বাংলাদেশে এখন প্রতারণা খাতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো ব্যাংকের এটিএম বুথে প্রতারণা। এবার যা হয়েছে, তা হলো এটিএম বুথ বা টেলার মেশিনে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে গ্রাহকদের তথ্য নিয়ে এরপর বুথ থেকে টাকা তুলে নেওয়া। বিষয়টির মাঝে আরও কয়েকটি ধাপ আছে। তা হলো গ্রাহকের তথ্য নিয়ে নতুন কার্ড তৈরি করা। ওই কার্ড থেকেই টাকা তোলা হয়।
অনেকে ভাবতে পারেন, বাংলাদেশে বিষয়টি নতুন। আর বিদেশিরা সঙ্গে থাকায় প্রতারকরা ‘সফল’ হয়েছেন। এর সঙ্গে ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তাও জড়িয়ে পড়েছেন। বিদেশি নাগরিকসহ ব্যাংকের কর্মকর্তারা আটকও হয়েছেন।
কিন্তু সঠিক সময়ে ব্যবস্থা না নিলে যা হয়। এই জালিয়াতির ঘটনা বাংলাদেশে বছর তিনেক আগেও একবার ঘটেছিল। তা নিয়ে তখন ব্যাপক হইচই হয়। ব্র্যাক বাংক তখন তাদের বেশ কিছু বুথে এই জালিয়াতির ফুটেজ জমাও দিয়েছিল ডিবিকে। মনে আছে ডিবির এডিসি মশিউর রহমান তখন পুরো চক্রটিকে ধরে ফেলেছিলেন। আর সেই চক্রের হোতা ছিলেন এক প্রবাসী বাংলাদেশি তরুণ। তার সঙ্গে তখন আমার কথা হয়েছিল। তখন আমি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্ল্যানিং এডিটর হিসেবে কাজ করি। সঙ্গে ‘একুশের চোখ’ নামে একটি ইনডেপথ রিপোর্টিং অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা এবং উপস্থাপনার দায়িত্বও ছিল আমার ওপর।
ডিবির সহায়তায় সেই তরুণকে নিয়ে আমি তখন ব্যাংকের বেশ কয়েকটি এটিএম বুথে গিয়েছিলাম। আর সেই তরুণ তখন আমাদের হাতে কলমে দেখিয়ে দেন জালিয়াতির প্রক্রিয়া এবং পদ্ধতি। কিভাবে টেলার মেশিনে স্কিমিং ডিভাইস লাগানো হয় এবং কিভাবে পরে তা খুলে এনে গ্রাহকের তথ্য নিয়ে নতুন কার্ড বানানো হয়। সেই তরুণ ডিবিতে বসে নতুন কার্ড তৈরির কৌশল আমাদের হাতে-কলমে দেখিয়ে ছিলেন। আর এই আইটি শিক্ষিত তরুণ ভাগ্যের খোঁজে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পছন্দমতো কাজ না পেয়ে প্রতারণা বিদ্যা আয়ত্ত করে দেশে ফিরেছিলেন। আমি জানি না, তিনি এখনও কারাগারে না ছাড়া পেয়েছেন। ব্র্যাক ব্যাংকের তখনকার এক বড় কর্মকর্তা আমাকে বলেছিলেন, আইনে বাধা না থাকলে এই তরুণকে তারা তাদের ব্যাংকেই চাকরি দিতে চান এটিএম বুথ জালিয়াতি ঠেকাতে। তবে পুলিশ আমাকে জানিয়েছিল আইনে বাধা আছে।
তখনই এন্টি স্কিমিং ডিভাইসের কথা আলোচনায় আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকও আমাকে তখন এই ডিভাইসের কথা বলেছিল। সম্ভবত এরপরই বাংলাদেশ ব্যাংক টেলার মেশিনে ব্যাংকগুলোকে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস লাগাতে বলেছিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
