X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে চাই সামাজিক জাগরণ

রাজন ভট্টাচার্য
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৭:৫৯আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৭:৫৯

এবারের বই মেলার প্রথম শিশু প্রহরে অংশ নিয়ে শিশুদের হাতে মোবাইল ফোনের পরিবর্তে ‘বই’ তুলে দিতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এই আহ্বান কত মানুষের মনের কথা তা বলে বোঝানো যাবে না।

শুধু বাংলাদেশ বলে কথা নয় গোটা পৃথিবীর পরিবেশ পরিস্থিতি দিন দিন শিশুদের উপযোগিতা হারাচ্ছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিশুদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ অনুকূলে নয়। কোমলমতি শিশুরা স্বাভাবিক শৈশব থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে সমাজে তৈরি হচ্ছে নানামুখি সংকট। একজন শিক্ষাবিদ ও সচেতন মানুষ হিসেবে মুহম্মদ জাফর ইকবাল তা অনেক আগেই অনুভব করেছেন।

শুধু তিনি নন, তার মতো অনেকেই বিষয়টি টের পেলেও, হয়তো করার কিছু নেই। সাধারণ মানুষ যদি এ ব্যাপারে কথা বলেন, পরামর্শ দেন তাহলে ক’জন শুনবে? এটা তো সত্যি তিনি যে কথা বলেছেন; একথা অনেকের প্রাণের কথা, মনের মধ্যে দীর্ঘদিন পুষে রাখা, বলতে না পারা কথার একটি।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল যেদিন এ আহ্বান জানিয়েছেন সেদিন অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, খুলনায় অপহরণের পর গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র নীরব মন্ডলকে (১৩) হত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনার সংবাদ। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ একই স্কুলের পাঁচ ছাত্রকে আটক করেছে। ভারতীয় ক্রাইম পেট্রোল সিরিয়াল দেখে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে সহপাঠী শিশুরা এই অপহরণের পরিকল্পনা করে বলে জানিয়েছে পুলিশ!

ভাবা যায়! শিশুদের মনোজগৎ কতটা বদলে গেছে। কোমল হাত কীভাবে পরিণত হয়েছে ঘাতকের হাতে! প্রেমে বাধা দেওয়ায় সম্প্রতি এক স্কুলছাত্র প্রকাশ্যে স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে শিক্ষককে হত্যা করেছিল। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দেশে ঘটেছে। যার অনেকগুলোর সঙ্গে কোমলমতি শিশুরা জড়িত।

এটা জাতির জন্য কতটুকু বিপজ্জনক খবর, লজ্জা আর অপমানের তা বলে বোঝানো যাবে না। উন্নত দেশে এরকম ঘটনা ঘটলে রাষ্ট্র থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকরা মহাচিন্তিত হতো। রাজনৈতিক নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করতো। করণীয় ঠিক করতে জাতীয়ভাবে কাজ শুরু হয়ে যেত। আমরা তো আর সেই জায়গায় নেই। ক্ষমতার লড়াইয়ের বাইরে গিয়ে সমাজ তথা দেশের প্রয়োজনে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে এরকম ভাবনা কাজ করবে তা একেবারেই অস্বাভাবিক, প্রত্যাশার বাইরে।   

একটি জাতির আলোকিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন নতুন প্রজন্মের হাতে। তারাই মেধা, বুদ্ধি, গবেষণা, কর্ম আর অর্জনের মধ্য দিয়ে দেশকে বদলে দেওয়ার মূল কারিগর। তবে শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দেশপ্রেম একটি বড় বিষয়। নতুন প্রজন্মের মননে দেশপ্রেমের চেতনা সৃষ্টি করতে না পারার বড় প্রমাণ হলো অল্প বয়সে কিশোররা নিখোঁজ হয়ে জঙ্গিবাদে নাম লেখাচ্ছে। ধর্মীয় অপব্যাখ্যার কারণে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুণ-তরুণী, কিশোর কিশোরীরা কথিত হিজরতের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হওয়ার কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। 

তাদের অনেককে অন্ধকার জগত থেকে ফিরিয়ে এনে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। যদিও এখনও অনেকের অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এটা তো আরও বেশি উদ্বেগের খবর। কতজন শিশু এই অন্ধকার রাজ্যে পা বাড়িয়েছে কে জানে?

