X
সোমবার, ১৭ জুন ২০২৪
৩ আষাঢ় ১৪৩১

রাইসির মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের ‘দায়’!

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
২৬ মে ২০২৪, ১৭:২০আপডেট : ২৬ মে ২০২৪, ১৭:২৪

ইরান রাষ্ট্রের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আব্দোল্লাহিয়ানসহ নয় জন এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ায় গণমাধ্যমে ওই দুর্ঘটনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। ১৯৭৯ সালে ‘ইসলামের গান্ধী’ বলে পরিচিত ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানের বর্তমান একনায়কতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী সম্পর্কের সূচনা হয়। শাহের পতনের পর বিপ্লবী ছাত্র-জনতার প্রবল যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব, জিম্মি সংকট ও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ওই সম্পর্ক তলানিতে চলে যায়।

১৯৮০ সালে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়। যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে একের পর এক অবরোধ আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো থেকে ইরান বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যা তার অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব ফেলে।

তেলের মজুতের হিসাবে ইরানের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। বিশ্বের মোট প্রমাণিত পেট্রোলিয়াম মজুতের প্রায় দশ ভাগ ইরানে রয়েছে। ইরানে আগামীতে নতুন কোনও তেলের খনি আবিষ্কৃত না হলেও এর মজুত ১৪৫ বছর স্থায়ী হবে। অপরিশোধিত তেলের মজুত হিসাবে ইরানের অবস্থান কানাডার পরে। অবশ্যই কানাডার অপ্রচলিত তেলের মজুত বাদ দিলে ইরানের অবস্থান কানাডার উপরে, সৌদি আরবের পরে। মজুত তেলের হিসাবে ইরানের অবস্থান তৃতীয়/চতুর্থ যাই হোক না কেন, তেল বিক্রি করে সৌদি আরব যেখানে বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশের তালিকায় নাম লিখেছে, সৌদি আরবের জনগণ যখন উন্নত জীবনযাপন করছে, সেখানে সৌদি আরবের কাছাকাছি তেলের মজুত থাকা সত্ত্বেও ইরানের জনগণ দারিদ্র্যপীড়িত জীবনযাপন করেন। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোসহ তেল ক্রয়কারী অধিকাংশ দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র রাষ্ট্র। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের ফলে বৈধ পথে ইরানের পক্ষে তেল ক্রয়কারী দেশের কাছে তেল বিক্রি করা সম্ভব হয় না। তাই ইরানের তেল সম্পদ তার অর্থনৈতিক উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।

বিশ্বের অন্যতম তেল সমৃদ্ধ দেশ হওয়া সত্ত্বেও শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের কারণে ইরানের অর্থনীতি স্বমহিমায় বিকশিত হতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের ওই অবরোধ শুধু অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলেছে তা নয়, ইরানের সব ক্ষেত্রে প্রভাব রাখছে। ইরান প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দাবি করলেও বাস্তবিকপক্ষে তা অনেক ক্ষেত্রে যে ‘ফাঁকা বুলি’ তা সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। ইসরায়েলে তারা কয়েকশ’ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপ করলেও তা ইসরায়েলের ক্ষতি করা তো দূরের কথা, ওইসব ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ইসরায়েলের আকাশসীমায় পৌঁছাতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ইসরায়েল ইরানের চেয়ে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র ও প্রযুক্তিতে যে এগিয়ে আছে তা আবারও প্রমাণিত  হয়েছে।

এ কথা ঠিক যে ইরানের নির্মিত ড্রোন সামরিক অস্ত্র হিসেবে বেশ খ্যাতি লাভ করেছে। রাশিয়া যুদ্ধে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ওই ড্রোন ব্যবহার করে অনেক ক্ষেত্রে সফলতা পেয়েছে।

সাম্প্রতিক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায়ও কার্যকর ভূমিকা রাখে ইরানি ড্রোন। তুরস্কের উন্নত প্রযুক্তির ড্রোন রাইসির বিধ্বস্ত হেলিকপ্টার খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়। তবে ইরানের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি ড্রোন রাষ্ট্রপতি রাইসিকে বহনকারী বিধ্বস্ত হেলিকপ্টার খুঁজে পায়। কিন্তু এটি মুদ্রার একপিঠ। অন্যপিটের চিত্র সুখকর নয়। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন প্রযুক্তির সঙ্গে তুলনা করলেও ইরানি ওই ড্রোন খুব কার্যকর কোনও অস্ত্র নয়, যা ইসরায়েলের অস্তিত্বকে হুমকিতে ফেলতে পারে।

