X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

শিশু হত্যার বসুন্ধরা!

উদিসা ইসলাম
০৩ মার্চ ২০১৬, ১২:৫৮আপডেট : ০৩ মার্চ ২০১৬, ১৩:০৯

Udisa Islamশিশুর জন্য স্কুলপাঠ্য যতোটা জরুরি তার মতোই জরুরি ‘এক্সট্রা-কারিকুলাম অ্যাকটিভিটিস’। এই বিষয় নিয়ে শিশুদের চেয়ে তাদের বাবা-মায়ের ছুটোছুটির শেষ নেই। স্কুল থেকে গানের স্কুল, ড্রয়িং স্কুল, কোচিং, নাচের স্কুলসহ কতকিছু! শিশুকে সংস্কৃতিমনা করে তোলার প্রয়াস। কিন্তু যখনই বাসায় ফিরলেন, আপনার জীবন-যাপনে যা দেখবে আপনার সন্তান, তাই শিখবে। বাইরে থেকে শিক্ষণীয় যাই-ই শেখান না কেন, আপনার ঘরে চোখে দেখা বিষয়গুলো শিশুকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে। আর এই ঘর মানে সবসময় চার দেয়ালের বাসা-বাড়ি না, সমাজও। আপনার শিশু বড় হয়ে খুনি হয়ে উঠলে তাকে আমরা দোষী সাব্যস্ত করি কিন্তু আসল দোষী রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার যার সুতোগুলো ছিড়ে গেছে কখন তা আমরা খেয়াল করিনি।
চায়ের দোকানে তিনজন ব্যক্তি কথা বলছেন, বিষয়: কী হয়েছে আমাদের সমাজের? হঠাৎ কী হলো আমাদের? মা-বাবা কোলের শিশুকে মেরে ফেলছে। কী হলো আমাদের? একজন শিশুকে মারতে মারতে মেরেই ফেলা হচ্ছে! তাদের কাছে উত্তর নেই। কিন্তু তারা আলাপ করেই চলেছেন। আলাপের চূড়ান্ত মুহূর্তে চা এগিয়ে দিলো যে ছেলেটি তার বয়স ৯ বছর। চায়ের কাপটি দিতে গিয়ে ছলকে একটুখানি পড়ে গেলো আলাপে ব্যস্ত ব্যক্তির পায়ের কাছে, পায়ের ওপরও না। তিনি গালি দিয়ে শিশুটিকে দু-কথা শুনিয়ে দিলেন। পায়ের ওপর পড়লে কি তবে তিনি শিশুটিকে চড় মেরে দিতেন?
তাদের আলাপটাকেই যদি এগিয়ে নিয়ে যাই আমরা? কী হয়েছে আসলে আমাদের সমাজের? সমাজের আনাচে-কানাচে মানুষের মধ্যে যেন হত্যার নেশা পেয়েছে। না হলে দুইমাসে ৪৯ শিশু হত্যা! এ কি স্বাভাবিক কোনও ঘটনা হতে পারে? এখনই ভাবার দরকার, সমাজের গভীরতর জায়গায় যে অসুখ দানা বেধেছে তার কারণটা কী? রাজধানীর বনশ্রীতে দুটি শিশুর ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যু হয়েছে। বাবা-মা বারবার বাসি খাবার খেয়ে মৃত্যুর কথা বলে ঘটনা ঘুরিয়ে নিতে চাইছিলেন। অবশেষে একেকজনের একেকরকম কথায় সন্দেহ জমাট বাধে, চিকিৎসক বলেন, ‘তাদের শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে’। অবশেষে তিনদিন পর জানা গেল, এ হত্যার পেছনে মা দায়ী।
কয়েকমাস আগে শিশু রাকিবুল বা রাজশাহীর দুই শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। নীলফামারীর এক মা তার দুই শিশুকন্যাকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেছেন।
সবই তো স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তা না হলে, একটা বিচার শেষ করে উদাহরণ শেষ করতে পারা যায়নি যখন, তখন স্বাভাবিক হয়ে ওঠে সবকিছু। ফলে সিলেটের রাজন হত্যার এতোদিন পর এসে মামলা হাইকোর্ট অব্দি পৌঁছাতে পারে বটে, কিন্তু এগোয় না। এরই মধ্যে মরে যেতে হয় আরও শ’খানেক শিশুকে। এমনকি একই পরিবারের চারজনকে বাহুবলে মেরে ফেলা, শরীরে বাতাস ঢুকিয়ে মেরে ফেলা, মৃত ছেলেমেয়েকে হাসপাতালেই রেখে বাবা-মায়ের পালিয়ে যাওয়া এখন কেবলই ‘নিউজ আইটেম’ হয়ে গেছে।

