X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

ফেব্রুয়ারি এখন কাদের দখলে?

জোবাইদা নাসরীন
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৮:২১আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৮:২১

প্রতি বছরই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমরা অনেকেই শহীদ মিনারে যাই ভাষা শহীদদের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা জানাতে।  আমাদের এই শ্রদ্ধা শুরু হয় আজিমপুর গোরস্থান থেকে। সেখানে ঘুমিয়ে আছেন ভাষা শহীদদের দুজন। ভাষাশহীদ বরকত এবং শফিউরের কবরে ফুল দিয়ে তারপর আমরা যাই শহীদ মিনারে। এবার যাওয়ার পথে আমি ছাত্রীদের বলি– ‘চলো, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটা গাইতে গাইতে যাই। ছাত্রীদের মধ্যে উৎসাহ দেখলাম না। এমনকি আশপাশের কোনও র‍্যালি থেকেও এরকম কোনও উদ্যোগ চোখে পড়লো না। বরং কানে এলো স্লোগান, আর দেখা গেলো থেমে থেমে ছবি তোলার হিড়িক।

 প্রতিবারই এই পুরোটা রাস্তায় আমার ছোটবেলার প্রভাত ফেরির কথা ভীষণভাবে মনে হয়। এবার আরও মনে হয়েছে, এর কারণ পুরো রাস্তা এবং শহীদ মিনার কোথাও এই দেড়ঘণ্টা সময়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি শুনিনি। অথচ আগে শুধু এই গানটিই শোনা যেতো। সেই গানটির সঙ্গে গলা মিলিয়ে যারা শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসতেন, তারাও গাইতেন। কখনও মনে হয়নি যে একই গান কেন বারবার বাজছে? মনে হতো এই গানটিই তো আজকের প্রাণ। এছাড়া অনেক পাড়া-মহল্লাতেও একুশের কয়েক দিন আগে থেকেও এই গানটি গাওয়ার জন্য চর্চা করা হতো, যাতে সবার সুর মিলে। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। আমরা বড়দের সঙ্গে মাথা নেড়ে নেড়ে আবেগ দিয়ে এই গানটি গাইতাম। পুরো রাস্তায় অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করতো। খালি পায়ে সবাই সাদা জামা পরে ফুল নিয়ে যেতাম শহীদ মিনারে। সেই ফুল সংগ্রহের জন্য রাত জাগা হতো। পাড়ায় মহল্লায় বিভিন্ন বাড়ি থেকে ফুল চুরি করে জমা করতাম। সুঁই-সুতা দিয়ে গাঁথা হতো মালা। কখনও কখনও বাঁশের কঞ্চি কেটে সেগুলো লাগাতাম কিংবা হাতেই নিয়ে যেতাম শহীদ মিনারে।

কাগজের মধ্যে ভাঙাচোরা হাতের লেখায় লিখতাম– ‘আমি কী ভুলিতে পারি’? ফুলগাছ মালিকেরা সেদিন রাগ হতেন না। ফুল চুরির জন্য কিছু বলতেন না। হয়তো তারাও চাইতেন এমনই আবেগ বেঁচে থাকুক বাচ্চাদের মাঝে। শুধু শহরেই নয়, গ্রামেও বাচ্চারা ডালপালা কেটে, কিংবা কখনও লাকড়ি দিয়ে তাদের মতো করেই শহীদ মিনার বানাতো এবং ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি গেয়ে’ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতো।

এছাড়া একুশ উপলক্ষে পাড়া মহল্লায় যেসব গান হতো সবই থাকতো একুশ অথবা বাংলা ভাষাকে ঘিরে। মনে পড়ে সেসব অনুষ্ঠানে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারির’ পাশাপাশি ‘সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণে’, ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা, আমি জনম জন্ম রাখবো ধরে ভাই হারানোর জ্বালা’- এ ধরনের গানই গাওয়া হতো।

