X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

রুচির শ্রেণিভেদ নাকি শ্রেণি প্রভাবিত বর্ণবাদ?

আহসান কবির
২৮ জুলাই ২০২৩, ১৯:০৭আপডেট : ২৮ জুলাই ২০২৩, ১৯:০৭

পুরোনো ঘটনা বয়ান করে শুরু করি। কারণ, আজও সেই পুরোনো ‘ট্রেন্ড’ থেকে হয়তো বের হতে পারিনি। গান না শুনলে আমার চলে না। দিন পার হলেও রাত পার হয় না। ঘুমের অনুষঙ্গ হচ্ছে গান আর বই। দুটো অভ্যাস বহুকাল ধরে আমার ঘুম ডেকে আনে। মনে মনে ভাবতাম, একদিন এভাবেই চিরঘুমের দেশে চলে যাবো। একদিন সেই নিয়মে চিড় ধরলো। কয়েক দিন ধরে ঘুম কমলো, প্রেসার বাড়লো। ফলাফল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া। হাসপাতালের এক চিকিৎসক আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রেসার ও ঘুমের ওষুধ দিলেন তিনি। বললাম বই ও গান ছাড়া আমার যে ঘুম আসে না সারা বেলা? ডাক্তার বন্ধু হাসতে হাসতে বললেন– ওকে। তাহলে সকাল আর রাতে ‘হিরো আলম দুই বেলা’! আর দুপুর বেলাতে ডক্টর মাহফুজ সাহেবের গানও শুনতে পারেন!

ডাক্তার সাহেবের পরামর্শ কি নিছক ফান নাকি অন্য কিছু? সবাই নাকি বড় না, কেউ কেউ বড়! আবার এটাও শুনেছি– কেউ আসলে বড় না, কাউকে কাউকে বড়’র মতো দেখায়। মানুষকে ছোট করার ভেতর কি অন্য রকম কোনও আনন্দ আছে? ‘ট্রল’ করা কি এখন আধুনিকতা? নাকি মানুষকে ছোট করাও এক ধরনের বর্ণবাদ?

কলেজ জীবনে এক শিক্ষক বলেছিলেন– বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে গিয়ে বর্ণবাদী হয়ে যায় সবাই! মেয়ে কালো না ফর্সা সেই বিচার চলে আসে!

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিচারক বা বিচারপতিরা আছেন, অপরাধীদের গ্রেফতার করার জন্য আছে পুলিশ। কাব্য করে বলা হয়– মানুষের বিবেক সবচেয়ে বড় বিচারক। দর্শক নাকি সিনেমার বিচারক। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গড়ে উঠেছে আরেক ধরনের বিচারক। এরা সব কিছুর বিচার করতে চায় ‘জাজমেন্টাল’ হয়ে। সব কিছুতেই আপনারা যেমন এই বিচারকদের পাবেন তেমনি পাবেন ঘটনার পক্ষ বিপক্ষকে। এই লেখার আদল তাহলে কী? পক্ষ-বিপক্ষের প্রতিপক্ষ? কয়েকটা বাস্তবতা তুলে ধরা যাক–

এক.

এরশাদ আমলে এই কৌতুক ছড়িয়ে পড়েছিল। জাতিসংঘের এক অধিবেশনে এক পাগল ঢুকে পড়েছে। কেউ তাড়াতে পারছে না। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট গর্বাচেভ এগিয়ে গেলেন। পাগল উল্টো তাকে ধাওয়া দিলো। এটা দেখে বীরদর্পে এগিয়ে গেলেন আমেরিকার জর্জ বুশ। পাগল লাঠি নিয়ে তার দিকে তেড়ে এলো। এরপর গেলেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এরশাদ। পাগলের কানে কানে কী যেন বললেন। পাগল দৌড়ে পালালো। সবাই জানতে চাইলো এরশাদ পাগলকে কী এমন বলেছিলেন?

এরশাদ বললেন– পাগলকে আমার একটা কবিতা শোনাতে চেয়েছিলাম। 

যাহোক এরশাদ সাহেব কবিতা লিখতেন, ক্ষমতায় থাকাকালে তার কবিতা ছাপা হতো দৈনিক বা সাপ্তাহিকের প্রথম পাতায়। বই বেরিয়েছিল, যার নাম ‘কনক প্রদীপ জ্বালো’। জেলে যাওয়ার পর কবিতা হয়তো আর এরশাদ সাহেবের সাথে থাকেনি। এরশাদের শাসনকাল কিংবা তার কবিতা কতটা মনে রাখা হবে তার দায়িত্ব মহাকালের কাছেই থাকুক।

সত্য এই যে মানুষ চায়নি বিধায় এরশাদকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল!

দুই.

