ঋণ শোধ না করলে সেই সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যাংক তার টাকা পেয়ে যাওয়ার কথা। ব্যাংক তো সব দিক নিরাপদ রেখেই ঋণ দেওয়ার কথা। তাহলে ঋণখেলাপি হয় কীভাবে?

গত মঙ্গলবার সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শহীদুজ্জামান সরকারের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দেশের ২০ শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকা দিয়েছেন। এই শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে মোট ঋণের পরিমাণ ১৯ হাজার ২৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এরমধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৬ হাজার ৫৮৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। আর দেশে মোট ঋণখেলাপি গ্রাহকের সংখ্যা ৭ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫। সরকারের কাছে তো সব তথ্যই আছে। এবার এদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযানে নামলেই হয়। হয় ব্যাংকের টাকা ফেরত দাও, নইলে কারাগারে থাকো। ব্যাংকের টাকায় সবার চোখের সামনে বিলাসী জীবনযাপনের চেয়ে অশ্লীল আর কিছু নেই। সমস্যা হলো, আমাদের দেশে ঋণখেলাপি হওয়াটা কোনও লজ্জার বিষয় নয়। ঋণখেলাপিরা সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। দৈনিক ভোরের কাগজকে ধন্যবাদ, সংসদে তালিকা প্রকাশের পরদিন তারা অন্তত ৬ শীর্ষ ঋণখেলাপির ছবি ছেপেছে। আমরা যাতে অন্তত ঋণখেলাপিদের চিনে রাখতে পারি, ‘থুতু ’ দিতে পারি। শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সরকারি দলের নেতা যেমন আছে, বিরোধী দলের নেতাও আছে।

শীর্ষ ২০ জনের মধ্যে ১০ জনই চট্টগ্রামের। দৈনিক সমকাল চট্টগ্রামের ঋণখেলাপিদের নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রামের কোনও কোনও খেলাপি ব্যবসায়ী ঋণ নেওয়ার পর সেই প্রতিষ্ঠানের নাম পাল্টে ফেলেছেন। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ঝুলছে তালা। কেউ আবার ব্যাংককে না জানিয়ে অন্যের কাছে দিয়েছেন ভাড়া। ঋণের টাকা সরিয়ে নিয়েছেন অন্য খাতে; কিনেছেন জমি ও বাড়ি; করেছেন হাসপাতাল, পার্ক ও আবাসন প্রকল্প। কোথাও কোথাও ব্যাংক বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রি করতে গিয়ে পারেনি। কারণ, একই সম্পত্তি একাধিক ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছেন। তার মানে আসলে ঋণ নেওয়ার আগে-পরে ব্যাংকের পক্ষ থেকে যথাযথ মনিটরিং ছিল না। ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা প্রভাব বিবেচনা করেই ঋণ দিয়েছে। এখন তাই ফেরত পাচ্ছে না।

ঋণখেলাপি না হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ঋণ না দেওয়া। মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতোই সমাধান। ব্যাংক যদি ঋণ না দেয় ব্যাংকও বন্ধ হয়ে যাবে, ব্যবসা-বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যাংকের টাকায়ই ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবেন। কিন্তু লাভ করে ব্যাংকের টাকা ফেরত দিলেই সমস্যা মিটে যায়। এটা ঠিক, সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও চেষ্টা থাকার পরও অনেক সময় কারও ব্যবসায় ধস নামতে পারে, তিনি খেলাপি হতে পারেন। করোনার সময় এমন অনেক চালু ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে তখন সরকারও ব্যবসায়ীদের পাশে থেকেছে। ঋণ আদায়ে চাপ দেয়নি। ব্যাংকাররা জানেন, কোনও ব্যবসায়ী অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, কোনও ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃত। যারা চেষ্টা করেও ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে পারেনি, ব্যাংক প্রয়োজনে আরও ঋণ নিয়ে তার পাশে দাঁড়াতে পারে, ব্যবসা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতে পারে। আর যারা ব্যাংকের টাকা নিয়ে দেশে-বিদেশে বাড়ি কেনে, গাড়ি কেনে, আয়েশ করে; তাদের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থমন্ত্রীর কাছে তো তালিকা আছেই, সংসদে প্রকাশ করায় অন্তত ২০ জনের নাম এখন সবাই জানে। এই ২০ জনকে কালকেই ধরা হোক। আরও যে ৭ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫ জন্য খেলাপি আছেন, পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেওয়া হোক তাদের বিরুদ্ধেও। ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে তারা সমাজের উঁচুতলায় চলাফেরা করবেন, বেশি আটকে গেলে ২ শতাংশ/৫ শতাংশ দিয়ে রিশিডিউল করে নেবেন, আর নইলে পুরো বিষয়টা আদালতে নিয়ে কালক্ষেপণ করবেন; দিনের পর দিন এটা চলতে পারে না। ব্যাংক মানুষকে টাকা দেবে, মানুষ সেটা শোধ করবে। হিসাব বরাবর। এখানে যেন খেলাপি হওয়ার কোনও সুযোগই না থাকে। আর কেউ যেন ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়ার সুযোগ না পায়।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