X
সোমবার, ২০ মে ২০২৪
৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

দেশ ত্যাগের ‘তৃতীয় ধারা’

এম আর ইসলাম
০৬ মে ২০২৩, ১৪:১০আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮:২২

২০২৩ সালের জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি, শুধু এই দুই মাসেই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিহার করেছেন ৪৯৮ জন বাংলাদেশি। ২০১৭ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত এই সংখ্যা ২৫৫৫ জন ছাড়িয়েছে। এটা শুধু সেসব প্রবাসীর সংখ্যা, যাদের সংশ্লিষ্ট বসবাসকারী দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ নেই। এসবের বাইরে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ‘সেটেলড’ করবার জন্য, বহির্গমনের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও এই ক্ষেত্রে আমাদের যাবতীয় খেয়াল শুধু দুই শ্রেণির অভিবাসী বা বহির্গমনকারীদের দিকে। যাদের মধ্যে এক শ্রেণি হচ্ছে যারা দেশে বেকার; তারা ভাগ্যের অন্বেষণে বিভিন্ন দেশে গমন করেছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। অন্য শ্রেণি হচ্ছে দুর্নীতিবাজ আমলা, অসৎ রাজনীতিক আর ব্যবসায়িক লুটেরাদের দল। অথচ এই দুই শ্রেণির বাইরে আর একটা শ্রেণি আছে, যারা দেশ ছাড়তে চায় শুধু সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে। এই তৃতীয় শ্রেণিদের দেশ ছাড়ার উদ্দেশ্য আর ইচ্ছার মধ্যে আমাদের প্রিয় স্বদেশের সমসাময়িক সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার গল্প লুকিয়ে আছে।

লেখাপড়ার সূত্রে বিভিন্ন দেশে থাকার সুযোগ হয়েছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার কারণে অনেক মানুষের সঙ্গে জানাশোনা আর কথাবার্তার সুযোগ হয়েছে। সেই সুযোগে জানতে পারি দেশের একশ্রেণির শিক্ষিত এবং সচ্ছল ব্যক্তিরাও বিভিন্ন কারণে দেশ ছাড়তে চায়। এদের দেশে ভালো চাকরি, বেতন সবই আছে, তারপরও এরা বিভিন্ন উন্নত রাষ্ট্রের অভিবাসনের বিভিন্ন স্কিমের মাধ্যমে পাড়ি জমাতে চায়; চায় সেখানে স্থায়ী হতে। আন্তর্জাতিক অভিবাসী আইনের পরিভাষায় এদের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে স্থায়ী হওয়ার কারণকে বলে ‘pull factor’। অর্থাৎ, যে উন্নত দেশের সেফটি নেট বা সামাজিক নিরাপত্তা বলয় তাদের আকৃষ্ট করে, তেমন কালচার বা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা আমরা আমাদের দেশে কখনও তৈরিই করতে পারিনি।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত থেকে, যথেষ্ট ভালো বেতন পেয়ে, সুখী পরিবার নিয়েও অনেকে এ দেশে থাকতে চায় না। তার কারণ, এই দেশে তার অফিস আর পরিবারের বাইরে সে তেমন কোনও সামাজিক মর্যাদা পায় না। বাজার ঘাটে, সরকারি অফিসে সে নাগরিক হিসেবে যথেষ্ট মূল্যায়িত হয় না; অর্থাৎ তার যে ধরনের পরিসেবা সম্মানের সঙ্গে পাওয়ার কথা তা সে পায় না। সে হয়তো এক সরকারি অফিসে, ধরা যাক পাসপোর্ট করাতে গিয়ে দেখে, বিশেষ যোগাযোগের মাধ্যমে যে এসেছে তাকে সেবা দেওয়া হচ্ছে যথেষ্ট। আবার সরকারি আমলা, বা রাজনৈতিক পরিচয়ধারীরা তারই চোখের সামনে সেবাগত সুবিধা পাচ্ছে; অথচ সে বৈষম্যের শিকার। অথবা, তার বাসায় সাংঘাতিক চুরি সংঘটিত হয়েছে; সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হয়ে, যাবতীয় ফর্মালিটি সম্পন্ন করেও সে তেমন কোনও তৎপরতা দেখে না! অন্যদিকে, প্রভাবশালী কারও ফোন চুরি হলেও, হয়তো তা দ্রুত সময়ের মধ্যে উদ্ধার হয়! এমন আচরণ যারপরনাই একজনকে হীনম্মন্যতায় ভোগায়, সে নিজেকে নিরাপত্তাহীন ভাবতে থাকে। সে ভাবতে শুরু করে, বিসিএস দিয়ে আমলা না হয়ে, সে জীবনে এক বিরাট ভুল করেছে! আবার লেখাপড়া বাদ দিয়ে শুধু রাজনীতি নিয়ে পড়ে থাকলেও আজ তাকে বিভিন্ন ন্যায্য পরিসেবা পেতে বৈষম্যের শিকার হতে হতো না।

