X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

যত দোষ, সাংবাদিক ঘোষ

প্রভাষ আমিন
২৪ মার্চ ২০২৩, ১৬:৫৬আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৩, ১৬:৫৬

হঠাৎ আলোচনায় রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে হৃদয় মোল্লা ওরফে হৃদি শেখ ওরফে আরাভ খান। এই আন্তর্জাতিক জালিয়াত বাংলাদেশে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন হত্যা মামলার আসামি হয়ে পালিয়ে প্রথমে ভারত যান। সেখানে জালিয়াতি করে ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে যান দুবাই। আরাভ খান নিজেই দাবি করেছেন, তিনি একজন দিনমজুরের ছেলে এবং ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় দুই বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে মোট পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে উড়াল দিয়েছিলেন। তারপর বছর তিনেকের মধ্যে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা, ফ্ল্যাট, বাগানবাড়ি, গাড়ি, কোটি টাকার বাজ পাখির গল্পও তিনিই শুনিয়েছেন। বাংলাদেশে অনেক মামলার আসামিই সুযোগ পেলে পালিয়ে যায়।

ভারত যেহেতু নিকট প্রতিবেশী, তাই পালানোর প্রথম সুযোগটা সবাই ভারতেই নেয়। প্রায় চার বছর ধরে পালিয়ে থাকলেও রবিউল ইসলাম বা আরাভ খান কোনও আলোচনায় ছিলেন না। পুলিশ বিভিন্ন মামলায় তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করলেও তাকে খুঁজে পায়নি বা খুঁজে বের করার কোনও চেষ্টা করেনি। যে কাজটি পুলিশের করার কথা, সেটিই করেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম। নতুন পত্রিকা প্রতিদিনের বাংলাদেশ আলোচনায় আসে গত ১৫ মার্চ ‘কার ডাকে দুবাইয়ে সাকিব আল হাসান’ শিরোনামের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দিয়ে। বাংলাদেশের আরও অসংখ্য পলাতক আসামি থাকতে প্রতিদিনের বাংলাদেশ হঠাৎ আরাভ খানকে নিয়ে অনুসন্ধান করলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে তাদের শিরোনামেই। কারণ, আরাভ খানের ডাকেই দুবাই ছুটে গেছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার, বাংলাদেশ ক্রিকেটের পোস্টার বয় সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান গত ২ ফেব্রুয়ারি থেকেই ১৫ মার্চ দুবাইয়ে আরাভ খানের মালিকানাধীন আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নিজের উপস্থিত থাকা নিশ্চিত করে সবাইকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন। সাকিব আল হাসানের আমন্ত্রণ দেখেই হয়তো প্রতিদিনের বাংলাদেশ অনুসন্ধানে নামে।

টি-২০ সিরিজে ইংল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করেই সাকিব ছুটে যান দুবাই। যেদিন আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধন হয়, সেদিনই বোমাটি ফাটায় প্রতিদিনের বাংলাদেশ। তারপর থেকেই আরাভ খান বাংলাদেশের সব গণমাধ্যমের আগ্রহের কেন্দ্রে। প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায় বা টেলিভিশনের পর্দায় বা ফেসবুক-ইউটিউবে আরাভ খানের সরব উপস্থিতি। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে এখন প্রতিদিনই বেরিয়ে আসছে অজগর, অ্যানাকোন্ডা। লজেন্স ফুরিয়ে গেলে লাঠির কোনও দাম থাকে না, আমরা ছুড়ে ফেলে দেই। আবার সেই ফেলনা লাঠি না থাকলে কিন্তু আমরা লাঠি লজেন্স কিনিই না। তাই লজেন্সের সঙ্গে থাকলেই লাঠি মূল্যবান। তেমনি সাকিব আল হাসানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলেই আলোচনায় এসেছেন আরাভ খান। হিরো আলমকে দিয়ে জুয়েলারির দোকান উদ্বোধন করালে আরাভ খানকে নিয়ে কেউ আগ্রহী হতেন না। সাকিব আল হাসানকে নিয়ে ধামাকা করতে চেয়েছিলেন আরাভ খান। সমস্যা হলো ধামাকাটা একটু বেশি হয়ে গেছে। প্রচারের ঢোল এখন ফেটে যাওয়ার দশা।