সম্প্রতি কথিত হিজরতের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়া ৫৫ তরুণের তালিকা দেয় র‌্যাব। বাহিনীটির কর্মকর্তারা বলেন, এসব তরুণদের দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এনে রাঙামাটি, বান্দরবানের পাহাড়ে নিয়ে রাখা হয়েছে। তারা সেখানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয়। জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন পদের সদস্যরা এখন নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। যাদের নতুন রিক্রুট করা হয় তাদের বয়স অনেকটাই কম, বিশেষত কিশোর-কিশোরী কিংবা তরুণ-তরুণী। তাদের দলে ভিড়িয়ে সশস্ত্র হামলার পরিকল্পনায় রয়েছে সংগঠনটি।

এই খবরটি আমাদের জন্য খুবই বিপদের, তেমনি বিরাট রকমের শঙ্কারও বটে। পরিবার ও সমাজ শিশুদের জন্য কতোটুকু উপযোগিতা হারালে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে? তা এই ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে। তেমনি আমরা কোনদিকে যাচ্ছি? সেকথারও স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে এসব অঘটনের মধ্যে।

শিশুরা কিশোর গ্যাংয়ে জড়াচ্ছে, কথিত বড় ভাইদের আশ্রয়ে অপ্রাপ্ত বয়সে রাজনীতি করছে। হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে নানা অপরাধে নির্দ্বিধায় নিজেদের যুক্ত করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। আর পরিচালনা করছে। পাড়ায়-পাড়ায় কিশোরেরা আধিপত্য বিস্তারে নানাভাগে বিভক্ত। নেশার আসক্তি বাড়ছে। শিক্ষকরা শাসন করলে ছাত্রদের দ্বারা হামলার শিকার হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকরা সন্তানকে খারাপ কাজে এখন বাধা দিতে ভয় পান। সন্তানের আতঙ্কে নেশার টাকা হাতে তুলে দিতে হচ্ছে। একজন অভিভাবক হিসেবে এটি কত কষ্টের যন্ত্রণার তা তিনিই বলতে পারবেন, যিনি নীরবে চোখের জল ফেলে এ কাজটি করে যাচ্ছেন।

সব মিলিয়ে দেশে শিশুদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ ও কর্মকাণ্ড সত্যিই স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই। যা একজন সচেতন নাগরিক হসিবে মেনে নেওয়া যায় না। তেমনি দায়িত্বশীল অভিভাবক হিসেবেও নয়। 

পরিস্থিতি আসলেই এমন জায়গায় গেছে, এখন প্রতিটি বাবা-মায়ের কাছে ছেলে বলে কথা নয়, সন্তানকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলাই বড় রকমের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া কোনও অভিভাবকেরই গর্ব করে বলার আর কোনও সুযোগ নেই– আমার সন্তান বিপথে যাবে না।  

প্রশ্ন হলো কেন এই পরিস্থিতি এলো। যা গোটা সমাজ থেকে শুরু করে দেশ ও জাতির জন্য অশনি সংকেত। একটি প্রজন্ম যদি বিপথে যায় তাহলে পেছনের সারিতে যারা আছে তারাও তা অনুসরণ করবে, এটাই স্বাভাবিক। সবচেয়ে বড় কথা হলো খারাপ কাজ সবচেয়ে বেশি টানে। ভালো কাজে সবাইকে সহজেই উদ্বুদ্ধ করা যায় না। তাই বর্তমান উঠতি প্রজন্মেই যে সমস্যা তা বলা যাবে না, সামনে দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। গ্রামে একটা প্রবাদ আছে ‘দেখ দেখ কর্ম-শিখ শিখ ধর্ম’।

এই অন্ধকারময় পরিস্থিতির জন্য কি শিশুরাই দায়ি? মোটেও নয়। আমরাই শিশুদের এই পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছি। তাই দায় এড়ানোর সুযোগ কারও নেই। গত দুই দশকে সমাজে একটি অসম বড় হওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ ক্ষমতার পাশাপাশি বড়লোক হওয়ার প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় গা ভাসিয়ে দিয়েছেন অভিভাবকরা। তারা ঘরে সময় কম দিচ্ছেন। এই সুযোগে ঘরে ঘরে প্রবেশ করেছে টেলিভিশন, মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে অবাধ ইন্টারনেট ও তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার। অর্থাৎ শিশুদের কাছে অভিভাবকদের জায়গা দখল করেছে আকাশ সংস্কৃতি। পাশাপাশি শিশুরা ছোটবেলা থেকেই পরিবার, গ্রাম থেকে শুরু করে সমাজে অপরাধের ভয়াবহ বিস্তার দেখছে। পরিবারে অপরাধের ঘটনা ও এর বাস্তবতা শিশুদের মনোজগতে বিরুপ প্রভাব বিস্তার করছে। সে আস্তে আস্তে খারাপ দিকটি অনুরণ করবে তাই স্বাভাবিক।