নির্বাহী অফিসগুলো বাদে, কোর্টকাচারিতেও এমন অনিশ্চয়তায় কাটে অনেক ভুক্তভোগীর জীবন। দেখা যায়, সঞ্চয়ের টাকা আর ব্যাংক লোন নিয়ে একটা প্লট কিনেও বছরের পর বছর ধরে একজন সাধারণ ক্রেতা হয়তো জমির দখল বুঝে পায়নি! এটা নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে অভিযোগ জানিয়েও তথাকথিত নেতাদের পেছনে ঘুরে ঘুরে ভুক্তভোগী ক্রেতা যখন ক্লান্ত, শেষ আশ্রয় হিসেবে তিনি কোর্টকাচারির শরণাপন্ন হন। কিন্তু, কোর্টের অসংখ্য মামলার চাপ, অসাধু আইনজীবীর অবহেলা বা কপটতায় হয়তো তার মামলা নিষ্পত্তি হয় না। জোচ্চোর বিক্রেতা তখন মনে মনে হাসে আর মামলার দীর্ঘসূত্রতাকেই সে তার সৌভাগ্য মনে করে। অন্যদিকে, ক্রেতা-বাদীর লোনের বোঝা বেড়েই চলে। একপর্যায়ে বাধ্য হয়েই হয়তো তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এ দেশে তার অবশিষ্ট সম্পত্তি বিক্রি করে অন্য কোনও দেশে স্থায়ী হবেন।

ইতোমধ্যে তিনি বুঝে গেছেন, এ দেশে তার মতো লোকের টিকে থাকা খুব একটা সহজ না।

সামাজিক অনিরাপত্তা পেশাগত জীবনকেও শঙ্কার মধ্যে ফেলে। কোনও প্রমাণিত অন্যায় না করেও শুধু অফিস পলিটিক্সের শিকার হয়ে অনেককে চাকরি হারাতে হয়। নিগ্রহের শিকার বা অহেতুক সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে। পারিবারিক রাজনৈতিক পরিচয় বের করে, রাজনৈতিক ট্যাগ জুটিয়ে দেওয়া হয় রাতারাতি। এমন অন্যায্য আচরণের শিকার হয়ে, অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমাতে চায়। যে দেশের সরকারি দফতরে তিনি তার যাবতীয় মেধা এবং দক্ষতা উজাড় করে দিয়েছেন, সেই দেশ থেকেই একপর্যায়ে বিদায় নিতে চান। এ যেন এক চিরতরের প্রস্থান।  

সামাজিক অনিরাপত্তা শুধু পেশাগত জীবনে বা আমলাতান্ত্রিক সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রেই নয়! দৈনন্দিন জীবনের অনেক পরিসেবাতেই মানুষকে বৈষম্যের শিকার হতে হয় প্রতিনিয়ত। খাবারে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল, হসপিটালে সেবার অপ্রতুলতা, পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জুলুম, ঘুষ বাণিজ্য, দেশের মানুষের অসততা আর অনাচারে অতিষ্ঠ হয়ে, জীবনের মধ্য বয়সে বা শেষ বয়সেও এসে অনেকে বিদেশে পাড়ি জমাতে চায়। দেশে আর ফিরতে চায় না, বিদেশেই স্থায়ী হতে চায়। অথচ সুদূর বিদেশবিভুঁইয়ে থেকেও প্রতিনিয়ত মাতৃভূমির জন্য তার অন্তর কাঁদে।

স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও আমরা দেশের সাধারণ মানুষের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারিনি। সমতা ভিত্তিক সমাজ বা আইনের প্রতিকার সব ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এদেশ সুবিধা দিতে চায় শুধু বিশেষভাবে ক্ষমতাবানদের। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না পেলে, সামাজিক সুরক্ষা বা সবার জন্য সম্মানজনক নিরাপদ জীবন কখনোই প্রতিষ্ঠা পাবে না। এহেন পরিস্থিতিতে, মানুষ বিদেশেই স্থায়ী হতে চাইবে, আর তা শুধু অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং যাবতীয় সামাজিক সুরক্ষার জন্য। কারণ, বিদেশে সামাজিক নিরাপত্তার জন্য কেউ আপনার রাজনৈতিক, পেশাগত, বংশীয় বা অর্থনৈতিক অবস্থা জানতে চাইবে না। আপনি ওই রাষ্ট্রের বৈধ বাসিন্দা, এমনকি শুধু একজন ‘মানুষ’, এতটুকু পরিচয়ই যথেষ্ট।    


লেখক: শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নকল ডায়াবেটিস টেস্টিং স্ট্রিপ ৭ দিনের মধ্যে ধ্বংসের নির্দেশ
নকল ডায়াবেটিস টেস্টিং স্ট্রিপ ৭ দিনের মধ্যে ধ্বংসের নির্দেশ
কথা দিয়ে রাখেনি আমিন, পাজেরো গাড়িতে ৭ লাখ ইয়াবা
কথা দিয়ে রাখেনি আমিন, পাজেরো গাড়িতে ৭ লাখ ইয়াবা
ইরানের প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে মির্জা ফখরুলের শোক
ইরানের প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে মির্জা ফখরুলের শোক
নির্বাচনের একদিন আগে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে জখম
নির্বাচনের একদিন আগে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে জখম
সর্বশেষসর্বাধিক