X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

রফতানি বৃদ্ধিতে অপ্রচলিত পণ্য

প্রণব মজুমদার
০৮ এপ্রিল ২০২৩, ১৭:৪৬আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০২৩, ১৭:৩৩

সত্তরের দশকের শেষের দিকে রফতানিমুখী খাত হিসেবে তৈরি পোশাক স্বীকৃতি লাভ করে। বর্তমানে তৈরি পোশাক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রফতানিমুখী শিল্প খাত। ২০২১-২২ অর্থবছরে শুধু তৈরি পোশাক শিল্পের রফতানির পরিমাণ ৪২.৬১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশের মোট রফতানির ৮১.৮১ ভাগ। বর্তমানে তৈরি পোশাক রফতানিতে বিশ্বে একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।

একসময় পাটকে বলা হতো সোনালি ফসল। ধীরে ধীরে সেই জায়গা দখল করে নেয় তৈরি পোশাক খাত। দেশের ৭৫০টি পণ্য নিয়মিত রফতানি হচ্ছে। তবে করোনাকালে একেবারেই নতুন পণ্য হিসেবে রফতানি খাতে আয় বাড়িয়েছে অপ্রচলিত বেশ কিছু পণ্য। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো অনুমোদিত এসব অপ্রচলিত পণ্য ৪৪টি। অপ্রচলিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে ওষুধ, ফলমূল, পাট ও পাটজাত পণ্য, কাঁচা পাট, শাকসবজি, জুতা (চামড়া ব্যতীত), আসবাব, কারপেট, জুট ইয়ার্ন অ্যান্ড টোয়াইন, গলফ সাফট, তামাক, জাহাজ, চা, হ্যান্ডিক্রাফটস, রক্ত নেওয়ার পাইপ, সি আর কয়েল, তামার তার, মাছ ধরার বড়শি, মশারি, শুকনো খাবার, খেলনা, আগর, ছাতার লাঠি, শাকসবজির বীজ, নারিকেলের ছোবড়া ও খোল দিয়ে তৈরি পণ্য, বেল্ট, পাঁপড়, হাঁসের পালকের তৈরি পণ্য, লুঙ্গি, কাজু বাদাম, চশমার ফ্রেম, কৃত্রিম ফুল, পরচুলা, গরুর নাড়িভুঁড়ি, টুপি ও চারকোল। বৈচিত্র্য এনেছে পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস, গাউন, মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টসহ বিভিন্ন ধরনের সুরক্ষাসামগ্রী পণ্য। এর বাইরেও এমন অনেক পণ্য আছে যেগুলো তুলনামূলক কম পরিচিত বা অনেক ক্ষেত্রে প্রায় অপরিচিত। বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের চাহিদা বেশ।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো বলেছে, অপ্রচলিত এসব পণ্য নগদ প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসার কথা ভাবছে সরকার। নগদ প্রণোদনা দিতে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ২১টি প্রস্তাব দিয়েছে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)।

করোনা পরিস্থিতি রফতানি খাতে কিছু সম্ভাবনাও নিয়ে এসেছে। রফতানি তালিকায় যুক্ত করেছে নতুন কিছু পণ্য। ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ (পিপিই) হিসেবে চাহিদা বেড়েছে বিশ্বে। বেড়েছে মাস্ক বা মুখোশের ব্যবহার।

মাস্ক ছাড়াও চাহিদাসম্পন্ন পণ্যের মধ্যে আছে মেডিকার্ট রোবট এবং জীবাণুনাশক রিমোট কট্রোল ইউভি-সি সিস্টেম, ভেন্টিলেটর বা অক্সিজেন সরবরাহকারী যন্ত্র, ফেস প্রটেকটিভ শিল্ড, সেফটি গগলস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও থার্মোমিটার। বর্তমানে ঢাকা ও তার আশপাশে সাভার ও গাজীপুরের ৩৩টি কারখানায় তৈরি হচ্ছে পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) ও ফেসিয়াল মাস্ক।
নতুন ধরনের পণ্য রফতানির সুযোগ বেশি থাকে। এজন্য রফতানি বাড়াতে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নিয়ে এগোতে হয়। কোন পণ্য কোন দেশে কীভাবে বাণিজ্যিক সাফল্যে সক্ষম, এর সঠিক তথ্য কারও কাছেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। নিতান্তই ফেলনা, অব্যবহারযোগ্য পণ্যও অনেক সময় রফতানির ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় হয়ে থাকে। যেমন, মাছের আঁশ, বিশেষ করে রুই, কাতল ও কালিবাউশের আঁশ রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে এবং যারা রফতানি করছেন তারাও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একটি বাজার খুঁজে পেয়েছেন। বাজারে যারা মাছ কেটে বিক্রি করে, বিশেষ করে শহর এলাকায়, তাদের কাছ থেকে উদ্যোক্তারা মাছের আঁশ কিনে নেন। পরে এগুলো শুকিয়ে প্যাকেটজাত করে রফতানি করা হয়। মাছের আঁশের প্রথম গন্তব্য ইতালি। বাংলাদেশ থেকে পাঠানো মাছের আঁশ ইতালিতে প্রসাধনীর উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। পুরো পশ্চিম ইউরোপে এর সম্প্রসারণ সম্ভব।

মাছের আঁশের দ্বিতীয় গন্তব্য জাপান ও কোরিয়া। এ দুই দেশে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো মাছের আঁশ দিয়ে ওষুধের ক্যাপসুলের খোলস বানানো হচ্ছে। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও চীনে বাংলাদেশের মাছের আঁশ ব্যবহার হচ্ছে সুপের মতো তরল খাদ্য উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে।