তবে, জানিয়ে রাখি এন্টি স্কিমিং ডিভাইস লাগালেই বুথ নিরাপদ হবে না। আরও একটি পদ্ধতি আছে কার্ড গ্রাহকের তথ্য চুরি করার। তা হলো ঠিক বুথের যেখানে বাটন থাকে, তার ওপরে স্পাই ক্যামেরা বসানো। এরপর সেই ক্যামেরার ফুটেজ দিয়ে গ্রাহকের আঙুলের অবস্থান যেনে কার্ডের নম্বর ও গোপন পিন জেনে নতুন একটি কার্ড তৈরি করা। তবে ব্যাংক কর্মকর্তারাই প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়লে, যা এবার হয়েছে বিষয়টি প্রতিরোধ আরও জটিল হয়ে পড়ে।
সেবার বেশ কিছু এটিএম বুথে ঘুরে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, বুথের নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই। সিকিউরিটি গার্ড নামে বুথে যাদের নিয়োগ করা হয়, তারাও বুথের কাছে সব সময় থাকেন না। তারা নিরপত্তা বলতে বোঝেন চোর, ছিনতাইকারীর উপদ্রপ। আমরা তখন বেশ কয়েকজন নিরপত্তাকর্মীর সঙ্গে কথাও বলেছিলাম। তখন পর্যন্ত তারা জানতেন না যে, স্কিমিং ডিভাইস কী? স্পাই ক্যামেরা বসিয়ে তথ্য চুরি করা যায় কি না। আর তখনও স্কিমিং ডিভাইস চেক করার কোনও ব্যবস্থা ছিল না বুথে। তাহলে প্রতারণা ও জালিয়াতির ধরন সম্পর্কে জানেন না যে নিরপত্তাকর্মী, তিনি তা ঠেকাবেন কিভাবে!
সেই সময়েই বিশ্বে আধুনিক টেলার মেশিন এসে গেছে, যা স্কিমিং ঠেকাতে পারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। সেই কথা ব্যাংককে জানালে তারা বলেছিল, ‘অত দাম দিয়ে নতুন মেশিন বসাতে তারা প্রস্তুত নন। কারণ অনেক টাকা খরচ করে আগের মেশিনগুলো বসিয়েছেন।’ কি অসাধরণ যুক্তি! গ্রাহকের টাকা নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জমা রাখবেন, কিন্তু বাস্তবে রাখবেন অরক্ষিত।
গ্রাহক কি সচেতন? তারা কি এসব নিয়ে কখনও প্রশ্ন তুলেছেন? তারা কি ভেবে দেখেছেন, তার এটিএম কার্ডটি নিরাপদ রাখার দায়িত্ব তারও। তারা কি জানেন অনলাইন শপিং-এর মাধ্যমে তার কার্ডের সব তথ্য চুরি হয়ে যেতে পারে। অনলাইন হ্যাকিং নিয়ে একটি প্রতিবেদন করার সময় আমি তা দেখেছি। হ্যাকাররা আপনার কার্ড দিয়েই অনলাইন কেনাকাটা করবেন। আপনি যখন টের পাবেন, তখন আর হ্যাকারকে খুঁজে পাবেন না। আর এটা সম্ভব হয় কোনও কোনও অনলাইন শপ-এর কারণে।
যে কারও এটিম কার্ড স্ক্যান করা যায়। আর তা মুহূর্তের মধ্যেই সম্ভব। এমনকি কেউ কোনও কারণে ব্যাংকের কাউকে কার্ড দিলে তিনিও সেটা স্ক্যান করতে পারেন। এই স্ক্যানার মোবাইল ফোনে স্থাপন করা সম্ভব। তাই কাউকে দেখান বা কারও হাতে এটিএম কার্ড দেওয়া কোনওভাবেই নিরাপদ নয়।
বাংলাদেশে অনলাইন ব্যাংকিং নতুন এক গতিতে এগোচ্ছে। চেক বই-এর ব্যবহার বা ব্যাংকে যাওয়া ধীরে-ধীরে কমে আসছে। গ্রাহকদের সময় বাঁচছে। কিন্তু এরজন্য যে সতর্কতা সব পক্ষের প্রয়োজন, তা কিন্তু নেই।
