X
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২

অপপ্রচারের রাজনীতি মোকাবিলায় প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা

ড. প্রণব কুমার পাণ্ডে
২৫ জুলাই ২০২৩, ১৬:১০আপডেট : ২৫ জুলাই ২০২৩, ১৬:১০

একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বিরোধী দল রাজনৈতিক সরকারকে জবাবদিহি করতে এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, বাংলাদেশে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অপপ্রচারের মাধ্যমে সরকারকে হেয় করার চেষ্টায় বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকে। এই নিবন্ধটির মূল উদ্দেশ্য হলো অপ্রচারের কৌশল ব্যবহার করে বিরোধী দল কীভাবে সরকারকে বিব্রত করছে এবং তা জনসাধারণের ওপর কী প্রভাব ফেলছে সেই বিষয়ে আলোকপাত করা।

প্রপাগান্ডা বা অপপ্রচার বলতে ইচ্ছাকৃতভাবে পক্ষপাতমূলক বা বিভ্রান্তিকর তথ্য, ধারণা বা গুজব প্রচার করার মাধ্যমে জনমত প্রভাবিত করার প্রচেষ্টাকে বোঝানো হয়। যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের এজেন্ডাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগ কৌশল ব্যবহার করে, তবে অপপ্রচারের কৌশলগুলো রাজনৈতিক নৈতিকতা এবং অখণ্ডতা রক্ষার পরিপন্থি।

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপি বর্তমান সরকারকে জনগণ ও বহির্বিশ্বের সামনে হেয় করার জন্য অপপ্রচারের কৌশলকে অবলম্বন করছে বহুদিন ধরে। এরমধ্যে রয়েছে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো, তথ্য বিকৃত করা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর ব্যক্তিগত আক্রমণ করা। এই ধরনের কৌশল সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ন করে এবং গঠনমূলক সংলাপ ও সমঝোতাকে বাধাগ্রস্ত করে।

একটি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে অপপ্রচারের ব্যবহার শাসন এবং জনসাধারণের ধারণাকে গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রভাবিত করতে পারে।  প্রথমত, এটি জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস এবং নতুন মেরুকরণের পরিবেশ তৈরি করে, সরকারের নীতি বাস্তবায়নের ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এবং গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে বাধাগ্রস্ত করে। দ্বিতীয়ত, এটি গঠনমূলক বিতর্ক এবং সরকারি পদক্ষেপের সমালোচনামূলক আলোচনা থেকে জনগণের মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। উপরন্তু, এটি জনসাধারণের অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে সরকারের বিকৃত ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারে, যার ফলে নেতৃত্বের প্রতি আস্থা নষ্ট হতে পারে।

দায়িত্বশীল রাজনৈতিক বক্তব্য গণতন্ত্রের সুস্থ কার্যক্রমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে গঠনমূলক বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে হবে, প্রমাণভিত্তিক যুক্তি উপস্থাপন করতে হবে এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং মিথ্যা ছড়ানোর পরিবর্তে নীতিগত বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দায়িত্ব জনগণকে মর্যাদা দেওয়া, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখা এবং দলীয় স্বার্থের চেয়ে জাতির মঙ্গলকে প্রাধান্য দেওয়া।

রাজনৈতিক অখণ্ডতা নিশ্চিত করতে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা করার জন্য, রাজনৈতিক দল, মিডিয়া এবং নাগরিকসহ স্টেকহোল্ডারদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা উচিত। স্বাধীন মিডিয়া যেকোনও তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে পারে এবং ভুল তথ্য ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এমনকি নাগরিকদের উচিত যেকোনও তথ্যের সমালোচনামূলক ভোক্তা হওয়া, যাতে একাধিক উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তাদের সত্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে কোনও বিষয়ে মতামত গঠন করা যায়।

বিরোধী রাজনৈতিক অপপ্রচার কৌশল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করার মাধ্যমে কার্যকর শাসনব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং জনসাধারণের ধারণাকে বিকৃত করতে পারে। রাজনৈতিক নেতাদের অবশ্যই দায়িত্বশীল রাজনৈতিক আচরণকে অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং ভুল তথ্য ছড়ানোর পরিবর্তে নীতিগত বিষয়গুলোতে মনোযোগ দিতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে এবং বস্তুনিষ্ঠ এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার গুরুত্ব প্রচার করার জন্য বাংলাদেশে এমন একটি রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, যা গঠনমূলক বিতর্ক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকে উৎসাহিত করে।

বিরোধী দলগুলোর অপপ্রচারের কৌশল মোকাবিলায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আওয়ামী লীগকে অবশ্যই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কার্যকর যোগাযোগ কৌশল অবলম্বন এবং জনগণের কাছে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করতে হবে। সরকারি উদ্যোগ, নীতি এবং কৃতিত্বগুলোকে জনগণের সামনে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। এর জন্য মিডিয়াকে ব্যবহার করা, পাবলিক বক্তৃতার আয়োজন করা এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা যেতে পারে। পরিষ্কার এবং সংক্ষিপ্ত তথ্য মিথ্যাকে উড়িয়ে দিতে এবং জনসাধারণের কাছে একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করতে সহায়তা করতে পারে।