পাটখড়ি পোড়ানো ছাই রফতানি শুরু হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। যতটুকু জানা যায়, এ ছাই যাচ্ছে চীন ও ইতালি। ব্যাটারির ভেতরকার কার্বন হিসেবে এ ছাই ব্যবহার হচ্ছে। ব্যাটারি একটি উল্লেখযোগ্য পণ্য। পৃথিবীর সব দেশেই এর কমবেশি ব্যবহার আছে। বিদেশে দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে এ পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার খুঁজে বের করা মোটেও কঠিন কাজ নয়। প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার।

ঝিনুকের মুক্তা। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে ২০০০ সালে মুক্তা নিয়ে সফল গবেষণা করেছেন কয়েকজন জাপানি বিজ্ঞানী। তারা নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের হাওড় এলাকায় এ কাজটি সম্পন্ন করেছেন। দেশে তিন ধরনের কৃত্রিম মুক্তা উৎপাদন করা সম্ভব। এগুলো হলো পিঙ্ক পার্ল বা গোলাপি মুক্তা, হোয়াইট পার্ল বা সাদা মুক্তা এবং ব্ল্যাক পার্ল বা কালো মুক্তা। একেবারেই গ্রামীণ পরিবেশে গৃহস্থালির পাশাপাশি অনেকটা হাঁস-মুরগি পালনের মতো বাড়তি আয়ের সন্ধানে পরিবারের বউ-ঝিরা মুক্তা উৎপাদনে ব্যবহার করতে পারেন বাড়ির পাশের নালা, ডোবা কিংবা স্বচ্ছ পানির প্রবাহ। উল্লেখ্য, মুক্তা উৎপাদনে খরচ খুব কম। সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে বড় আয়োজনের কোনও উদ্যোগ এখনও অনুপস্থিত মুক্তা উৎপাদনে।
কচুরিপানা ব্যবহার করে তুলট কাগজের মণ্ড উৎপাদন শুরু হয়েছে বরিশাল ও ফরিদপুরের কিছু অঞ্চলে একটি ইউরোপীয় এনজিওর সহযোগিতায়। দশ বছর ধরে কচুরিপানা থেকে মণ্ড তৈরির কাজটি তারা করছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীদের দিয়ে। এ দেশে ওই কাগজ ব্যবহার হয় না। মণ্ড ও উৎপাদিত কাগজ নিয়ে যাওয়া হয় ইউরোপে এবং সেখানে এগুলো উন্নত প্রক্রিয়ায় পুনরায় শিল্পায়িত করা হয়। বিভিন্ন কার্ড তৈরিতে এগুলো ব্যবহার হয়। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এ ধরনের অপ্রচলিত পণ্য খুঁজে বের করে তা কাজে লাগাতে পারলে তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে নিশ্চিত।

অপ্রচলিত পণ্য থেকে বার্ষিক রফতানি আয় কত, এর সুনির্দিষ্ট বা পৃথক কোনও হিসাব রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কাছে নেই। তবে ইপিবির বিভিন্ন সময়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে অপ্রচলিত পণ্য থেকে আয় হয়েছে ২০ হাজার কোটি ডলার। আগের বছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে এ আয় ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে পরিচিত ইনসুলেটর তৈরি ও রফতানিতে ১৪০ কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে নিটল-নিলয় শিল্প গ্রুপ। এ বিনিয়োগ পেতে শিল্পগোষ্ঠীকে সহায়তা করেছে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।

দীর্ঘদিন ধরেই সরকারের পক্ষ থেকে রফতানি বহুমুখীকরণের কথা বলা হচ্ছে। সুবিধা বা প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রেও সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ খাতভিত্তিক। প্রচলিত রফতানি সহায়তা থেকে বের হয়ে উদ্যোক্তাকেন্দ্রিক সহায়তা বাড়াতে হবে। তাহলে অপ্রচলিত পণ্যের রফতানি বাজার বড় হবে। এ ক্ষেত্রে ছোট উদ্যোক্তাদের অনেক সমস্যা পোহাতে হয়। কারখানা স্থাপন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বন্দরে ট্রেড লজিস্টিকসের সমস্যা, রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন রকমের ট্যারিফ পলিসির কারণে ছোট উদ্যোক্তাদের প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, সরকার তৈরি পোশাকে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু রফতানি বহুমুখীকরণে অপ্রচলিত পণ্যের বিকাশে বিশেষ উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এ কারণে ধীরগতিতে এগোচ্ছে দেশের অপ্রচলিত পণ্যের রফতানি বাজার। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অপ্রচলিত পণ্য রফতানির ঝুড়িটি দিন দিন বড় ও ভারী হতে পারে মনোযোগী হলে। এতে কর্মসংস্থান বাড়ার পাশাপাশি আয় হবে বৈদেশিক মুদ্রাও। অপ্রচলিত এসব পণ্যের বৈদেশিক বাজার প্রসারিত হলে দেশের মোট রফতানি আয়ে তা বড় সহায়ক হবে বলাই যায়। তাই সংকটময় অর্থনীতিতে রফতানি বাণিজ্য প্রবৃদ্ধিতে অপ্রচলিত পণ্যের গুরুত্ব দিতেই হবে আমাদের।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অর্থকাগজ সম্পাদক
[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হেফাজতের ২০৩ মামলা
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হেফাজতের ২০৩ মামলা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