কিছু দিন হলো এরশাদ সাহেবের ঘটনার মতো আরেকটা কৌতুক ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশ এক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরে এনে ‘মৃদু’ পিটুনি দিয়েছে। হাজতখানায় শীর্ষ সন্ত্রাসী পিটুনি খাওয়ার ‘আফটার ইফেক্ট’ হিসেবে ‘আহ উহু’ করছে। তার শিষ্যরা তার গা হাত পা টিপে দিচ্ছে। এমন সময় সেখানে দেশের এক গায়ক (?)-কে আনা হলো। তিনিও গ্রেফতার হয়েছেন। হাজতখানায় চেয়ার দেওয়া হলে তিনি বসলেন। গায়ক ও ব্যবসায়ী মন খারাপ করে বসেছিলেন। হাজতখানায় সন্ত্রাসীর কষ্ট দেখে তিনি বললেন– দেশব্যাপী গান গাওয়ার জন্য আমার অনেক সুনাম আছে। আপনাকে একটা গান শোনাই? গায়ক কাম ব্যবসায়ীকে চিনে ফেলার পর শীর্ষ সন্ত্রাসী চিৎকার করে পুলিশ ডেকে বললো– “ভাই প্রয়োজনে আমারে আবারও ‘বাঁশডলা’ দেন। দয়া কইরা এনার গান শোনার শাস্তি আমারে দিয়েন না”!

হিন্দি ছবির গোটা তিন নায়ক, যারা মূলত ব্যবসায়ী ছিলেন, টাকা দিয়ে ছবি বানাতেন, ছবি আলোচনাতেও আসতো! শেষমেশ নায়কোচিত গুণাবলি না থাকার কারণে তারা টিকে থাকতে পারেননি। এ দেশেও ‘অনন্ত’ নামের নায়ক আছেন, যাকে দিয়ে ‘অসম্ভবকে সম্ভব’ করাতে চেয়েছে কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান। তিনিও নিজেও নতুন নতুন ছবি নিয়ে মাঝে মাঝে হাজির হন। ফলাফল?

মহাকালের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না? যদি নক্ষত্রেরও চলে যেতে হয় তবে যারা ভূত বা দৈত্য হয়ে কাঁধে চেপে বসে তাদেরও নেমে যেতে হবে একদিন।

তিন.

এবার খানিক সিরিয়াস পর্যায়ে যাওয়া যাক।

ইউরোপ আমেরিকার মানুষরা নাকি কমেডিয়ান খুব পছন্দ করে। রাশিয়ার বিপরীতে তারা ইউক্রেনের কমেডিয়ান কাম প্রেসিডেন্ট জেলেনোস্কিকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছে।

২০২৩-এর ১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের পর আমেরিকা ও জাতিসংঘের কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে তারা বাংলাদেশের হিরো আলমকেও খুব পছন্দ করেছে। ইউরোপ আমেরিকার মানুষরা কি হাসতে হাসতে সবসময় মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতে চায়? কয়েক শতাব্দী ধরে বর্ণবাদের স্রষ্টা কারা?

কমেডিয়ানরা চিরকালই মানুষের ভালোবাসা পেয়ে এসেছে। চার্লি চ্যাপলিন হোক আর জেলেনেস্কি হোক, টেলিসামাদ, দিলদার কিংবা জনি লিভার হোক, দর্শকের ভালোবাসা কি সবার জন্য সমান?  সবখানে নাকি শ্রেণিবিভাগ আছে। যেমন, বলা হয়ে থাকে– ‘ক্লাসিক্যাল সং ইজ অনলি ফর ক্লাস পিপল’। ক্লাসিক্যাল বা ধ্রুপদি গান নাকি রাজরাজড়াদের। গরিবের গান নাকি লোকসংগীত বা বাউল গান। তাহলে ব্যান্ড সংগীত কাদের? তেমনি চার্লি চ্যাপলিনের যে শ্রেণি বা স্ট্যান্ডার্ড, কমেডিয়ান কাম প্রেসিডেন্ট জেলেনোস্কির শ্রেণি কি এক? ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচন অংশ নিয়ে হেরে যাওয়া ও পিটুনি খাওয়া আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমের অবস্থান বা শ্রেণি তাহলে কোনটা? তাকে অবজ্ঞা করা কি এক ধরনের জাতে ওঠার চেষ্টা? হিরো আলম রবীন্দ্রসংগীত গাইলে পুলিশ তাকে ডেকে শাসিয়ে দেয়। কিন্তু যিনি নিজের টাকায় ছবি বানান বা নায়ক হন, যিনি নিজের টেলিভিশনে ঘটা করে গান করেন, তাদের বেলা? এই নায়ক বা গায়কদের অবস্থান বা শ্রেণি কোনটা? আচ্ছা কারা এই অবস্থান বা শ্রেণি নির্ণয় করেন? তারা কারা? কী তাদের যোগ্যতা?