তথ্য কার্যকরভাবে যাচাই করার জন্য এবং বিরোধী দলের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আওয়ামী লীগের ডেডিকেটেড টিম গঠন করা উচিত, যারা স্বাধীন ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থাগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার মাধ্যমে এই কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই ক্ষেত্রে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) যে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তা প্রশংসার দাবি রাখে। তবে এর সাংগঠনিক ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আরও পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, যাতে বিরোধীদের মিথ্যা তথ্যকে মোকাবিলা করার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ জনসাধারণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য উপস্থাপন করতে পারে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরি।

ক্ষমতাসীন দল জনগণের সামনে গত ১৫ বছরের উন্নয়নের চিত্র উপস্থাপনের জন্য বিভিন্ন উন্নয়ন উদ্যোগ এবং সাফল্যের গল্পগুলোকে উপস্থাপনের ওপর জোর দিতে পারে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার মতো ক্ষেত্রগুলোতে সরকারি কর্মসূচির ইতিবাচক প্রভাব জনগণের সামনে তুলে ধরে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের নেতিবাচক বক্তব্যগুলো মোকাবিলা করতে পারে।

ক্ষমতাসীন দল সক্রিয়ভাবে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে পারে এবং বিভিন্ন মাধ্যম, যেমন- উঠান বৈঠক, পরামর্শ সভা এবং তৃণমূল উদ্যোগের মাধ্যমে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে পারে। জনগণের কণ্ঠস্বর শোনার জন্য প্ল্যাটফর্ম প্রদান করা এবং তাদের সমস্যার সমাধান করার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল জাতির গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী এবং অপপ্রচারের প্রভাব মোকাবিলা করতে পারে।

ক্ষমতাসীন দলের পাশাপাশি বর্তমান সরকারকে সমর্থনকারী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমুন্নত শিক্ষাবিদরা বিরোধী দলের অপপ্রচারের রাজনীতি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শিক্ষাবিদগণ তাদের দক্ষতা এবং জ্ঞান ব্যবহার করে যুক্তিযুক্ত এবং প্রমাণভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করার মাধ্যমে ভুল তথ্য এবং বিকৃতিকে উড়িয়ে দিতে পারে। শিক্ষাবিদগণ গবেষণা, বিশ্লেষণমূলক আলোচনা এবং পাবলিক ডিসকোর্সে জড়িত থাকার মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে সঠিক তথ্য এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা প্রচার করতে পারে। সরকারের নীতি ও উদ্যোগের নিরপেক্ষ মূল্যায়ন জনমত গঠনে এবং বিরোধীদের বিভ্রান্তিকর তথ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। তাছাড়া, অ্যাকাডেমিক সততা নিশ্চিতের মাধ্যমে উপস্থাপিত তথ্য সরকারের কর্ম এবং নীতির বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে পারে, যা সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসকে শক্তিশালী করতে পারে। বুদ্ধিবৃত্তিক অবদানের মাধ্যমে শিক্ষাবিদগণ সরকারের জন্য মূল্যবান সম্পদ হিসেবে কাজ করতে পারে।

অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার দায়িত্ব শুধু সরকার বা সরকারি দলের নয়। নাগরিকদেরও একই রকম দায়িত্ব রয়েছে। নাগরিকদের অবশ্যই সমালোচনামূলক মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে, তথ্যের বিভিন্ন উৎস সন্ধান করতে হবে এবং বিভিন্ন ধরনের আলোচনায় জড়িত হতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে, নাগরিকরা সরকারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারে, রাজনৈতিক দলগুলোকে জবাবদিহি করতে পারে এবং শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রে অবদান রাখতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, বিরোধী রাজনৈতিক দলের অপপ্রচারের কৌশল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করে এবং গঠনমূলক সংলাপকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। দায়িত্বশীল রাজনৈতিক কার্যক্রম, সঠিক তথ্যের উপস্থাপনা এবং নীতিগত বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। ফলে, বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দায়িত্বশীল অংশগ্রহণকারী হিসেবে তাদের ভূমিকা পালন করতে হবে। অপপ্রচারের কৌশলের ওপর নির্ভর না করে, তাদের উচিত বিকল্প নীতি প্রস্তাব করা, সারগর্ভ বিতর্কে লিপ্ত হওয়া এবং প্রমাণভিত্তিক যুক্তি উপস্থাপন করা। এটি করার মাধ্যমে, তারা একটি সুস্থ ও প্রাণবন্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে পারে। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন দলের উচিত বিরোধীদের অপপ্রচারের রাজনীতি মোকাবিলায় বেশি জোর দেওয়া। আর এর মাধ্যমেই ক্ষমতাসীন দল বিরোধীদের অপপ্রচারের প্রভাব কমিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে পারে।

লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পল্টন মোড়ে নুরুল হকের নেতৃত্বে অবস্থান
পল্টন মোড়ে নুরুল হকের নেতৃত্বে অবস্থান
বিএনপি নেতার বাড়ি থেকে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা গ্রেফতার
বিএনপি নেতার বাড়ি থেকে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা গ্রেফতার
কার্টার সেন্টারের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মির্জা ফখরুলের বৈঠক
কার্টার সেন্টারের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মির্জা ফখরুলের বৈঠক
উদ্বিগ্ন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের ভারত ছেড়ে দেশে ফেরার তোড়জোড়
উদ্বিগ্ন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের ভারত ছেড়ে দেশে ফেরার তোড়জোড়
সর্বশেষসর্বাধিক