X
বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫
৫ আষাঢ় ১৪৩২

পোশাক শ্রমিকদের বেতনের দাবি কি অযৌক্তিক?

দীপংকর গৌতম
০৩ নভেম্বর ২০২৩, ১৮:৫২আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ১৮:৫২

কয়েক দিন ধরে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে পোশাক শ্রমিকরা আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। পোশাক শ্রমিকরা কেন আন্দোলন করে? কেন রাস্তার ওপর খররোদ্দুরে বসে পড়ে দিন কাটায়। তপ্ত রোদ্দুরে পুড়ে খাক হয়, তবু ওঠে না। এই রোদ্দুরে এত কষ্ট করে কেন বসে থাকে? গাড়ির আসা-যাওয়ায় শুধু ব্যাঘাত ঘটে। যানজট সৃষ্টি হয়, মানুষের ভোগান্তি চরমে ওঠে, তবু ওরা রাস্তা থেকে ওঠে না। কেন ওঠে না? রোদ-বৃষ্টি খরা উপেক্ষা করে কেন বসে থাকে। মানুষের ভোগান্তি ওরা কেন বোঝে না?

গত সোমবার কথাগুলো জিজ্ঞেস করলে গার্মেন্টসকর্মী লাইলী চিৎকার করে বলেছিল, ‘প্যাডের খিদার কাছে কোনও লাজলজ্জা নাই, কোন বিবেক-বিবেচনা নাই।’ গার্মেন্টস শ্রমিকরা সবাই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসেছে শুধু রুটি-রুজির অন্বেষণে। গ্রামীণ অর্থনীতি অবকাঠামো ভেঙে যাওয়ায় গ্রাম থেকে অনেক পেশাই উঠে গেছে। ফলে সেসব পেশাহারা মানুষরা পরিবার পরিজনসহ ঢাকায় এসেছে। যাদের বৃহৎ অংশটিই গার্মেন্টস শ্রমিক। এদের গড় বেতন ৮ হাজার ৪০০ টাকা। এটা নির্ধারিত হয়েছিল ২০১৮ সালে। তারপর পদ্মা মেঘনায় গড়িয়েছে অনেক জল। করোনা হানা দিয়েছিল মাঝখানে। শ্রমিকদের স্বল্প আয়ের জীবন কাঠামো ভেঙে গেছে তখন। একটু ঘুরে দাঁড়াতেই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে আবার সংকট শুরু হলো। সে সংকটও কাটিয়ে উঠেছে দেশ। কারণ, এখানে বিদেশি পোশাক ক্রেতারা বিশ্বের ভিতর সবচেয়ে কম টাকায় শ্রম কিনতে পারে বলে মালিকদের সঙ্গে বিদেশিদের দামাদামি করা সহজ হয়।

অন্যান্য দেশের তুলনায় কম টাকায় এরা পোশাক দিতে পারে। যদিও বাইরের দেশগুলোতে সরকার ও পোশাক মালিক সমিতির নির্ধারিত মূল্য রয়েছে। তার নিচে কোনও গার্মেন্টস মালিক দাম হাঁকতে পারে না। আমাদের দেশে সেটা নেই। ফলে যে মূল্য ঠিক হয় তাতে মালিকরা লাভবান হয়। এ ক্ষেত্রে আরেকটি কথা বলা দরকার। বিদেশি ক্রেতারা পোশাকের অর্ডার দেওয়ার সময় তিনিটি বিষয় খেয়াল করেন।

তার মধ্যে প্রধান হলো– ১. মূল্য নির্ধারণ, ২. কোয়ালিটি বা মান রক্ষা, ৩. শিপমেন্ট টাইম মানে অর্ডার দেওয়ার ১২০ দিনের মধ্যে কাজ জমা দেওয়ার রীতি। বিশ্বের অন্যান্য দেশ শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করাতে পারে না বলে অন্য কোনও দেশের কোম্পানি ইচ্ছে করলেই অর্ডার নিতে পারে না। যেটা আমাদের দেশে সবচেয়ে সহজ। শ্রমিকদের কাজ করানো হবে যত সময় মালিকের ইচ্ছে। বিশেষত আমাদের গার্মেন্টসগুলো ওভারটাইম বলে যে টাকা দেওয়া হয় সেটা শ্রমঘণ্টা অনুযায়ী ধরলে তা খুবই নগণ্য। এরপরের কথাটি হলো ডলারের দাম বেড়েছে। বাড়তি দামে পোশাক মালিকরা টাকা নেয়। কিন্তু শ্রমিকের ৮ হাজার ৪০০ আর বদলায় না। এখন যদি ১০ হাজার ৪০০ টাকা মালিকরা দিতে চায় তা কি ডলারের বর্ধিত দাম অনুযায়ী ঠিক হয়?