শোক, শ্রদ্ধা আর সর্বোচ্চ ভালোবাসা জানানোর প্রভাত ফেরি আমাদের জীবন থেকে বাদ হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন আর কেউ খালি পায়ে হেঁটে শহীদ মিনারে যায় না। শহীদ মিনার এখন শাড়িতে, জামায় শোভা পায়। বর্ণমালাও এখন সেই কাপড় পাড়ের ডিজাইনের উপকরণ। আর সেই এখন কালো বাহারি শাড়ি আর পাঞ্জাবি বেচাকেনার হিড়িক পড়ে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহজুড়েই। দেখে মনে হয় সেই শাড়ি পাঞ্জাবি পরে শহীদ মিনারে গিয়ে ছবি না তুলে কিংবা সেলফি না তুলে পোস্ট না দিলে যেন এখনকার সমাজে জাত থাকে না। তাই এখন একুশে ফেব্রুয়ারি অন্য ধরনের আমেজ নিয়ে আসে।

মানি, সেই দিন আর নেই। এখন ডিজিটাল যুগ। অনেকটা যেন প্রমাণ রাখার যুগ। এখন সবার হাতে হাতে মোবাইল, ক্যামেরা। সব মুহূর্ত বন্দি করা সম্ভব। সেই সুবাদেই ফেসবুকের ফিডে শহীদ মিনারের ছবি ঘুরে, আরও ঘুরে সবার সাজসজ্জা করে শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা ফুল দেওয়ার ছবি, কিন্তু সেই কালজয়ী গানের কথা আমরা ভুলে যাই। আমাদের এখন পাড়ায় বাজে অন্য বাংলা ও হিন্দি গান, দেশাত্মবোধক গান। সেসব গানের প্রতিবাদ নয়, কিন্তু প্রশ্ন রাখি- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানটি কেন বাজানো হয়নি?

এর কারণ একুশে ফেব্রুয়ারি এখন অনেকটাই বেনিয়াদের দখলে। একুশ এখন অনেকটাই ‘বাজারি’। কারণ, আমাদের মনোযোগ যে সরে গেছে অনেকখানি। হয়তো সে কারণেই পোশাকী একুশ আমাদের কাছে যতটা কাঙ্ক্ষিত, এর ঐতিহ্য, ইতিহাস কিংবা শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের রীতি নিয়ে আমরা খুব বেশি ভাবিত নই।

অনেকেই হয়তো প্রশ্ন করবেন কেন এই গানই গাইতে হবে? নিশ্চয়ই এটি নিয়ম নয়। কিন্তু এটি প্রভাত ফেরির ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত। এটি ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেওয়ার গান, আর এই গানটি রচনা এবং সুর দেওয়ারও একটি ইতিহাস রয়েছে।

১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রাণ দেওয়া সেই শহীদদের স্মরণীয় রাখতে সেই গানের সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদ শহীদ হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে, ১৯৭১ সালে। এই গান রচয়িতা আব্দুল গাফ্‌ফার চৌধুরী মারা গেছেন গত বছর। তবে কী তাঁর সঙ্গে নিয়ে গেছেন এই গানটি?

‘একুশ মানে মাথা নত না করা’- ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা অনেকেই এমন পোস্ট দিই। কিন্তু আমরা ইতোমধ্যে তা বিকিয়ে দিয়েছি। কী কারণে প্রভাত ফেরি পরিবর্তে একুশের প্রথম প্রহরের নামে অন্ধকার রাতেই শ্রদ্ধা জানানো শুরু হলো? কার স্বার্থে হলো এমন পরিবর্তন? সেই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় কি তবে হৃদয় থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে অমর একুশের সেই যুগান্তকারী গানটি?

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
স্বজনদের প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন ওবায়দুল কাদের
স্বজনদের প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন ওবায়দুল কাদের
দুর্নীতির দায়ে ক্যারিবিয়ান ব্যাটারকে ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা
দুর্নীতির দায়ে ক্যারিবিয়ান ব্যাটারকে ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা
এসএসসি’র ফল প্রকাশের দিন ঘোষণা
এসএসসি’র ফল প্রকাশের দিন ঘোষণা
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় ৮ সেনা আহত
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় ৮ সেনা আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