শিশু নির্যাতনের কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে সমাজের বৈষম্য এবং অন্যায় আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি যেমন আসে তেমনই আসে বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিষয়টিও। শিশুদের সুরক্ষায় কার্যকর কোনও ব্যবস্থা আদতে আমাদের দেশে নেই। শিশু নিরাপত্তা নিয়ে কেউ-কেউ কাজ করছেন ঠিক, সেই কাজটি মোটা দাগে হচ্ছে বলেই এর সক্রিয়তা সীমিত পরিসরে। শিশু অধিকার বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ বা সামর্থ্য সরকারি বা বেসরকারি কোনও পর্যায়েই ভালো করে নেই। বিচার হচ্ছে না কেন? এমন প্রশ্ন উঠলেই এক শ্রেণি বলার চেষ্টা করেন শিশু সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে আমাদের যথেষ্ট আইন রয়েছে।
হ্যাঁ আছে তো! কিন্তু তার ব্যবহার কি সন্তোষজনক? একজন শিশু নিজে তার প্রতি অন্যায়ে কোনও বিচার চাইতে পারে না বলে তার ওপর কেবল অনাচারই ঘটবে? শিশুহত্যা, নির্যাতন প্রতিরোধ ও শিশুদের আইনি সেবাদানে প্রশাসনিক উদ্যোগে যে ঢিলেমিগুলো রয়েছে সেগুলো কিভাবে সরানো যায় তা নিয়ে কি আমাদের আদৌ কোনও পরিকল্পনা আছে?  
শিশু আইন ২০১৩-তে প্রতিটি থানায় শিশু ডেস্ক ও আলাদা পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগের কথা বলা হয়। মাত্র ছয় মাস আগে পুলিশ সদর-দফতর থেকে বলা হয়েছিল প্রতিটি থানায় এ ডেস্ক স্থাপন করার জন্য যেখানে কেবল শিশুদের বিষয়গুলো সুরাহা করা হবে এবং এতে করে অন্য আর দশটা মামলার থেকে এই মামলাগুলো অধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখা সম্ভব হবে। কিন্তু এতোদিনেও শিশুডেস্ক আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। এই ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান হওয়া উচিত।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, অনেক ধরনের ‘সন্দেহের কথা’ মাথায় রেখে ঢাকার রামপুরার ভাই-বোন হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হচ্ছে সাম্প্রতিক শিশু হত্যাগুলো ঘটানো হচ্ছে নানা ধরনের ‘ফায়দা হাসিলের’ জন্য, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে এই ফায়দা হাসিলের পথ বন্ধের দায়িত্ব কি রাষ্ট্র নেবে না?
পরবর্তী প্রজন্মকে নির্বিকার ও নির্মমতার সঙ্গে হত্যা করে কোন কোন ফায়দা হাসিল হচ্ছে সেগুলো চিহ্নিত করে এ হত্যা বন্ধ করতে হবে। যদি বন্ধ না হয়, যদি কাউকেই বিচারের সম্মুখীন না করা যায়, যদি চূড়ান্ত শাস্তির ব্যবস্থা না করে কেবল কিছু কথা বলে, কিছু ব্যক্তিকে কারাগারে নিয়ে আটকে রাখাকেই বিচার হিসেবে উল্লেখ করা হয় তবে এ রাষ্ট্র হবে শিশু হত্যার বসুন্ধরা। সমাজের কোন মূল্যবোধগুলো দুর্বল হলে একজন মা তার সন্তানকে হত্যা করতে পারে তা নিয়ে ভাবনায় বেশি সময় নষ্ট করলে আরও কিছু শিশুপ্রাণ আমরা হারাবো।

ভুলে গেলে চলবে না ব্যক্তির নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্কটি নিবিড়। শিশুদের প্রতি অপরাধ কমাতে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ছাড়া এখন আর কোনও পথ খোলা নেই।

লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, বাংলা ট্রিবিউন

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