X
বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫
৫ চৈত্র ১৪৩১

সেই জুজুবুড়িটা, আর দুই দেশের চলতি জাতীয়তাবাদ

মানস চৌধুরী
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১২:০৩আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১২:০৪

মানস চৌধুরীদিল্লি থেকে কলকাতা বিমানবন্দরে নামলাম যখন তখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা, বৃহস্পতিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি। আমার গতিবিধিতে এ দফা ইমিগ্রেশন ছিল না, অভ্যন্তরীণ যাত্রী হিসেবে। কিন্তু তার মধ্যেই আমার গতিবিধি সন্দেহজনক বলে সাব্যস্ত হলো। বিমানবন্দরের একজন কর্মকর্তা আমাকে বেশ কড়া গলায় এক প্রান্তে বসতে বললেন। এসব ক্ষেত্রে বাছুরের মতো থাকার একটা নীতিমালা আমি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবলম্বন করতে শুরু করেছি। যেখানে বসানো হলো, বিমানবন্দরের অজস্র আসনের একসারি খানিকটা স্বতন্ত্র দূরে-থাকা আসনে, তার পাশেই দেয়ালে লেখা হিন্দি, ইংরেজি ও বাংলায়: ‘নজরবন্দি মহিলা’, ‘নজরবন্দি পুরুষ’। এই বর্গ-প্রজ্ঞাপন জানার পর থেকে একটু ভ্যাবদা-মারা বিষাদ সমেত আমি সেই চুপচাপ শান্ত বাছুরের নীতিতে অনেকক্ষণ বসে রইলাম যতক্ষণ না কর্মকর্তা নিজে বের হয়ে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ-কক্ষে ঢুকতে হুকুম করলেন। এদফা অপেক্ষাকৃত আনত গলায়।
আমার যে গতিবিধির জন্য এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায় তা বরং বলি। বিমানের এক অচেনা নারী সহযাত্রীর একজন বছরখানেক বয়সী শিশুসমেত গাদা-গাদা মালসামান দেখে আমি হাত লাগিয়েছি। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টে চলাফেরা করছেন, যদিও ভারতীয়। অর্থাৎ অভিবাসিত ভারতীয়/কলকাতীয়। আমি যেহেতু অভ্যন্তরীণ যাত্রী, আমাদের গন্তব্য আলাদা হলো। মালসামানের বেল্টে মুলাকাত হবে ভেবে আমি আমার ভূমিকা অব্যাহত রেখেছিলাম। এরই মধ্যে কারও নজরে আমি বেস্বাভাবিক বলে গণ্য হই, এবং তিনি যে তাঁর থেকে বড় একজন কর্মকর্তাকে ডেকে কানে-কানে আমার গতিবিধি জানান দেন সেটাও আমি লক্ষ্য করি। তাঁকে থামানোর বিদ্যা বা কৌশল আমার জানা ছিল না বিধায় এই পরিস্থিতি তখন মানতেই হয়। কিন্তু আমি নিশ্চিত এই শিশুমাতাকে সঙ্গপ্রদান না করলেও এরকম পরিস্থিতি হতে পারত। এটা একটা নিরাপত্তা বিধিব্যবস্থার ‘র‌্যান্ডম’ শিকার হয়ে পড়ার প্রশ্ন। দাড়িওয়ালার বেশি সম্ভাবনা থাকতে পারে, কিন্তু দাড়ি-কামানো ঝকঝকে গালের কেউ হবেন না তা হলফ করে বলা যায় না। পৃথিবীর যেকোনও বিমানবন্দরেই হতে পারে।
জিজ্ঞাসাবাদ-কক্ষে কর্মকর্তার সঙ্গে পরিশেষে শিষ্ঠাচারমণ্ডিত এক আলাপ গড়ে উঠতে থাকল। প্রায় গালগল্প হয়ে উঠছিল শেষের দিকটাতে তাও বলা যায়। সন্দীপ নামের এই কর্মকর্তা বাংলা বলেন না, হয়তো অন্যত্র বাড়ি। কিন্তু আমাকে হিন্দি আলাপ চালিয়ে যাওয়ার বাধ্যবাধকতায় না ফেলে তিনি ইংরেজি বলবার দয়ালু মনোভাবটাও দেখিয়েছেন। আমি সামাজিক বিজ্ঞানের মাস্টার শুনে এরপর প্রায় দেশ-সমাজ-মনুষ্যত্ব ইত্যাদি বিষয়ক আগ্রহাদি প্রদর্শন করেন। এমনকি এটা জানাতেও ভোলেন না যে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন আমার মতো ‘ভালমানুষ’ খুব বেশি একটা বিমানবন্দরে তিনি দেখেননি। মধ্যে মধ্যে কর্তব্যবশত খুঁটিনাটি তথ্যাদি নোট রাখতে ভোলেননি। বলাইবাহুল্য বিদায় নেওয়ার আগ পর্যন্ত আমার পাসপোর্টখানা তাঁর কাছেই ছিল। তবে পরিশেষে যতই মিহিদানা হোক, এই জিজ্ঞাসাবাদের সূচনা ঘটেছিল জে.এন.ইউ.র ঘটনা আমার কেমন মনে হয় তা দিয়ে। প্রথম প্রশ্নটা হিন্দিতেই ছিল। 