‘তৃণমূল’ বলে একটা কাব্যময় শব্দ আছে। ভারতের ঐতিহ্যবাহী দল কংগ্রেস ভেঙে পশ্চিমবঙ্গে একদা ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ হয়েছিল। এ দেশে যারা তৃণমূল থেকে নেতৃত্বে উঠে আসে তাদের কি ভিন্ন চোখে দেখা হয়? কারা এভাবে উঠে এসেছেন তাদের কোনও তালিকা আছে? উঠে আসা মানুষেরা কি শেষমেশ তৃণমূল বা প্রান্তিক মানুষের জন্য থাকেন, নাকি নেতা হওয়ার পর তাদের শ্রেণি বদল হয়? বইতে পড়েছি– মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে অকারণে বদলায়! হিরো আলম যদি রুচির দুর্ভিক্ষের প্রতীক হয়ে থাকেন তাহলে এই দুর্ভিক্ষ তালিকায় আর কারও নাম নেই? যদি থাকে তাহলে খুব জানতে ইচ্ছে করে তারা কারা? নাকি শ্রদ্ধেয় লেখক হুমায়ুন আজাদের কথাটাও মনে রাখতে হবে– গরিবের অনেক কিছুই হয় তো খারাপ, কিন্তু তাদের মানায় ভালো যখন তারা প্রতিবাদ করে।

গণঅধিকার পরিষদের নেতা নুরুল হক নুর কিংবা স্বতন্ত্র হিরো আলম কি কোনও প্রতিবাদের নাম? আওয়ামী লীগবিরোধী যেকোনও আন্দোলনে বিএনপি, জামায়াত কিংবা বাম দলগুলোর তুলনায় এদের শ্রেণি বা অবস্থান কোথায়? শুধু জনগণই কি এদের শ্রেণি বা অবস্থান তৈরি করে দেয়? নাকি এদের প্রতি নাক সিটকানোও এক ধরনের বর্ণবাদ? মানুষকে ছোট করার জন্য ব্যঙ্গ বা ট্রল করা কি কোনও নতুন রোগের উপসর্গ? নাকি এসবও মহাকালের হাতে ছেড়ে দেওয়া ভালো? যদি তাই হয় তাহলে নতুন আর পুরোনো গল্প শুনে বিদায় নেই। কৌতুক আসলে শ্রেণিহীন! যে কৌতুকটা শোনেনি তার কাছে নতুন আর যে শুনেছে তার কাছে পুরোনো। কৌতুকের সমস্যা অন্য জায়গায়। এইটিন প্লাস হলে সেই কৌতুক সব জায়গায় বলা যায় না, কিন্তু সেসবই ‘হিট’ বা ‘ভাইরাল’ হয়।

এক.

ফাঁসির আসামির শেষ ইচ্ছা হিসেবেও অনেক গল্প প্রচলিত আছে। নতুন গল্পটা এমন, দু’জন আসামির ফাঁসি হবে। জেলার প্রথম ফাঁসির আসামির কাছে জানতে চাইলেন– আপনার শেষ ইচ্ছা কী বলুন। প্রথম আসামি কান্নাকাতর হয়ে বললো– আমি হিরো আলমের কাছ থেকে রবীন্দ্রসংগীত শিখে বাংলাদেশের ‘ছায়ানট’ ও  ‘বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এর এক্সপার্টদের কাছে পরীক্ষা দিতে চাই। উত্তীর্ণ হবার পরেই আমি ফাঁসির রশিতে ঝুলবো।

জেলার অবাক! তিনি দ্বিতীয় ফাঁসির আসামির কাছে জানতে চাইলেন– আপনার শেষ ইচ্ছাটা কী? দ্বিতীয় আসামি প্রথম আসামিকে দেখিয়ে বললো- ওনার গান শেখা শেষ হলে আমি ওনার কাছ থেকেই গান শিখতে চাই! সংগীতের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি নিতে ডক্টর মাহফুজের কাছে যাবো। এরপর না হয় আমাকে ঝুলায়ে দিয়েন!

দুই.

এক লোক মদ খেতে বারে আসে বড় এক ছবি নিয়ে। প্রথমে সে টেবিলের পাশের দেয়ালে ছবিটা টানায়। তারপর মদ্যপান শুরু করে। কারও সাথে কথা বলে না, ডিসটার্ব করে না। তো একদিন বারের মালিক ঘোষণা দিলেন একজনকে তিনি শান্তি ও নীরবতার পুরস্কার দিতে চান। তিনি ভদ্রলোকের নাম ঘোষণা করলেন। ভদ্রলোক দেয়ালের ছবি খুলে পুরস্কার নিতে এলেন। পুরস্কার নেওয়ার পর তাকে প্রশ্ন করা হলো, আপনি এক রাজনীতিবিদের ছবি নিয়ে মদ খেতে আসেন কেন?

ভদ্রলোক প্রথমবারের মতো নীরবতা ভেঙে বললেন– একসাথে দশ পনের বছর ঘর করলে বউকেই ভালো লাগে না। আর উনি তো রাজনীতিবিদ। মদ খেতে খেতে যখন ওনাকে ভালো লাগা শুরু করে তখনই ভাবী আমার নেশা হয়েছে। এখন বউয়ের কাছেই ফিরে যাওয়া ভালো। আপনাদের এই শান্তি ও নীরবতার পুরস্কার আমি আমার বউয়ের হাতে তুলে দিয়ে বলবো– দিনের বেশিরভাগ সময়ে আলাদা ও একা একা থাকার ফসল এই পুরস্কার। এটা ধরো। এই পুরস্কার তোমার জন্যই পেয়েছি!

নীরবতা পালন করুন, শান্তিতে থাকুন, পুরস্কার জিতুন।

লেখক: রম্যলেখক

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