সাম্প্রতিক ইরানের হামলায় ওই ড্রোন ব্যবহৃত হলেও তার অধিকাংশ ইসরায়েলের মাটিতে পৌঁছাতে না পারার ঘটনা থেকে তা প্রমাণিত হয়েছে।

ড্রোন প্রযুক্তি দেখে মনে হতে পারে ইরান অ্যাভিয়েশন সেক্টরে বেশ উন্নত দেশ। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের ফলে ইরানের পক্ষে অ্যাভিয়েশন সেক্টরে আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। ইরান ইসলামি বিপ্লবের আগের শাহের আমলের অ্যাভিয়েশন অবকাঠামো ও প্রযুক্তি বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছে। ফলে প্রতিবছর ইরানে বিমান দুর্ঘটনা ঘটছে।

২০০০ সালে থেকে এই পর্যন্ত প্রায় ২০০ বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং ওই দুর্ঘটনায় প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। গত বছর (২০২৩) বিমান দুর্ঘটনায় ইরানের ক্রীড়ামন্ত্রী নিহত হন। সামরিক কর্মকর্তাদের বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার ঘটনা প্রায় ঘটে।

ইরানের রাষ্ট্রপতি রাইসির হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জড়িত না থাকলেও তাদের পরোক্ষ ভূমিকা আছে। ইরানের সঙ্গে বৈরী সম্পর্কের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের রাষ্ট্রপতি রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি গুলি করে নামিয়েছে অথবা যুক্তরাষ্ট্রের কোনও এজেন্ট ইরানের রাষ্ট্রপতি রাইসিকে হত্যার জন্য ইচ্ছাকৃত হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে বলে দাবি করে ওই দুর্ঘটনার দায়ভার যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপাচ্ছি বিষয়টি এমন নয়।

ইরানের সামরিক বাহিনী প্রকাশিত হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্টেও দাবি করা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি পরিকল্পিত রুটে যাওয়ার পথে একটি পাহাড়ে বিধ্বস্ত হয়ে আগুনে ভস্মীভূত হয়। তারা তাদের প্রাথমিক তদন্তে ধ্বংসাবশেষে কোনও বুলেটের চিহ্ন পায়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত একটি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ফেলতে তাদের আদৌ গুলি করার প্রয়োজন আছে কি? রাষ্ট্রপতি রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটির জিপিএস ব্যবস্থা ব্যবহার করেও যুক্তরাষ্ট্র চাইলে ওই হেলিকপ্টারটি দুর্ঘটনায় ফেলতে পারে।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের কাছে যেসব সামরিক যন্ত্রপাতি ও বিমান-হেলিকপ্টার সরবরাহ করে তার সব তথ্য তাদের হাতে থাকে। ইরানের রাষ্ট্রপতি রাইসিকে ব্হনকারী হেলিকপ্টারটি যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত হওয়ায় তার সব কলকব্জার তথ্য যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রয়েছে সেই বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া দরকার। সুতরাং জিপিএস ব্যবহার করে হেলিকপ্টারটিকে দুর্ঘটনায় ফেলা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কঠিন কাজ নয়।

তবে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ কোনও সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও তাদের অবরোধের প্রভাব রয়েছে তা সত্য। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের ফলে ইরানের পক্ষে আধুনিক অ্যাভিয়েশন যন্ত্রপাতি এবং রাষ্ট্রপতির চলাচলের জন্য উন্নত নিরাপদ আকাশ বাহন সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। ফলে ইরানের রাষ্ট্রপতি রাইসিকে যাতায়াতের জন্য একটি ৪৫ বছরের পুরাতন মার্কিন হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নির্মিত ওই হেলিকপ্টারটি ইসলামি বিপ্লবের আগে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের শাহকে উপহার হিসেবে দেয়। ইসলামি বিপ্লবের সময় বিপ্লবীরা তা দখল করে এবং পরবর্তীকালে তা ইরানের সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয়। সেনাবাহিনী ওই হেলিকপ্টারটি রাষ্ট্রপতির বহরে যুক্ত করে। ইরানের কাছে থাকা হেলিকপ্টারগুলোর মধ্যে এটিই সব থেকে নিরাপদ বাহন ছিল। ইরান প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দাবি করলেও নিজের দেশের রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার জন্য একটি আধুনিক নিরাপদ নিজস্ব হেলিকপ্টার তৈরি করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের কারণে ইরানের পক্ষে বাইরে থেকে আধুনিক ও নিরাপদ হেলিকপ্টার ক্রয় করাও সম্ভব হয়নি।

ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত একটি পুরনো হেলিকপ্টারেই ইরানের রাষ্ট্রপতি রাইসিকে ভ্রমণ করতে হয়েছে। এই ঘটনা থেকেও ইরানের অ্যাভিয়েশন খাতে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট হয়।

ইরানের রাষ্ট্রপতি রাইসিকে বহনকারী ওই হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইরানের অপর শত্রুরাষ্ট্র ইসরায়েলের কোনও ভূমিকা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। সাম্প্রতিক সিরিয়ার দামেস্কের ইরান দূতাবাসে ইসরায়েল বিমান হামলা চালিয়েছে অভিযোগ তুলে ইরান তার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইসরায়েল আক্রমণ করে। প্রায় ৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন তারা ইসরায়েলে পাঠায়। যদিও তা ইসরায়েলের কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। কারণ ইসরায়েল তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ওইসব ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের সিংহভাগ ইসরায়েলে পৌঁছানোর আগে জর্ডানের আকাশে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়। এর পাল্টা জবাব হিসেবে ইসরায়েল তাৎক্ষণিক কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখালেও তারা উপর্যুক্ত সময়ে ওই হামলার জবাব দেওয়ার শপথ করে। রাষ্ট্রপতি রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় পড়ায় তাই এর সঙ্গে ইসরায়েলের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়।

শুধু সাম্প্রতিক উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিত নয়, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং ফিলিস্তিনের হামাস ও লেবাননের হিজবুল্লাহকে পৃষ্ঠপোষকতা করায় ইরানের প্রতি ইসরায়েল সবসময় বৈরী ছিল। হিজবুল্লাহ বিভিন্ন সময়ে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়েছে।

২০২০ সালের নভেম্বর মাসে ইরানের রাজধানী তেহরানের কাছে দামাভান্দে ইরানের একজন শীর্ষস্থানীয় পরমাণু বিজ্ঞানীকে দূরনিয়ন্ত্রিত অস্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। ওই হত্যার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে ইরান। ইরানের অভ্যন্তরে হামলা চালানের মতো সক্ষমতা ইসরায়েলের রয়েছে, তা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং ইরানের সাম্প্রতিক ইসরায়েল আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে তারা ইরানের শীর্ষস্থানীয় কোনও ব্যক্তিকে হত্যা করতে চাইলে তাদের জন্য এটা খুব কঠিন কাজ নয়।

ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসি আজারবাইজানের সীমান্তবর্তী এলাকায় দুই দেশের যৌথভাবে নির্মিত একটি বাঁধ উদ্বোধন করতে যাওয়ার আগে তার নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনা করে ওই অঞ্চল সফরে হেলিকপ্টার ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে সড়ক পথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকায় পরিকল্পনা পরিবর্তন করা হয়।

সড়ক পথের পরিবর্তে আকাশ পথকে বেছে নেওয়া হয়। সুতরাং রাষ্ট্রপতি রাইসির ওই সফর যে তার শত্রুদের নজরে ছিল তা বলা যায়। বহরে থাকা অন্য হেলিকপ্টারগুলো নিরাপদে পৌঁছাতে পারলেও রাষ্ট্রপতি রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি কেন পারলো না সেই উত্তর ইরানের সামরিক বাহিনী প্রকাশিত প্রাথমিক প্রতিবেদনে নেই। হেলিকপ্টারটি যান্ত্রিক ত্রুটিতে পড়েছিল কিনা সে বিষয়ে পরিষ্কার বক্তব্য পেলে দুর্ঘটনার জন্য বৈরী আবহাওয়া নাকি জিপিএস ব্যবস্থার প্রভাব ছিল তা বোঝা যাবে।

