X
শনিবার, ১৮ মে ২০২৪
৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

কাজী শাহেদ আহমেদ: একজনই ছিলেন

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
৩১ আগস্ট ২০২৩, ১৬:২৯আপডেট : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৯:৪২

কাজী শাহেদ আহমেদের সঙ্গে আমার পরিচয় গত শতকের আশির দশকের শেষ দিকে, তখন তাঁর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ‘খবরের কাগজ’ বেরুচ্ছে। দিন তারিখ মনে নেই, কিন্তু প্রথম সাক্ষাৎটা মনে আছে। মহিলা সমিতির মঞ্চে একটা নাটক চলছিল, সেটা দেখতে গিয়ে কিছু প্রিয় মানুষকে মিলনায়তনের বাইরে আড্ডা মারতে দেখে এগিয়ে যাই। মমতাজউদদীন আহমদ, মামুনুর রশীদ, কেরামত মওলার কথা মনে আছে, তাদের সঙ্গে আরও দু-একজন ছিলেন। তাঁরা কথা বলছিলেন এক সৌম্যদর্শন, হাসিখুশি মানুষের সঙ্গে। আমাকে বলা হলো ইনি কাজী শাহেদ আহমেদ, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক এবং ‘খবরের কাগজ’-এর সম্পাদক। তাঁর সঙ্গে পরিচয় ও কুশল বিনিময় হলো, তিনি আমাকে বললেন তাঁর অফিসে যেতে। শিঙাড়া খাবো, ফুচকা খাব, চা খাবো, আর গল্প করবো,’ তিনি বললেন এবং জানালেন, তিনি সাহসী লেখা পেলে সর্বাগ্রে ছাপান। তারপর তিনি চলে গেলেন। হয়তো কাউকে নামিয়ে দিতে এসেছিলেন।

সেদিনের পরিচয় ধীরে ধীরে আরও গভীর হয়েছে, তাঁর নানান কাজের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, তাঁর অনেক স্বপ্নকে বাস্তব হতেও দেখেছি। কিন্তু সেদিন যে ধারণা আমার হয়েছিল তাঁর সম্পর্কে তার আর নড়চড় তেমন হয়নি—তাঁকে মনে হয়েছিল আন্তরিক একজন মানুষ, যার অনেক পরিচয়ের প্রতিটিই জোর দিয়ে বলার মতো, অথচ নিজ থেকে তিনি আলোর নিচে পা ফেলতে রাজি নন।

যে সহজ আমন্ত্রণটি তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, যাতে কী কী খাবো তার একটা তালিকাও তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, তারও কোনও বদল হয়নি। তাঁর বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্রে তিনি সহজ ভাষায় জানাতেন কোন মাছ অথবা কোন ধরনের ডাল এবং ভর্তা সেদিন মেনুতে থাকবে।

কাজী শাহেদ মানুষকে আপন করতে জানতেন। শুরুতে তাঁর সাংবাদিক পরিচয়টাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল আমার কাছে। তাঁর ব্যবসায়িক পরিচয় আমাকে টানেনি, যেহেতু ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ে আমি অজ্ঞ। কিন্তু পরে বুঝেছি, ব্যবসা বিস্তৃতি লাভ করেছে তাঁর উদ্যোক্তা-ব্যক্তিত্বের হাত ধরে। অর্থাৎ তিনি ব্যবসা করেননি, ব্যবসা সৃষ্টি করেছেন; অন্যেরা যেখানে ব্যবসা করছেন, তা না করে তিনি ব্যবসার নতুন পথ সৃষ্টি করেছেন। যেমন, অর্গানিক চা এবং অন্যান্য অর্গানিক সামগ্রীর ব্যবসা।

