X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

গার্মেন্টস সেক্টরের অচলাবস্থা নিরসন জরুরি

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
১৭ নভেম্বর ২০২৩, ২০:৪৬আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ২০:৪৬

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাৎপর্যপূর্ণ গার্মেন্টস সেক্টরে গত প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে শ্রম অসন্তোষ বিরাজ করছে। এই বিরোধ মূলত শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির দাবিকে ঘিরে। কয়েক দিন আগে সরকার-নিযুক্ত প্যানেল ৫৬.২৫ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করলেও এই হারে বর্ধিত বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ শ্রমিকদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কারণ, তারা কার্যত তিনগুণ বেতন বৃদ্ধির দাবি করছে। এই বেতন বৈষম্যের কারণে গার্মেন্টস শিল্পে নিযুক্ত প্রায় ২৫ হাজার  শ্রমিক  রাস্তায় এসে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। বিক্ষোভ দেখানোর একপর্যায়ে তারা বিভিন্ন কারখানায় আগুন দিয়েছে, গাজীপুরে রাস্তা অবরোধ করেছে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে।

গার্মেন্টস সেক্টরে এই ক্রমাগত অস্থিরতার প্রভাব এই সেক্টরের সঙ্গে জড়িত প্রধান পক্ষগুলোর বাইরেও অনেক বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে, যাতে শুধু কর্মচারী এবং কোম্পানির মালিকগণই নয়, বরং সমগ্র জাতি এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বর্তমান সংকট একদিকে যেমন অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, একইভাবে এই সেক্টরে কর্মরত শ্রমিকদের জীবিকা ও উদ্যোগকে প্রভাবিত করতে পারে। বাংলাদেশের পোশাক খাত দেশের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অতএব, এই শ্রম সমস্যাটি সমাধান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি শ্রমিকদের কল্যাণ এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যক। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশে দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক মন্দার একটি ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনা রয়েছে, যা এই খাতের জন্য নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আসতে পারে।

ফলে, এই সেক্টরে জড়িত সবাইকে অবশ্যই সম্মিলিতভাবে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। সবাইকে সক্রিয়ভাবে ফলপ্রসূ আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে হবে এবং এমন একটি সমাধানে পৌঁছানোর জন্য সচেষ্ট হতে হবে, যা কার্যকরভাবে সব স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষা করে। গার্মেন্টস সেক্টরে ক্রমাগত সহিংসতার শিকার হচ্ছে কোম্পানির মালিকরা। বিদেশি অর্ডার সরবরাহে ব্যর্থ হলে মালিকপক্ষের ভবিষ্যতে অর্ডার হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে, শ্রমিকদের বুঝতে হবে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য এমন কোনও আন্দোলন করা যাবে না, যা এ সেক্টরের দীর্ঘমেয়াদি সমৃদ্ধি নষ্ট করতে পারে।

তাছাড়া, ঘটনাগুলোর অপ্রত্যাশিত প্রভাবে এই শিল্পে সরাসরি জড়িত শ্রমিকরা শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে খারাপ পরিণতি বরণ করতে পারে। দীর্ঘায়িত সহিংসতা এবং অশান্তির কারণে এই শিল্পের স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে। ফলে, এই অচলাবস্থার সম্ভাব্য প্রভাব ব্যাপক বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার পরিবেশ তৈরি করতে পারে। এই ফলাফলগুলোর সম্ভাব্য নেতিবাচক পরিণতি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল পরিবার এবং সম্প্রদায়ের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। শ্রমিকদের অবশ্যই তাদের কার্যক্রমের তাৎপর্য বুঝতে হবে এবং অনুধাবন করতে হবে যে কীভাবে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা ইতোমধ্যে একটি নাজুক পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করতে পারে। এই অচলাবস্থার বৃহত্তর প্রভাব বোঝার মাধ্যমে শ্রমিকদের উচিত এমনভাবে তাদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করা, যা শিল্পের দীর্ঘমেয়াদি মঙ্গল রক্ষা করে এবং নিজেদের এবং তাদের সহকর্মীদের উভয়ের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করে।

মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে রাষ্ট্রও একইভাবে এই অচলাবস্থা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হতে পারে। গার্মেন্টস সেক্টরের সহিংসতার সম্ভাব্য পরিণতি হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের অর্ডার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে, যা বিদেশি রেমিট্যান্সের প্রবাহকে প্রভাবিত করতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই পরিস্থিতির সম্ভাব্য প্রভাব বাংলাদেশের সাধারণ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর যথেষ্ট এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে।
অনেকেই এই সহিংসতার স্থায়ী প্রবণতার পেছনের কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করছেন। আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ এই ঘটনার পেছনে বড় চক্রান্ত জড়িত থাকার সম্ভাবনার কথা বলেছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য  সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিরোধী দলের আন্দোলনের সাথে গার্মেন্টস সেক্টরের অচলাবস্থার সম্পর্ক থাকতে পারে বলে অনেকেই অভিমত দিয়েছেন। অনেকের মতে বহিরাগত প্রভাব শ্রমিকদের আন্দোলনে উৎসাহিত করতে পারে,  যার ফলে অস্থিরতা আরও তীব্রতর হবে।

ফলে, গার্মেন্টস শ্রমিকদের অবশ্যই পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন এবং বহিরাগত প্রভাবের বিরুদ্ধে সহনশীলতা প্রদর্শন করতে হবে। তাদের বুঝতে হবে যে অনেকে তাদের দুর্দশাকে কাজে লাগিয়ে সরকারকে দুর্বল করার জন্য তাদের ব্যবহার করতে পারে। ফলে তাদের উচিত অবাস্তব দাবিতে আন্দোলন না করে বাস্তবসম্মত দাবি করা। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে শ্রমিকরা যা বেতন পায় তা দিয়ে একটি সন্তোষজনক জীবনযাত্রার মান বজায় রাখার কঠিন। একই সাথে তাদের বুঝতে হবে যে মালিক পক্ষও কোভিড-১৯ অতিমারির অর্থনৈতিক পরিণতি এবং রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় কঠিন সময় অতিক্রম করছে। এই চলমান সমস্যাকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার জন্য একটি কার্যকর সমাধান খোঁজার জন্য সকল পক্ষকে সক্রিয়ভাবে একটি সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করতে হবে। উভয় পক্ষ যদি উন্মুক্ত মানসিকতা নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করে তবে সমাধানে পৌঁছানো কঠিন হবে না।

এটা স্বীকার করা অপরিহার্য যে সহিংস কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে কোনও ইতিবাচক ফলাফল অর্জন করা যায় না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে সংঘর্ষের সময় দুঃখজনকভাবে প্রাণ হারানো দুই মৃত শ্রমিকের পরিবারগুলোর পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সতর্কতার সাথে বিবেচনা করা উচিত। আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি সংসারের প্রধান উপার্জনকারী ব্যক্তির মৃত্যুর পর এই পরিবারগুলো কীভাবে তাদের জীবিকা নির্বাহ করবে? যারা পেছন থেকে শ্রমিকদের ব্যবহার করেছে তারা কি এই পরিবারগুলোকে সহায়তা করবে? এই ধরনের সম্ভাবনা নেই। তাই, শ্রমিকদের উচিত পরিস্থিতির চরম বাস্তবতাকে বুঝে আন্দোলন না করে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে চলমান বর্তমান শ্রম সমস্যার বহুমুখী প্রভাব রয়েছে। শ্রমিক, গার্মেন্টস মালিক এবং রাষ্ট্রসহ অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের মধ্যে সহযোগিতা সমস্যার সমাধানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনও সম্ভাব্য উদ্বেগ প্রশমিত করার জন্য সরকারের অবিলম্বে এই সমস্যাটির প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত। একটি কার্যকর এবং স্থায়ী সমাধানের দিকে পৌঁছানোর জন্য মৌলিক উদ্বেগগুলো স্বীকার করা এবং মোকাবিলা করা অপরিহার্য। এর মাধ্যমে চলমান সমস্যার সমাধান করা সম্ভব, যা  রাষ্ট্রের বৃহত্তর অর্থনৈতিক মঙ্গলের জন্য অপরিহার্য।

লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভারতের মণিপুরে আবারও জাতিগত সহিংসতা
ভারতের মণিপুরে আবারও জাতিগত সহিংসতা
বাংলা গানের উন্নয়ন ও বিকাশে ‘অংশীজন সভা’
বাংলা গানের উন্নয়ন ও বিকাশে ‘অংশীজন সভা’
দায়িত্ব নিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে যা বললেন র‍্যাবের নতুন মুখপাত্র
দায়িত্ব নিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে যা বললেন র‍্যাবের নতুন মুখপাত্র
স্কুলে আসার পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