এরইমধ্যে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র ওই হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্ট থাকার কথা অস্বীকার করেছে। রাজনৈতিক কারণে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ওই দাবি ইরানের মেনে নেওয়া ছাড়া ভিন্ন কোনও উপায় নেই। ইরান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে নানান বিষয়ে ভিন্ন মত থাকলেও এই বিষয়ে তারা একমত হবে। হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার বিষয়ে তারা একই সুরে কথা বলবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল কখনও হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার দায়ভার নেবে না। কারণ একটি দেশের রাষ্ট্রপতি, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের হত্যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল জড়িত আছে, এমনটা প্রমাণিত হলে তাদের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়বে। কূটনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল চাপে পড়বে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের সূচনা হবে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক-বেসামরিক স্থাপনা ইরানি হামলার মুখে পড়বে যা স্থায়ী যুদ্ধে মোড় নিতে পারে।

সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল কখনও এই হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার দায় নেবে না।

একইভাবে ইরানের বর্তমান প্রশাসন ওই হেলিকপ্টার দুর্ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড বলার দুঃসাহস দেখাবে না। কারণ তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভঙ্গুর চিত্র জনগণের সামনে প্রকাশিত হবে। ইরান সামরিক ক্ষেত্রে যে সফলতা অর্জন করেছে বলে বাগাড়ম্বর করে তার ফাঁপা দিক প্রকাশিত হলে জনগণ ইরানি স্টাবলিশমেন্ট থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। সামরিক বাহিনীসহ ইরানের স্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের মনোবল ভেঙে পড়বে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি ইরানের সামরিক ও জনপরিসরে জোরালো হবে, যা স্থায়ী যুদ্ধের রূপ নিতে পারে। কিন্তু ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর মতো অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা এই মুহূর্তে ইরানের নেই। সুতরাং ইরানের বর্তমান প্রশাসনের দুর্বলতা ঢাকতে তাদের পক্ষে প্রকৃত সত্য কখনও প্রকাশ করা সম্ভব হবে না।

তবে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার প্রকৃত ঘটনা যা হোক না কেন, রাষ্ট্রপতি রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দোল্লাহিয়ানের নিহত হওয়ার ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। কারণ ইরানের শীর্ষ নেতা আলি খামেনি তার শক্ত দুই বাহু রাষ্ট্রপতি রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দোল্লাহিয়ানকে হারিয়ে ফেলায় তার পক্ষে এখনই ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে বেসামরিক থেকে সামরিকীরণে রূপান্তর করার ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব হবে না। হামাস ও হিজবুল্লাহর একান্ত পৃষ্ঠপোষক রাইসি ও আব্দোল্লাহিয়ানের মৃত্যুর ফলে তাদের প্রতি ইরানি পৃষ্ঠপোষকতায় কিছুটা হলেও ভাটা পড়বে। ফলে ইসরায়েলে হিজবুল্লাহর হামলা কমবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দোল্লাহিয়ান তার ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলকে বিচ্ছিন্ন করার যে কৌশল নিয়েছিল তা থমকে যাবে। পরবর্তী ইরানি নেতৃত্ব কতটা ওই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারবে তা বলার সময় এখনও না এলেও সাম্প্রতিক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইসরায়েল কিছু সময়ের জন্য হলেও সামরিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ইরানি চাপমুক্ত থাকবে তা বলা যায়। ফলে তারা সহজে জনমিতি-জনবসতি পুনর্বিন্যাসের কূটনীতি বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হতে পারবে। জনমিতি-জনবসতি পুনর্বিন্যাসের কূটনীতি সফল হলে সৌদি আবরসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার দ্বার খুলে যাবে। মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র থেকে ইসরায়েলকে মুছে ফেলার ইরানি নেতাদের হুঙ্কার ও স্বপ্ন ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’ প্রবাদে পরিণত হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঈদে বাড়ি যাওয়ার পথে খুন হলেন কাশিমপুর কারাগারের কর্মকর্তা
ঈদে বাড়ি যাওয়ার পথে খুন হলেন কাশিমপুর কারাগারের কর্মকর্তা
২৪ বছরের আক্ষেপ নিয়ে ইউরো মিশনে ফ্রান্স
২৪ বছরের আক্ষেপ নিয়ে ইউরো মিশনে ফ্রান্স
ফিলিস্তিনসহ দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান রাষ্ট্রপতির
ফিলিস্তিনসহ দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান রাষ্ট্রপতির
প্রধানমন্ত্রীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানালেন দলের নেতাকর্মীরা
প্রধানমন্ত্রীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানালেন দলের নেতাকর্মীরা
সর্বশেষসর্বাধিক