গোয়েন্দা বিভাগের লোকজনদের ছাড়াও, গড়পরতা ভারতীয় আলাপচারিতায় জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাবলী কেন্দ্রীয় গুরুত্ববহ হয়েছে গত কয়েকদিনে। গত পুরো সপ্তাহ দিল্লিতে মধ্যবিত্ত পাবলিক জবান আচ্ছন্ন হয়ে আছে এই ঘটনায়, তা পক্ষসমূহ যাই হয়ে থাকুক না কেন। আমার ধারণা বাংলাদেশের পাঠকদের হৃদয়েও জে.এন.ইউ. একটু হয়তো আছর ফেলে। অন্তত এই কারণেও যে বিশ্ববিদ্যালয়টি অত্যন্ত সমীহ-জাগানিয়া ইমেজ নিয়ে আছে এই অঞ্চলে। যেসব সংবাদগ্রহীতা নানাবিধ সামাজিক আন্দোলন নিয়ে উৎসাহ বোধ করেন, জে.এন.ইউ. তাঁদের জন্যও নিত্য কৌতুহলের জায়গা হতে পারে।

ঘটনাপঞ্জী আলাদা করে বানাতে বসছি না। তবে সূত্রপাত ঘটেছে ০৯ ফেব্রুয়ারি, আফজল গুরুর মৃতুদণ্ডের তৃতীয় বর্ষপূর্তিতে যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী দিনটিকে স্মরণ করতে জড়ো হন। ক্ষমতাসীন বিজেপির অনুসারী শিক্ষার্থীদের দল এবিভিপি (অল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ) সেটাকে সরাসরি ভারতীয় ‘অখণ্ডতা’র জন্য হুমকি আর ‘এন্টি-ন্যাশলাল’ গণ্য করেছে। বিষয়টা আরও গুরুতর হচ্ছে এই কারণে বিজেপি ও তার যাবতীয় অঙ্গ-সংগঠনও এই ঘটনাকে এভাবে দেখতে চায়, এবং দেখাতে চায়। মিডিয়া, আইন-বিচার ইত্যাদি বিভাগগুলোতে বিজেপি ও তার উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রপাগান্ডা রাজনীতির বহু এজেন্ট/অনুসারী এখন রয়েছে। ফলে দ্রুত তাঁরাও এই প্রচারণায় সামিল হন। জে.এন.ইউ. শিক্ষার্থী সংসদের সভাপতি বামপন্থী নেতা কানহাইয়া কুমার এর সূত্রেই ১১ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হন। তিনি গ্রেফতার হন ‘সেডিশন’ বা রাষ্ট্রদ্রোহিতা/দেশদ্রোহিতার অভিযোগে। এই তথ্যসমূহ বাংলাদেশি পাঠকদের জন্য প্রাসঙ্গিক করার জন্য এটুকু জানানো উচিত যে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গড়পরতা বামপন্থী শিক্ষার্থীদের বেশ লক্ষ্যণীয় উপস্থিতি ও তৎপরতা রয়েছে। জে.এন.ইউ.র মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে তো বটেই। তাঁরা বিভিন্ন অঞ্চলের আন্দোলনের প্রতি সাধারণভাবে সহানুভূতিপ্রবণ বলেও পরিচিত। এছাড়া ভারতীয় গড়পরতা লিবেরেল মধ্যবিত্ত জে.এন.ইউ.র মতো ক্যাম্পাসে বিজেপি অনুসারী শিক্ষার্থীর উপস্থিতি যে এখন একটা নিবিড় বাস্তবতা সেটার জন্য প্রস্তুত খুব একটা থাকেন না।