মূলধারার গণমাধ্যমে আরাভ খানের বিরুদ্ধে এ কয়দিন যা যা অভিযোগ ছাপা হয়েছে, তার কোনোটাই কিন্তু মিথ্যা বা কল্পনাপ্রসূত নয়। আরাভ খান নিজেও তার কোনোটিই অস্বীকার করেননি। রবিউল ইসলাম গোপালগঞ্জের এক দিনমজুরের ছেলে। ঢাকায় এসে চুরি-ছিনতাই করেছেন। অস্ত্র মামলায় দুইবার জেল খেটেছেন। অভিজাত এলাকায় বাসা ভাড়া করে নারীদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করে বিত্তবানদের ব্ল্যাকমেইল করাই ছিল তার পেশা। তেমনই এক বাসায় গিয়ে খুন হন পুলিশ কর্মকর্তা মামুন। তারপরই পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যান ভারতে। ঘটনাস্থলে রবিউল উপস্থিত না থাকলেও লাশ গুম করতে তিনি সহায়তা করেছেন। তিনি মামলার ৬ নাম্বার আসামি।

এই মামলায় চার্জশিটও হয়ে গেছে। অধিকাংশ মূলধারার পত্রিকাতেই রবিউলের অস্ত্র মামলায় জেল খাটার কথা এবং পুলিশ হত্যা মামলায় আসামি থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কেউ তাকে খুনি বলেনি। আরাভ আলোচনায় আসতে চেয়েছিলেন বলেই দেশি-বিদেশি তারকাদের দিয়ে দোকানের প্রচারণা করিয়েছিলেন। কিন্তু আলোচনাটা বেশি হয়ে যাওয়ায় এখন হজম করতে সমস্যা হচ্ছে। তাতেই আরাভ খানের সব ক্ষোভ এখন সাংবাদিকদের প্রতি। যেন সাংবাদিকরাই তার একমাত্র শত্রু। আরাভ একজন খুব চতুর মানুষ। তিনি জানেন, বাংলাদেশে সাংবাদিকরাই সবচেয়ে সফট টার্গেট। সাংবাদিকরা সবচেয়ে নিরীহ। তাদের গালাগাল করলেও তারা কিছু বলেন না। আর সাংবাদিকদের গালি দিলে সহজেই জনগণের সহানুভূতি পাওয়া যায়। আরাভ সহানুভূতি পাওয়ার এই সহজ রাস্তাটাই বেছে নিয়েছেন। অবশ্য বাংলাদেশে মানুষের সহানুভূতি পাওয়ার আরও এরচেয়েও সহজ রাস্তা হলো ধর্মের কার্ড। ধূর্ত আরাভ সেই কার্ডটিও খেলেছেন নিপুণভাবে। আরাভ ঘোষণা দিয়েছেন, সুযোগ দিলে ৬৪ জেলায় মসজিদ করে দেবেন তিনি। মসজিদের কথা শুনে যারা আরাভ খানকে মাথায় তুলে নাচছেন, তাদের মনে একবারও প্রশ্ন আসেনি, বছর চারেক আগে খুনের মামলা মাথায় করে ধার করা পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া একজন দিনমজুরের ছেলে ৬৪ জেলায় মসজিদ বানানোর টাকা পাবে কোথায়?