এবার স্ক্যামিং ডিভাইস বসিয়ে শত শত গ্রাহকের তথ্য চুরির ঘটনা ঘটেছে। তাই এত আলোচনা হচ্ছে। গ্রাহকও এখন জানতে চাইছেন তার কার্ডটি নিরপদ কিনা। কিন্তু ব্যাংক যখন কার্ডটি দিয়েছে, তখন ব্যাংকের দায়িত্ব হলো এর রিস্কগুলো জানান। যার যিনি গ্রাহক হচ্ছেন তারও দায়িত্ব রিস্কগুলো জেনে নেওয়া। কিন্তু কেউই তা করেননি। ব্যাংকে একাউন্ট খুললেই একটি এটিমএম কার্ড ধরিয়ে দেওয়া হয়। আর গ্রাহকও যেন উপরি পাওনা হিসেবে একটি কার্ড নিয়ে আনন্দে বাড়ি ফেরেন।
আরও অনেক আগে কমপক্ষে একযুগ তো হবেই, বাংলাদেশে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির বেশ কয়েকটি ঘটনা ধরা পড়েছিল। তখন হাতেগোনা দুই-একটি ব্যাংক এই ক্রেডিট কার্ড চালু করে। তখন কয়েকজন প্রতারক ধরা পড়ার পর তারা ব্যাংকের সঙ্গে যোগসাজসের কথা জানিয়েছিল। সে পর্যন্ত আর কিছু হয়নি।
তবে, এবার ব্যাংক কর্মকর্তারা আটক হয়েছেন। আর ব্যাংক এখনও বলছে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার মানে হলো ব্যাংক এখনও দায় এড়ানোর মনোভাব নিয়েই আছে।
আমাদের দেশেই তো এটিএম জালিয়াত আছে। আছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তাও। তাহলে বিদেশি নগরিকরা কেন এবার যুক্ত হলো। আমাদের জালিয়াতদের ‘মেধায়’ কি ঘাটতি পড়েছে! আমার তা মনে হয় না। আমি যে কারণটি বের করেছি তা হলো বুথে ঢুকে জালিয়াতির কাজটি করতে সময় লাগে। আর ‘সাদা চামড়া’ হলে বেশি সময় নিলে হয়তো সন্দেহ এড়ানো যায়। সে কারণে আমাদের দেশি জালিয়াতরা ‘সাদাদের’ কাজে লাগিয়েছে।
এখন সিসিটিভি ফুটেজ বের হচ্ছে। তাদের তৎপরতা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু ফুটেজের যে মনিটরিং নেই তা কিন্তু স্পষ্ট। তবে এবার জালিয়াতরা টেকনিক্যাল কিছু ভুল করেছে। হাতের তৎপরতা সিসিটিভি’র আড়াল করতে পারেনি। বা বিষয়টি খেয়াল করতে পারেনি। সেই যুবক আমাকে জানিয়েছিল সিসিটিভিকে ফাঁকি দেওয়ার পথও নাকি আছে! তাহলে উপায়? উপায় প্রতারিত হতে না চওয়া।
এবার একটা মজার খবর দিয়ে শেষ করছি। রোমানিয়ার হ্যাকার ভ্যালেন্টিন বোনাটা ২০০৯ সালে এটিএম কার্ড স্কিমিং (জালিয়াতি)-এর অপরাধে আটক হন। ছয় মাস কারাভোগের পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ, তিনি কারগারে বসেই আবার এন্টি স্কিমিং ডিভাইস আবিষ্কার করেন। যার নাম সিকিউর রিভলভিং সিস্টেম(এসআরএস)। ভ্যালেন্টিন বোনাটা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তখন বলেছেন, ‘অপরাধ একটা নেশার মতো। তাই যারা এটা করেন, তারা একটার পর একটা নতুন পথ বের করেন। মজার ব্যাপার হলো, প্রতারকরা প্রতারণা করতে পারেন। কারণ কেউ কেউ প্রতারিত হতে চান।’
লেখক: সাংবাদিক