আরেকটি বিষয় হলো দেশপ্রেম থেকে সরে আসা। গ্রামে কিংবা শহরে এখন সংস্কৃতি চর্চা নেই বললেই চলে। শিশু কিশোর সংগঠনগুলো কার্যত মৃত। সাংস্কৃতিক সংগঠন করার মানুষ মিলে না। আবৃত্তি ও গান, আর্ট স্কুল সবই কালের সাক্ষী হতে চলেছে। কবি, জারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া গান সহ নিজ নিজ এলাকার উৎসবগুলো কোথাও আছে, কোথাও বিলুপ্ত। স্কুল পর্যায়ে যা আছে তা একেবারেই সীমিত, অনেক ক্ষেত্রে স্কুলের এই চর্চার জায়গায় শিশুদের মনোনিবেশ একেবারেই নেই। যা তাদের সুস্থ ধারায় বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। 

কেনই বা থাকবে, সমাজের সব ক্ষেত্রেই যদি সুস্থ ধারা নষ্ট হয় তাহলে এককভাবে স্কুল কর্তৃপক্ষ একটি শিশুকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব কোনোভাবেই নিতে পারবে না। জাতীয় দিবসগুলোতে শিশুরা এখন কতটুকু যুক্ত? আগে ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ১০ দিন আগে থেকেই খালি পায়ে প্রভাতফেরীর অপেক্ষায় থাকতাম। এখন সেই পরিস্থিতি কী আছে?

স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে শিশুদের সেই অংশগ্রহণ নেই। চর্চার অভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে প্রজন্ম। গ্রামীন মেলাগুলোও আগের মতো নেই। ঘুড়ি উৎসব, নৌকা বাইচ, ষাড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই, গ্রামীণ খেলাধূলা দিন দিন কমছে। ঐতিহ্য থেকে আমরা দূরে সরে গেছি। নানামুখি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। গ্রামের মুরুব্বিরা এখন ছেলে মেয়েদের অন্যায় দেখলে শাসনে এগিয়ে আসেন না। ভালো মানুষগুলো সামাজিক বাস্তবতার কারণে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। যা সমাজের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।

তাহলে কেন আশা করবো শিশুরা সুপথে বেড়ে উঠবে? আশাহতও হওয়া যাবে না। হাল ছেড়ে দেওয়া মানেই হেরে যাওয়া, বিপদকে আলিঙ্গন করা। নিশ্চিত বিপর্যয়ের দিকে যাওয়া। তা হলে একেবারেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। সময় বলছে আমাদের শিশুদের হাতে বই তুলে দিতে হবে। ভালোবাসা দিয়ে হাত থেকে কেড়ে নিতে হবে মোবাইল ফোন। অবাধ ইন্টারনেটের ব্যবহার কমানোর পাশাপাশি টেলিভিশনে শিশুতোষ অনুষ্ঠান দেখানো নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সন্তানের ওপর অভিভাবকদের নজরদারি বাড়ানোর বিকল্প নেই। প্রয়োজন রাজনৈতিক স্বদিচ্ছাও। সর্বোপরী দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে শিশুদের সুপথে এনে প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র সহ সবাইকে একযোগে ভূমিকা রাখা এখন সময়ের সবচয়ে জরুরি আহ্বান। সবাই মিলে খুব শক্ত হাতে ধরে এই কাজটি নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সামাজিক জাগরণ জরুরি।    

 

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক কালবেলা

[email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
দুই মাসে ব্র্যাক ব্যাংকে আড়াই হাজার কোটি টাকা নিট ডিপোজিট প্রবৃদ্ধি অর্জন 
দুই মাসে ব্র্যাক ব্যাংকে আড়াই হাজার কোটি টাকা নিট ডিপোজিট প্রবৃদ্ধি অর্জন 
গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুনানি হয়নি
গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুনানি হয়নি
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