কাজী শাহেদ যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানে সফল হয়েছেন; কারণ, তাঁর পা থাকতো বাস্তবের মাটিতে, কল্পনা দূরবর্তী হলেও। যাকে আধুনিক ব্যবস্থাপনা বলে, তা তিনি আয়ত্ত করেছিলেন তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতায়। তাঁর এক বক্তৃতায় একদিন তিনি নবীন কিছু শিক্ষার্থীকে বলেছিলেন, ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে ভেবো না ঘুড়িটাই আকাশচারী। তাকে আকাশচারী করেছে নাটাই। সুতাটা কেটে গেলে ঘুড়ি অবশ্যই ভেসে বেড়ায়, কিন্তু সেই ভেসে বেড়ানোর অন্তে আছে ভূমিতে পতন।

কালক্রমে আমি জেনেছিলাম, কাজী শাহেদ আহমেদ সেনাবাহিনীতে ছিলেন, প্রকৌশল বিদ্যায় শিক্ষিত ছিলেন, খেলাধুলায় উৎসাহী ছিলেন। একসময় দেখলাম তিনি আত্মজীবনীকার এবং অনেক বয়সে ঔপন্যাসিক। তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনের শিলালিপি’ বাংলায় পড়া হয়নি, কিন্তু পড়েছি ইংরেজিতে, আরিফা গনি রহমানের ইংরেজি অনুবাদে। আর পড়েছি ‘ভৈরব’ এবং ‘অপেক্ষা’, তাঁর দুই উপন্যাস। ‘ভৈরব’ পাঠকপ্রিয় হয়েছে গল্পের বুনোট, বর্ণনা আর ভাষার স্বাচ্ছন্দ্যের কারণে, চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠার কারণে, তাদের সূক্ষ্ম রসবোধের কারণে।

একসময় দেখলাম, কাজী শাহেদ আহমেদ—ততদিনে তাঁকে শাহেদ ভাই ডাকায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি—যখনই তাঁর বাড়িতে কোনও আড্ডায় কাউকে নিমন্ত্রণ করেন, তিনি তা রক্ষা না করে পারেন না। আড্ডায় তাঁর রসজ্ঞ আলাপ মানুষকে টানতো। তাঁর ছিল সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ, আর পরিশীলিত মেজাজে, প্রসন্ন মুখে, হাসিটা ধরে রেখে, অনেক স্পষ্ট কথা সহজে বলে ফেলার ক্ষমতা। সেনাবাহিনী তাঁকে শৃঙ্খলা শিখিয়েছিল, আত্মনিয়ন্ত্রণ শিখিয়েছিল এবং মানুষের সাথে মেশার ক্ষমতা তাঁকে সহজ হতে শিখিয়েছিল। তিনি বয়োজ্যেষ্ঠদের যেমন প্রিয় ছিলেন, তরুণদেরও তেমনি। যাকে বলে সকল ঋতুর মানুষ, তিনি তা-ই ছিলেন।

শাহেদ ভাই আমাকে ‘আজকের কাগজ’-এ লেখার অনুরোধ জানালেন, যখন তিনি এর প্রকাশকের পাশাপাশি সম্পাদনার দায়িত্বও নিলেন। তাঁর অনুরোধ না রাখা সম্ভব ছিল না। তবে তাঁর চাওয়া ছিল একটাই—সত্যকে সাহসের সঙ্গে তুলে ধরতে হবে অকারণ শব্দ খরচ না করে। ‘খবরের কাগজ’ থেকেই দেখেছি, কাজী শাহেদ কীভাবে সাংবাদিকতাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছেন। বস্তুনিষ্ঠতাকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন, কিন্তু ইতিহাসের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছেন, সংস্কৃতিকে মননশীলতাকে উৎকর্ষের ভিত্তি বলে ধরে নিয়েছেন। এজন্য ‘আজকের কাগজ’ তার ঘোষণায় মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শগুলোর প্রতি বিশ্বস্ত থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা ২০০৭ সালে এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অবিচল ছিল। এই পত্রিকাটিকে সরকারের এবং নানান মহলের রোষানলে পড়তে হয়েছে, এর অফিসে বোমা ফাটানো হয়েছে, অসংখ্য মামলা হয়েছে এর বিরুদ্ধে, কিন্তু সম্পাদকীয় নীতিতে কাজী শাহেদ ও তাঁর পত্রিকা অবিচল থেকেছে।

