X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

ইলিশ এবং মধ্যবিত্তের অসহায় জীবন

রেজানুর রহমান
০৩ অক্টোবর ২০২৩, ১৭:৩৫আপডেট : ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ১৮:১০

কয়েক বছরর আগেও পাঁচশ’ টাকার একটি নোটের অনেক কদর ছিল। পাঁচশ টাকায় ব্যাগভর্তি বাজার করা যেত। আর এখন এক হাজার টাকার নোটেরও সেই কদর নাই। যতক্ষণ নোটটা পকেটে থাকে ততক্ষণই মনে শান্তি। নোটটা ভাঙালেই অর্থাৎ কাঁচাবাজার করতে গেলেই নিমিষেই হাওয়া হয়ে যায়। উচ্চবিত্ত যারা তাদের জন্য এটা কোনও বিষয়ই নয়। আবার নিম্নবিত্ত যারা তারাও এ বিষয়ে শঙ্কিত নয়। কারণ উচ্চবিত্ত সাহায্য দেয়। নিম্নবিত্ত এই আর্থিক সাহায্যকে অধিকার হিসেবে গ্রহণ করে। মাঝখানে ‘শাঁখের করাত’ অবস্থা মধ্যবিত্তের। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী পড়েছে মহাবিপাকে। গেরস্থালিসহ খাদ্যপণ্যের মূল্য এতটাই বেড়েছে যে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস অবস্থা। এরা কাউকে কিছু বলতে পারছে না। আবার সংসারের আর্থিক কষ্ট সইতেও পারছে না। বাজারে গেলে এরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে। প্রতিদিনের বাজার কাটছাঁট করে। এক কেজির বদলে হাফ কেজি নেয়। কেউ কেউ আড়াইশ গ্রামের মধ্যেই হিসাবে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তাতেও স্বস্তি নেই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে চতুর, সুবিধাভোগী দোকানদার আড়াইশ গ্রাম পণ্য বিক্রি করতে চায় না। মোহাম্মদপুর টাউন হলের বাজারে একজন লোক আড়াইশ গ্রাম পটল কিনবেন বলে দোকানির সামনে ময়লা পুরনো ব্যাগ এগিয়ে দিলেন। দোকানি যারপরনাই বিরক্ত হলেন। আড়াইশ গ্রাম পটল বিক্রি হবে না। নিলে কমপক্ষে ৫০০ গ্রাম নিতে হবে। এই নিয়ে শুরু হয়ে গেলো তুমুল তর্ক। বিক্রেতার একটাই কথা, ৫০০ গ্রামের নিচে কোনও সবজি বিক্রি হবে না। ক্রেতা নাছোড়বান্দা। তাকে আড়াইশ গ্রামই দিতে হবে। পাশে দাঁড়ানো অনেকেই অসহায় এই ক্রেতার পক্ষেই দাঁড়ালেন। শেষমেশ বিরক্ত চেহারায় আড়াইশ গ্রাম পটল দিতে বাধ্য হলেন বিক্রেতা। ক্রেতার অসহায় মুখে স্বস্তির হাসি। যাক, আজ তাহলে বাসায় পটল ভাজির উৎসব হবে।

মাছের রাজা ইলিশ। খুব কি বেশি দিনের কথা, যখন ইলিশ উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্তের হেঁসেলেও সমান আনন্দ ছড়াতো? আজ ইলিশ রান্না হবে। হেঁসেলের এই বার্তা কী যে আনন্দ আর খুশি ছড়িয়ে দিত মধ্যবিত্ত পরিবারের সব সদস্যের মাঝে। অথচ মধ্যবিত্তের কাছে ইলিশ এখন অলীক স্বপ্ন। একটা সময় ইলিশের ভরা মৌসুমে ৬/৭শ’ টাকার মধ্যেই মোটামুটি বড় সাইজের ইলিশ পাওয়া যেত। আর এখন মোটামুটি বড় সাইজের ইলিশ কিনতে হলে গুনতে হবে নিদেনপক্ষে ১৫শ’ টাকা। ফলে মাছের রাজা ইলিশ এখন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে অতীত স্মৃতির হিসেবে স্থান পেতে চলেছে।

হাতিরপুল এলাকায় রাস্তার ধার ঘেঁষেই একটি বাজার আছে। সেখানেই দেখলাম একজন অসহায় ক্রেতার মুখ। ইলিশ কেনার জন্য এই দোকান থেকে সেই দোকানে যাচ্ছেন। দরদামে মিলছে না, তাই অস্থির ভাব তার চোখে-মুখে। এক দোকানে ইলিশ টিপে দেখার উদ্যোগ নিতেই দোকানি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন– এই যে মিয়া, মাছ এত টিপতেছেন ক্যান? ‘আধঘণ্টা ধইর‌্যা তো শুধুই এই দোকান থাইক্যা ওই দোকানে ঘুরতেছেন। আপনে ইলিশ কিনতে পারবেন না। আজাইর‌্যা টিপাটিপি করবেন না তো...।’