কানহাইয়া কুমার এখন সেলে। সম্ভবত ১২ তারিখ আদালতে শুনানির দিন বিজেপিপন্থী আইনজীবী আর মিডিয়াকর্মীরা কানহাইয়া কুমারের সমর্থনে জড়ো হওয়া জে.এন.ইউ.’র শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে। সেসবের ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। সেই হামলা নিয়ে বিজেপি সরকারের কোনও আওয়াজ নেই, বরং বিভিন্ন সাংসদ ও নেতারা ‘দেশদ্রোহী’দের প্রতি হুঙ্কার ছেড়ে চলেছেন, প্রকাশ্যে, গণমাধ্যমে। জওহরলালে লাগাতার বিশাল সংখ্যায় শিক্ষার্থী জমায়েত হচ্ছে কানহাইয়ার মুক্তির দাবিতে, ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে। দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী জে.এন.ইউ.র শিক্ষকদেরও বিশাল অংশ এই আন্দোলনে সামিল। অন্যান্য শিক্ষায়তনের শিক্ষক-শিক্ষার্থী এই আন্দোলনে লিখিত ও সশরীর সমর্থন জানাচ্ছেন। দক্ষিণ এশীয় বিশ্ববিদ্যালয় (সার্ক ইউনিভার্সিটি/সাউ) যেখানে আমার নিমন্ত্রণ ছিল, তাঁদের শিক্ষক পরিষদ লিখিতভাবে, আর শিক্ষার্থীদের অংশবিশেষ সশরীর রাস্তাঘাটে সমর্থন জানাতে গেছিলেন। সাউ-এর জাতীয়তাবাদী/বিজেপিপন্থী শিক্ষার্থীরা এতে অত্যন্ত থমথমে রাগত মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরপর আমি কলকাতায় ফিরবার আগের দিনেই কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যন্ত সংঘাতমুখর পরিস্থিতি হয়েছে রাষ্ট্রের ‘ফ্যাসিবাদ’/দমননীতির সমালোচক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ‘অখণ্ডতা’ রক্ষাকারী তথা ‘এন্টিন্যাশনালিজম’ বরদাশত করতে চায় না এমন শিক্ষার্থীদের।