১৯৯৪ সালে ‘আজকের কাগজ’ পত্রিকাটি কেন জনপ্রিয় তা নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। ততদিনে এর অভিঘাত সবখানেই অনুভূত হচ্ছে। সবাই সকালে উঠে এটি পড়েন, ভাবেন, নানান বিষয় নিয়ে সক্রিয় হন—যাদের সক্রিয়তা শুধু নিজেকে নিয়ে নয়, সমাজকে নিয়েও। আমি লিখেছিলাম কীভাবে প্রতিটি শ্রেণিপেশার মানুষের চিন্তাভাবনাকে পত্রিকাটি তুলে ধরে, তাদের মতামত প্রতিফলিত করে, কীভাবে এর সম্পাদকীয় প্রতিদিন মানুষের চিন্তার ও সক্রিয়তার খোরাক জোগায়। আমার বিবেচনায় ‘আজকের কাগজ’ কলাম লেখার শৈলী ও পরিবেশনাটিই বদলে দিয়েছে। কত দৃষ্টিকোণ থেকে একটা বিষয় দেখা যায়, তা এই পত্রিকাটি আমাদের দেখিয়েছে।

শাহেদ ভাই তাঁর সকল সংবাদকর্মীকে স্বাধীনতা দিতেন, তাদের পাশে দাঁড়াতেন। বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় তিনি একটা বড় পরিবর্তন এনেছিলেন।

কাজী শাহেদ আহমেদ যখন সিদ্ধান্ত নিলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবেন এবং আমাকে তিনি ডাকলেন তাঁর সঙ্গে যুক্ত হতে, আমি সানন্দে সাড়া দিলাম। কারণ, আমি জানতাম তিনি লিবারেল আর্টসকে শিক্ষার একটি বড় ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রকোষ্ঠবদ্ধ বিশেষজ্ঞতা যদি উদার মানবিক পাঠগুলো এড়িয়ে যায়, তাহলে তা সমাজের তেমন উপকারে আসে না। এখন প্রযুক্তি ও দৃশ্যমাধ্যম শাসিত যুগে উদার মানবিকতার প্রয়োজন আমরা উপলব্ধি করি, কিন্তু এই শতাব্দীর শুরুতে, যখন ইন্টারনেট আমাদের দেশে আত্মপ্রকাশ করেছে মাত্র, শাহেদ ভাই বুঝেছিলেন, শিক্ষাকে সমাজের কাজে লাগাতে তাঁর উদ্যোগটি ফলদায়ক হবে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস ছোট পরিসরে এবং সীমিত সাধ্যেও তাঁর চিন্তাচেতনাগুলো ধারণ করে এগোচ্ছে।

কাজী শাহেদ আহমেদের অনেক পরিচয় আছে, কিন্তু আমার কাছে তাঁর তিনটি পরিচয় বড় হয়ে দেখা দেয়। কারণ, এ তিন পরিচয়ে আমি তাঁর সক্রিয়তা দেখেছি—একজন সাংবাদিক, একজন লেখক এবং একজন শিক্ষা-উদ্যোক্তা। আমি নিশ্চিত, অন্য অনেকের কাছে তাঁর অন্য পরিচয়গুলোও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ।

তাঁকে আমার শ্রদ্ধা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ

/এমএইচ/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
কতটা এগোলো সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ক স্থাপনে মার্কিন উদ্যোগ?
কতটা এগোলো সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ক স্থাপনে মার্কিন উদ্যোগ?
হিউস্টনের ঝড়ে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সিরিজ নিয়ে শঙ্কা!
হিউস্টনের ঝড়ে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সিরিজ নিয়ে শঙ্কা!
অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ার সময় মিয়ানমারের নাগরিকসহ আটক ৪
অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ার সময় মিয়ানমারের নাগরিকসহ আটক ৪
সর্বশেষসর্বাধিক