সাধারণ মানুষের মনে এই প্রশ্ন না এলেও সাংবাদিকদের মনে এসেছে। আর সাংবাদিকদের কাজই হলো প্রশ্ন করা, অনুসন্ধান করা, সত্য বের করে আনা। সাংবাদিকরা বারবার প্রশ্ন করেছে, রবিউল কীভাবে তার বদলে আরেকজনকে আদালতে হাজির করলো, রবিউল কীভাবে পালিয়ে গেলো, কীভাবে ভারতের পাসপোর্ট বানালো, কীভাবে মাত্র তিন বছরে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট-বাগানবাড়ি বানালো, কীভাবে দামি গাড়ি কিনলো, হাজার কোটি টাকার ব্যবসার পুঁজি পেলো কোত্থেকে, দুবাই থেকে কীভাবে দুইবার বাংলাদেশে এলো, পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার আসামি হয়েও এতদিন কীভাবে লাপাত্তা হয়ে থাকলো ইত্যাদি। সবগুলোই ন্যায্য প্রশ্ন। এসব প্রশ্নে আরাভ খানের জালিয়াতির কথা যেমন আছে, পুলিশের ব্যর্থতাও আছে, আছে আরাভ খানের পেছনে থাকা রাঘব বোয়ালের অনুসন্ধানের আকাঙ্ক্ষা। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকরা এখন আরাভ খানের চক্ষুশূল। ঘটনার পর থেকে আরাভ খান নিজের ফেসবুকে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বা ইউটিউবে লাগাতার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যাচ্ছেন। তিনি সাংবাদিকদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছেন। প্রথমেই তিনি অভিযোগ করেন, বাংলাদেশের কোনও সাংবাদিক নাকি তার কাছে নিউজ না ছাপার জন্য পাঁচ কোটি টাকা চাঁদা চেয়েছেন। কারও বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করা খুব সহজ। কিন্তু অভিযোগটা হতে হবে সুনির্দিষ্ট এবং তথ্যভিত্তিক। কিন্তু জালিয়াত আরাভ খান আক্রমণকেই প্রতিরক্ষার সেরা উপায় ধরে প্রতিদিন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ করে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশের সব সাংবাদিক ভালো এমন দাবি আমি করছি না। হয়তো অনেকেই আছেন যারা অন্যায় সুবিধা নেন, কেউ কেউ হয়তো চাঁদাবাজিও করেন। কিন্তু আরাভ খান যেভাবে নাম না বলে একজন সাংবাদিক চাঁদা চেয়েছেন এমন ঢালাও অভিযোগ দিয়ে গোটা সাংবাদিক সমাজকেই হেয় করছেন, তা অন্যায়। সৎসাহস থাকলে আরাভ খান, কে তার কাছে চাঁদা চেয়েছেন, তার নাম বলুক, প্রমাণ দিক।

গত ১২ বছরে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করা অনেক কঠিন হয়ে গেছে। টিকে থাকতে অনেকেই সরকারের দালালিও হয়তো করছেন। কিন্তু এই সময়ে সরকারের যত অনিয়ম, দুর্নীতি, মানি লন্ডারিং– সব খবর কিন্তু সাংবাদিকরাই প্রকাশ করেছেন। এই যে আরাভ খান নামের আন্তর্জাতিক জালিয়াতের জীবনের অন্ধকার অধ্যায়, সেটাও কিন্তু সাংবাদিকরাই অনুসন্ধান করে বের করেছেন।

আরাভ খান হয়তো ভেবেছিলেন, দুবাইয়ে কেউ তাকে ছুঁতে পারবে না। তিনি সেখানে বসে যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যম প্রমাণ করেছে সৎ সাংবাদিকতার শক্তি এখনও ফুরিয়ে যায়নি। গণমাধ্যমের চাপে পুলিশও এখন নড়েচড়ে বসেছে। ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। খবর পাচ্ছি, আরাভ খান এখন দুবাই পুলিশের নজরদারিতে আছেন। তার আরাভ জুয়েলার্সও বন্ধ হওয়ার জোগাড়। একে একে ধসে পড়ছে তার হাওয়াই সাম্রাজ্য। আর এসবই হচ্ছে সাংবাদিকদের দৃঢ়তার কারণে। আরাভ খানের মতো জালিয়াত যত সাংবাদিকদের গালি দেবে, ততই মনে হবে সাংবাদিকরা ঠিক পথে আছে, ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে সাংবাদিকদের কাজ এখনও শেষ হয়নি। আরাভ খানকে ফিরিয়ে এনে আইনে সোপর্দ করা পর্যন্ত লেগে থাকতে হবে।

আরাভ খানের পেছনে কারা আছেন, তাদের নাম বের করতে হবে। কীভাবে বাংলাদেশ থেকে টাকা দুবাইয়ে উড়ে উড়ে যায়, তা বের করতে হবে। পাচারকারীদের পাখা কাটা পর্যন্ত লেগে থাকতে হবে। এটাই সাংবাদিকদের কাজ। কে গালি দিলো, কে ধন্যবাদ দিলো, তা নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করার দরকার নেই।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা  
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