প্রায় নিভৃতেই জে.এন.ইউ.’র কাশ্মীরের দু’জন শিক্ষার্থী কানহাইয়া কুমারের পরপর গ্রেফতার হন। যাঁরা একটু বিচারবোধ নিয়ে ভারতের পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝবেন এই পীড়ন-পদ্ধতি কাশ্মীরের শিক্ষার্থী বা বিভিন্ন অঞ্চলের গণতন্ত্রমুখী শিক্ষার্থীদের ওপর শুরু হয়েছে, হতে থাকবে। অপ্রকাশ্য, গুপ্ত, পরিকল্পনামাফিক। এই সকল পীড়নকৌশলের অজুহাত হচ্ছে ভারত রাষ্ট্রের অখণ্ডতার প্রশ্ন। দেশদ্রোহিতা বা এন্টিন্যাশনালিজমের একেবারে সাক্ষাৎ-ব্যাখ্যা হচ্ছে পাকিস্তানপন্থী হিসেবে চিত্রায়ন। ‘ভারতমাতা’কে রক্ষা করার উপায় হিসেবে ঘোষণাপত্র দাঁড়াচ্ছে ‘দেশদ্রোহিতা’র তথা পাকিস্তানপন্থীদের চরম শাস্তি প্রদান। দিল্লিতে আদালতের বাইরে যেটা ঘটল সেটার প্রেক্ষিতে মনে হয়, এমনকি গণপিটুনি দিয়ে হলেও। কাশ্মীরের শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মীদের বিরুদ্ধে এটা প্রয়োগ করা সহজতর হলেও এর প্রয়োগ কমবেশি যে-কারোর বিরুদ্ধেই হওয়া সম্ভব।

জুজুবুড়ি হিসেবে পাকিস্তান এই মুহূর্তের উগ্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদের (কারও আরাম লাগলে হিন্দু মৌলবাদ বলতে পারেন, তাতে আমার বোঝাপড়া বদলাবে না) বিকাশের গুরুতর শর্ত।

মনে পড়ে গেল ক’দিন আগে অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল প্রণীত একটা রচনার কথা। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিএনপি’র কূটকৌশলকে প্রতিহত করতে গিয়ে তিনি, নিবিড় কৌশলে, টেনে এনেছেন সেইসব চিন্তক-সমাজকর্মীদের প্রসঙ্গ যাঁরা ক’মাস আগে মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে নিজেদের অবস্থান/দাবিনামাকে সামনে আনতে গিয়ে আদালত ‘অবমাননা’র দায়ে পড়েছেন। জনাব ইকবালের ট্রিকটাও ছিল ‘পাকিস্তান’। ঢা.বি.র ‘দেশপ্রেম’ প্রকাশের জন্য ‘পাকিস্তান’ আবারও প্রয়োগকৃত হয়। এই মুহূর্তের বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী ঢাকঢোলের মধ্যে ‘পাকিস্তানপন্থিতা’র অভিযোগ খুব গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে।

পাকিস্তানের আম-মানুষজন তাঁদের এই নয়াগুরুত্বে খুশি হবেন কিনা আমার ধারণা নেই। তবে চাইলে তাঁরা এই গৌরব বোধ করতে পারেন যে তাঁদের রাষ্ট্রখানা এই অঞ্চলের দুইটা গুরুত্বপূর্ণ দেশে শাসকদের জন্য কড়া জাতীয়তাবাদী উছিলা সরবরাহ করেছে। দেশবিভাগের পর এত গুরুতর অস্তিত্ব আঞ্চলিক রাজনীতিতে আর কখনও তাঁদের ছিল কিনা সন্দেহ!

লেখক: জা.বি.তে নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক; আর বিশ্লেষক, গল্পকার. অভিনেতা, সম্পাদক। 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজায় নতুন করে স্থল অভিযানও শুরু করেছে ইসরায়েল
গাজায় নতুন করে স্থল অভিযানও শুরু করেছে ইসরায়েল
ইফতার মাহফিল নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত ছাত্রদল নেতার মৃত্যু
ইফতার মাহফিল নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত ছাত্রদল নেতার মৃত্যু
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্র করে লাভ হবে না: আমিনুল হক 
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্র করে লাভ হবে না: আমিনুল হক 
চট্টগ্রামের রাউজানে বিএনপির দুই গ্রুপের দফায় দফায় সংঘর্ষ, একজন গুলিবিদ্ধসহ আহত ১৫
চট্টগ্রামের রাউজানে বিএনপির দুই গ্রুপের দফায় দফায় সংঘর্ষ, একজন গুলিবিদ্ধসহ আহত ১৫
সর্বশেষসর্বাধিক