X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচন বয়কট করে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা কি ঠিক?

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
২১ জানুয়ারি ২০২৪, ২০:১০আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ২০:১০

বাংলাদেশের জটিল রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল প্রায়ই বিতর্কের ক্ষেত্র হিসাবে সামনে আসে। দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি উদ্বেগজনক প্যাটার্ন তৈরি হয়েছে; যেখানে নির্বাচনে পরাজিত হলেই রাজনৈতিক দল নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিকভাবে নির্বাচনের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করে।

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ব্যতিক্রম ছিল না। কারণ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-সহ কয়েকটি বিরোধী রাজনৈতিক দল, যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, তারা নির্বাচনি প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য একটি প্রচারণা শুরু করেছে।

স্থানীয় এবং বিদেশি পর্যবেক্ষকরা যখন নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন তখন সেই নির্বাচন প্রক্রিয়ার বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য বিরোধীদের প্রচেষ্টা দুঃখজনক।

তাছাড়া, ৪১.৮% ভোটার যখন তাদের ভোটদানের অধিকার প্রয়োগ করেন তখন সেই নির্বাচনের ফলাফলকে প্রতিযোগিতাহীন বা অংশগ্রহণহীন নির্বাচন বলে তকমা দেওয়া যায় না। ফলে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের ভোটের অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে যদি প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয় তাহলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নীতি ক্ষুণ্ন হবে।

তাছাড়া, বাংলাদেশের নির্বাচনি আইনে কোথাও বলা নেই যে কত শতাংশ ভোটার ভোট প্রদান করলে সেই নির্বাচন বৈধ হবে। বরং, ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোল পোস্ট (এফপিটিপি) পদ্ধতিতে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই পদ্ধতিতে ভোটাররা একজন মাত্র প্রার্থীকে ভোট প্রদান করেন এবং অনেক প্রার্থীর মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি ভোটে এগিয়ে থাকেন তিনিই নির্বাচনে বিজয়ী হন।

ফলে কত শতাংশ ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে সেটা বিবেচ্য নয়।

দেশি ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের সমন্বয়ে গঠিত স্বাধীন নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো সর্বসম্মতভাবে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে অবাধ, ন্যায়সঙ্গত এবং বিশ্বাসযোগ্য হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের এই স্বীকৃতির যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে দেশে একটি সুষ্ঠু ও দায়িত্বশীল নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গৃহীত সব সিদ্ধান্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। দেশে গণতান্ত্রিক নীতি এবং আইনি প্রবিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিশ্চিতভাবেই প্রশংসার দাবিদার।

তবে, পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের স্বীকৃতি সত্ত্বেও বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপি এবং তাদের সহযোগীরা নির্বাচনের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তাদের এই ধরনের প্রচেষ্টা  দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবার আশঙ্কা তৈরি করতে পারে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে নির্বাচনি প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা বাংলাদেশের ওপর বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাইরেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। এর ফলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনসাধারণের আস্থা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের সতর্ক ও নিয়মতান্ত্রিক প্রস্তুতি প্রশংসার দাবিদার। নির্বাচনের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা এবং নির্বাচনি প্রক্রিয়ার সততা নিশ্চিত করার জন্য কমিশনের প্রচেষ্টা ধারাবাহিকভাবে স্পষ্ট ছিল। নির্বাচনের ফলাফল থেকে জানা যায়, অনেক মন্ত্রীসহ ৫৫ জন সংসদ সদস্য জয়লাভ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আবার একই সঙ্গে নির্বাচনে ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন।

সুতরাং, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার বিরোধীদের বক্তব্যের বাস্তব কোনও ভিত্তি নেই।

বিরোধীদের অবশ্যই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব স্বীকার করতে হবে। প্রতিটি গণতান্ত্রিক সমাজে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে নীতি ও শাসন নিয়ে মতবিরোধ থাকতেই পারে। তবে, যথেষ্ট প্রমাণ ছাড়াই নির্বাচনি প্রক্রিয়ার মৌলিক নীতিগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করা গণতন্ত্রের মূল ধারণাকে দুর্বল করে দেয়। সবসময় সব কিছু  সন্দেহের চোখে না দেখে বিরোধীদের উচিত সমস্যা সমাধানের জন্য গঠনমূলক আলোচনায় অংশ নেওয়া।

তাহলে সমস্যা সমাধানের জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আস্থায় রেখে দেশের অগ্রগতিতে অবদান রাখা উচিত সব রাজনৈতিক দলের।

তাছাড়া, বাংলাদেশের নির্বাচনের বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি দেশের জনগণের মধ্যে এক ধরনের আশ্বাসের অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের স্বীকৃতি নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং উন্মুক্ততাকে আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে ধরেছে। ফলে, রাজনৈতিক সংগঠন নির্বিশেষে, এই মূল্যায়নের বিশ্বাসযোগ্যতাকে স্বীকৃতি দেওয়া ও ফলাফল মেনে নেওয়া সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের জন্য অপরিহার্য।

বিশ্বব্যাপী আন্তসংযোগের বর্তমান যুগের পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশকে অবশ্যই বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। নির্বাচনের ফলাফলের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরও সুসংহত করবে এবং আগামী দিনে সংসদ নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করবে বলে দেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে। ফলে, বিরোধীদের নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে অবশ্যই এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, যেখানে নির্বাচনের পরে সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে নির্বাচনকে বৈধতা দেবে। এর জন্য গণতান্ত্রিক নীতি, স্বচ্ছতা এবং উন্মুক্ত আলোচনার প্রতি ঐক্যবদ্ধ অঙ্গীকারের প্রয়োজন। গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিগুলো দুর্বল করে দিতে পারে এমন কৌশল প্রয়োগের পরিবর্তে বিরোধীদের উচিত দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে সক্রিয়ভাবে অবদান রাখা।

পরাজিত দলের পক্ষ থেকে প্রতিটি নির্বাচনের ফলাফলের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। বাংলাদেশের সর্বশেষ নির্বাচন স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার নীতি মেনে চলার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি শক্তিশালী করার জন্য সরকারি ও বিরোধী দলসহ সব রাজনৈতিক দলের উচিত গণতান্ত্রিক নীতিগুলো মেনে চলা। যৌথ প্রতিশ্রুতির মাধ্যমেই আগামীতে বাংলাদেশ একটি গতিশীল ও সুস্থ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিকশিত হবে।

লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঢাকায় পা রেখে চট্টগ্রামে উড়াল দিলো জিম্বাবুয়ে
ঢাকায় পা রেখে চট্টগ্রামে উড়াল দিলো জিম্বাবুয়ে
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালককে আদালতে তলব
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালককে আদালতে তলব
ম্যানসিটিকে আরও পেছনে ফেললো আর্সেনাল
ম্যানসিটিকে আরও পেছনে ফেললো আর্সেনাল
পাকিস্তানে বৃষ্টিতে নিহত ২২
পাকিস্তানে বৃষ্টিতে নিহত ২২
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