এসব কথা বলেই দোকানদার ইলিশের শরীরে পানি ছিটালেন। ক্রেতা ভদ্রলোক যারপরনাই বিব্রত চোখে-মুখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। মনে হলো মানিব্যাগের সঠিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছেন। যা করে আল্লাহ... আজ ইলিশ কিনবেনই তিনি। হঠাৎ তার পাশে এসে দাঁড়ালেন ধোপদুরস্ত এক ভদ্রলোক। ইলিশের দাম জানতে চাইলেন। চতুর দোকানদার একটু আগে যে ইলিশের দাম হেঁকেছিলেন ১৫শ’ টাকা কেজি, সেই ইলিশেরই কেজি চাইলেন ১৬৫০ টাকা। ধোপদুরস্ত ভদ্রলোক তাতেই রাজি হয়ে একসঙ্গে ৫টি ইলিশ কিনলেন। এরমধ্যে পাশে দাঁড়ানো ওই ক্রেতার পছন্দ করা ইলিশটিও ছিল। আমি লোকটির মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। মানুষের এরকম অসহায় চেহারা দেখতে কারও ভালো লাগার কথা নয়।

বাজার থেকে বেরিয়েছেন তিনি। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম– ভাই আপনার নামটা?

অপরিচিত মানুষের প্রশ্ন শুনে একটু ভড়কে গেলেন। পরক্ষণেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন– ও আপনি... আপনাকে তো চিনি। টেলিভিশনে দেখি। সংবাদপত্র নিয়ে অনুষ্ঠান করেন। ভালো লাগে...।

আপনার নামটা? আমার প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক নিজের নাম বললেন। এবার দুজনই দুজনের দিকে তাকাচ্ছি। দুজনেরই বিব্রত চাহনি। আমিই ভদ্রলোককে বললাম– ইলিশ কেনা হলো না আপনার?

মনে হলো ভদ্রলোক লজ্জায় মুখ লুকানোর চেষ্টা করছেন। মৃদু হেসে বললেন– ইলিশের অনেক দাম। বাজেটে কুলায় না...।

বাজেটের কথা তুলে ভদ্রলোক মাথা নিচু করে সামনের দিকে চলে গেলেন। আমি তখন বাজেট নিয়েই ভাবছি। এই যে দিনে দিনে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েই চলছে, সেই তুলনায় সাধারণ মানুষের আয়-রোজগার কি বেড়েছে? ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধকে পৃথিবীব্যাপী পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। অথচ এই সংকটের মধ্যেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আগের তুলনায় কমেছে। আলু, পেঁয়াজ এবং ডিমের দামের ক্ষেত্রে পাশের দেশ ভারত এবং দেউলিয়া বলে যে দেশটিকে কিছু দিন আগে অনেকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিল সেই শ্রীলংকায় আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের দাম আমাদের দেশের তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশে এই তিনটি পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার নির্ধারিত বিক্রয় মূল্য ঘোষণার পরও তা কার্যকর হয়নি। এ জন্য ‘সিন্ডিকেট’ নামের আওতায় দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি জড়িত। অনেকটা প্রকাশ্যেই সিন্ডিকেট বাণিজ্য হয়। অনেক সমালোচনা আছে সিন্ডিকেট নিয়ে, কিন্তু কে শোনে কার কথা?

কিন্তু কথা না শুনলে তো সাধারণ মানুষ একদিন ক্ষেপে যাবে। লেখাটি শুরু করেছিলাম এক হাজার টাকার একটি নোটের আলোচনা দিয়ে। এক হাজার টাকা আয় করতেও সাধারণ মানুষকে অনেক কষ্ট করতে হয়। অথচ জিনিসপত্র কিনতে গেলে নিমিষেই এক হাজার টাকা হাওয়া হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের পুষ্টির জোগানদার ডিমেও স্বস্তি নেই। এখন শোনা যাচ্ছে আলুও নাকি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। অথচ দেশে আলুর মজুত নিয়ে কোনও শঙ্কা নেই। তাহলে আলু কেন বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে? দেশে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে হচ্ছেটা কী? জবাব কার কাছে খুঁজবো?   

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পাচার হওয়া বোনকে নিতে এসে কলকাতায় অসহায় দশায় চট্টগ্রামের তরুণ
পাচার হওয়া বোনকে নিতে এসে কলকাতায় অসহায় দশায় চট্টগ্রামের তরুণ
কৃষিজমিতে কাজ করতে গিয়ে ঘুরে পড়ে আ.লীগ নেতার মৃত্যু
কৃষিজমিতে কাজ করতে গিয়ে ঘুরে পড়ে আ.লীগ নেতার মৃত্যু
মাঠে ফিরেই হাল্যান্ডের গোলে জিতলো ম্যানসিটি
মাঠে ফিরেই হাল্যান্ডের গোলে জিতলো ম্যানসিটি
জাতীয় দল রেখে ঢাকা লিগে সাকিবের খেলার ব্যাখ্যা দিলেন নির্বাচক
জাতীয় দল রেখে ঢাকা লিগে সাকিবের খেলার ব্যাখ্যা দিলেন নির্বাচক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