পোশাক মালিকদের এই ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরি প্রস্তাব কতটুকু গ্রহণযোগ্য? ২০১৮ সালে যখন ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা নির্ধারিত হয়, তখন গড়ে ডলারের দাম ছিল ৮৩ টাকা ৮৭ পয়সা। ফলে ২০১৮ সালে ডলারে ন্যূনতম মজুরি দাঁড়ায় ৯৫ দশমিক ৩৮ ডলার। বর্তমানে পোশাকমালিকরা রফতানির ক্ষেত্রে ১ ডলার বাবদ ১১০ টাকা ৫০ পয়সা পাচ্ছেন। ফলে ৯৫ দশমিক ৩৮ ডলারের বর্তমান মূল্য দাঁড়াচ্ছে ১০ হাজার ৫৩৯ টাকা। ফলে মজুরি বোর্ডের সর্বশেষ বৈঠকে পোশাক মালিকদের দেওয়া প্রস্তাবিত মজুরি, এমনকি ডলারের মূল্যবৃদ্ধি সমন্বয় করলে ২০১৮ সালের মজুরির বর্তমানে যা দাঁড়ায়, তার চেয়েও ১৩৯ টাকা কম!

সিপিডির দেওয়া তথ্য অনুসারে, ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়ার ন্যূনতম মজুরি যথাক্রমে ১৭০ ডলার, ১৭১ ডলার, ২০০ ডলার, ২৪৩ ডলার। বাংলাদেশের শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন ২৩ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবিতে, ডলারের হিসাবে যা দাঁড়ায় ২০৮ থেকে ২২৬ ডলার। এই মজুরি প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক দেশের মজুরির তুলনায় কম। কম্বোডিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার ব্যবসায়ীরা যদি ২০০ থেকে ২৪৩ ডলারে শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে ব্যবসা করতে পারেন, বাংলাদেশের পোশাকমালিকেরা কেন পারবেন না? বাজার তো সবার জন্য একই! একটা গার্মেন্টস কোম্পানি যাদের অর্থে বিত্তবানের সীমারেখা ছাড়িয়ে যায় কত দ্রুত- তারা যে পরিমাণ শ্রম ঠকায় এটা শ্রমিকরা বললেই যত দোষ। শ্রমিকদের যত অভিযোগ তা শুনলে বিস্মিত হবে যে কেউ। শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করা সবচেয়ে সহজ কাজ। চিপা কেচিগেট বন্ধ করলেই তারা আর চাকরিজীবী থাকলো না। আগাম নোটিশ ছাড়াই তাদের কাজ বন্ধ করে দেওয়া যায়।  কারখানার কর্মকর্তারা শ্রমিকদের ইচ্ছামাফিক গালিগালাজ, এমনকি মারধর করেন। কাজের সময় সামান্যতম অপরাধের জন্য তাদের বেতন কেটে নিতে দ্বিধা করেন না। দ্রব্যমূল্য যে হারে বাড়ছে তারপরে বেতন কাটলে শ্রমিকদের পরিবারের অবস্থা কি দাঁড়ায় ভাবা যায়?

কয়েক দিন ধরে বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে রাজধানী ঢাকার মিরপুর ১১ নম্বরে একটি পোশাক কারখানার  শ্রমিকরা আন্দোলন করছে। এই বেতনে তারা চলতে পারছে না। আন্দোলনরত কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। এতে বেশ কয়েকজন পোশাককর্মী আহত হয়েছেন। এরপর বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কারখানাটিতে হামলা চালান এবং গলি থেকে বের হয়ে মূল সড়ক অবরোধ করেন।

গত ৩১ অক্টোবর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পূরবী সিনেমা হলের কাছে এই সংঘর্ষ শুরু হয়। এই ঘটনার সূত্রপাত হয় পল্লবীতে ইপিলিয়ন গ্রুপের একটি পোশাক কারখানার কর্মীদের আটকে রাখার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। অন্য একটি কারখানার শ্রমিকদের আন্দোলনে ইপিলিয়নের কর্মীরা যুক্ত হতে পারেন, এমন আশঙ্কা থেকে তাদের কারখানা থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছিল না। কারখানার আশপাশ এলাকায় লাঠিসোঁটা নিয়ে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী একাধিক ব্যক্তির অনুসারীরা শ্রমিকদের ভয় দেখাচ্ছিলেন। পুলিশ বিষয়টি কেন দেখেনি? পুলিশের ভাষ্য হলো, বিএনপির অবরোধ কর্মসূচির কারণে এই সড়কে যান চলাচল অনেক কম ছিল। এই সড়কে আসা যানবাহন বিকল্প সড়ক ব্যবহার করেছে। এতে কোনও যানজট হয়নি। এ কারণে শ্রমিকদের শান্ত করতে পুলিশ উদ্যোগ নেয়নি। সড়কে অবস্থান করে একসময় ক্লান্ত হয়ে সরে যাবেন, এমন ধারণা থেকেই তাদের শান্ত করতে কোনও আশ্বাস দেওয়া হয়নি।

তাহলে বিষয়টি স্পষ্ট যে পোশাক শ্রমিকরা বারবার আন্দোলন করে কেন? কেনই বা তারা সড়কে বসে পড়ে। এই বাজারে আট হাজার টাকা দিয়ে কি খাবে? ডলারের মূল্য বেড়েছে কিন্তু আমাদের দেশের শ্রমিকদের বেতন ডলারের স্পর্শ পাবে না। তাদের দেওয়া আট হাজার ৪০০ তার থেকে কোনও কারণে বেতন কাটা গেলে তো গেলো। যে শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করে দ্রুত হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যান একজন গার্মেন্টস মালিক– তাদের যত সংকট সব শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার সময়। শ্রম শোষণ বিশ্বে নতুন নয়। কিন্তু ১৮৮৬ সালে শিকাগোর হে মার্কেটের আন্দোলন, যেটা মে দিবস নামে পালিত হয়, সে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকদের কাজের সময় ৮ ঘণ্টা বেঁধে দিলেও তা মানা হয় কি কোনও গার্মেন্টসে? যারা কোনও গার্মেন্টসে গিয়েছেন, দেখেছেন এর ভেতরের পরিবেশ? একটু এদিক-ওদিক হলে আর বাঁচার কায়দা নেই। সরু সিঁড়ি, ভেতরে বাতাস ঢোকে না। বের হওয়া কত কষ্ট– তা যারা তাজরীন বা রানা প্লাজার কথা মনে রেখেছেন তারা জানেন কোন পরিবেশে শ্রমিকরা কাজ করে। পেটের টান কতটা থাকলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মুখ বুজে দিনের পর দিন কাজ করেন।

গত ২০ বছরের হিসাব অনুযায়ী বছরে গড়ে ১০টি গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আর এসব ঘটনায় বছরে গড়ে নষ্ট হয়েছে প্রায় আড়াইশ’ কোটি টাকার সম্পদ। বিজিএমইএ‘র প্রতিবেদনে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পোশাকশিল্প কারখানায় মোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২০৬টি। এসব ঘটনায় নিহতের সংখ্যা তিনশ’র কাছাকাছি। তবে ২০১২ সালের তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা অন্তর্ভুক্ত করলে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে পাঁচশতে। এটাই শেষ কথা নয়। অরও তথ্য আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো শ্রমিকরা দাবি করলে সব দাবি পূরণ হয় এমন না। কিন্তু সব দাবির একটিও না মেনে যদি মাস্তান লেলিয়ে দিয়ে শ্রমিকদের ঠান্ডা করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সেটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত তাও ভাবতে হবে। আমরা সবসময় যে দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত তা হলো ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন বোনাস দেওয়া নিয়ে যে ঝামেলা পোহাতে হয় তা বলার না, তারপরে বেতন বাকি পড়ার বিষয় আছে। তখন রাস্তায় না নেমে এরা যাবে কোথায়? আর তাদের রাস্তায় বসায় যদি যানজট হয়, মানুষের দুর্ভোগ সীমা ছাড়িয়ে যায়, তারপর মাস্তান লেলিয়ে এদের শান্ত করার কথা ভাবতে হয়, সেটা কতটা যৌক্তিক? একজন ৮ হাজার টাকা বেতন পাওয়া শ্রমিকের বেতন যদি বাকি পড়ে, যদি বেতন বাড়ানোর কথা বলে সেটা কি অযৌক্তিক। ওই শ্রমিকের ঘরের বাচ্চা শিশুটির খাবারের জন্য কান্না কি তার কাছে বড়, নাকি শত মানুষের দুর্ভোগ বড়? ওর কাছে মাস্তানের হুমকি বড়, নাকি ক্ষুধা বড়? সব ভেবে আপনাকে বলতে হবে– পোশাক শ্রমিকরা কেন রাস্তায় নামে। এ ছাড়া কোন পথ কি তার আর আছে?

লেখক: সহকারী সম্পাদক, দৈনিক মানবকণ্ঠ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পল্টনে ‘মাদক কারবারিদের’ গুলিতে ডিবির দুই সদস্য আহত
পল্টনে ‘মাদক কারবারিদের’ গুলিতে ডিবির দুই সদস্য আহত
ইরানে সম্ভাব্য হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে মার্কিন প্রশাসন: ব্লুমবার্গ নিউজ
ইরানে সম্ভাব্য হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে মার্কিন প্রশাসন: ব্লুমবার্গ নিউজ
পদত্যাগপত্রে জোর করে চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর নিলেন স্থানীয়রা
পদত্যাগপত্রে জোর করে চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর নিলেন স্থানীয়রা
বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু রোগী বেশি, বরগুনায় চিকিৎসা দিতে হিমশিম
বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু রোগী বেশি, বরগুনায় চিকিৎসা দিতে হিমশিম
সর্বশেষসর্বাধিক