সঞ্জীবদা যেদিন মারা গেলেন, সেদিন রিপোর্টটা আমি করেছিলাম। করতে হয়েছিল। সে যে কী ভার! শেষ লাইনে, পে অফে বলেছিলাম– ‘সঞ্জীব আমাদের মতো অনেকেরই ভিন্ন রকম ভাবনা, লেখা, ভিন্নভাবে মানুষ দেখা- শেখার হাতেখড়ির গুরু।
তিনি শিখিয়ে যাননি কীভাবে প্রিয়জন, প্রিয় মানুষ, বন্ধু বা গুরুকে নির্লিপ্ত ভাবালুতায় রিপোর্ট লিখে শেষ বিদায় দিতে হয়। আমাদের সঞ্জীব চৌধুরীকে তাই হয়তো সাংবাদিকতার ভুল গ্রামারেই বলছি– ‘বিদায় সঞ্জীব দা...’।
ভয়েস-ওভারটা ন্যাচারাল দিতে পারিনি। কেঁদেছি, নাক টেনেছি। আর ওই সরল, খাঁটি ব্যাপারটুকু নিয়েই গ্রামগঞ্জে সঞ্জীব-ভক্তরা এখনও আলাপ করে। আমাকে সে কারণে একচিমটি বেশি ভালোও বাসে হয়তো।
সঞ্জীবদাকে ঈর্ষা করি এখন। আসলে, মরতেও জানতে হয়! ঠিক সময়ে, ঠিকঠাক কারণে মরতে পারে বলেই এরা সঞ্জীব বা ‘যিশু’।
এরাই বড়দিনের অমর সন্তান।
সঞ্জীবদা’র সঙ্গে পরিচয়ের তারিখ-টারিখ মনে থাকার কথা নয়। একটা পত্রিকা অফিসে কবে কার সঙ্গে দেখা হলো সেটা মনে রাখার মতো কিছু কি?
তবে আমি আজকের কাগজে ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কে যেদিন প্রথম কাজের টেবিলে বসেছি, সেদিনটি ছিল ২ মে, ১৯৯১। মনে আছে এ কারণে যে আমি ওইদিন ডেস্কে কার রিপোর্ট কখন কারেক্টেড হয়ে কম্পিউটার সেকশনে গেলো, সেটি এন্ট্রি করছিলাম। তারিখ লিখতে হয়, রুল টেনে টেনে হেডলাইন আর টাইম আলাদা ঘরে লিখতে হয়। ওভাবেও অনেক কিছু শেখা যায়।
আমাদের শিফট ইনচার্জ, পুলক দাই প্রথমে ওই কাজটা বোঝালেন। তারপর টেলিপ্রিন্টার কপি, ডেটলাইন, ডেডলাইন, স্লাগ, এসব বোঝালেন। আমার হাতের লেখা মোটামুটি সুন্দর। এন্ট্রি খাতায় নিয়মিত লেখার কাজটা আমারই হলো।
কয়েক দিন পরে একদিন, দুটো ফিচার এন্ট্রি করছি, দেখি হাতের লেখাটা চিনি না।
অমিত হাবিবকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কার লেখা। হেডলাইনও দেওয়া নাই, বাইলাইন নেই।
অমিতদা হাত থেকে লেখাটা নিয়ে, লাল কালি দিয়ে হেডলাইন লিখলেন, আর নামটা লিখলেন– সঞ্জীব চৌধুরী। তখন আজকের কাগজের সব বাইলাইন আমার মুখস্থ। রিপোর্টাররা যারাই দুপুরে নিউজরুমে আসেন, তাদের দেখে দেখে নামটা মিলিয়ে চিনে নিচ্ছি কেবল।
আমি সঞ্জীব চৌধুরী নামটা দেখে একটা কাঁচাপাকা চুলের, মোটা কিসিমের বয়স্ক ভদ্রলোক খুঁজছিলাম। প্রণাম জানিয়ে পরিচিত হবো...।
অমন কাউকে না দেখে অমিত হাবিবকে জিজ্ঞেস করলাম, এই দাদাটা কখন আসবে?
অমিতদা আমাদের ডেস্কের পাশ দিয়ে একটা বারান্দার দরজা দেখিয়ে বললো, বারান্দায় গিয়ে দেখেন, টেবিলে টোকা দিয়ে যে গান করে, ওটাই সঞ্জীব। ওইদিনই আমি সঞ্জীবদা, আর আদিত্য কবীরকে প্রথম দেখলাম।
‘ইথার থেকে’ নিয়মিত কলামটা নিয়ে কথা বললাম। ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস থাকে তাই দেড়টার পর অফিসে আসি। সে কারণে আমার মাত্র ৩/৪ ঘণ্টা ডেস্কের ডিউটি।
সঞ্জীবদা বললেন, ‘শোনেন বালিকা, ওসব ক্লাস-ফ্লাস পইড়া-টইড়া কোনও কাজ হয় না... মানুষ পড়বেন- মানুষ’। আমি তো তখন দার্শনিক সঞ্জীবদাকে চিনতে শুরু করি নাই, এই কথায় ভয় পেয়ে গেলাম। ধ্যাৎ... বলে মেরিনা আপার কাছে চলে আসি ডেস্কে।
এখন যখন এসব মনে পড়ে, সেই পাগলা পাগলা সঞ্জীবদা’র বাউন্ডুলেপনার কেমন ফ্যান হয়েছিলাম, স্পষ্ট ছবির মতো দেখতে পাই।
আমার লেখালেখি নিয়ে তেমন উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না, ইনফ্যাক্ট আমি বুঝতামই না ভালো-মন্দ লেখার হাত বা তরল গদ্য, গরল গদ্য কী?
সঞ্জীবদা’কে ২ স্লিপে যা লিখে দিতাম, সেটাই কাটাকুটি করে একটা দারুণ কিছু বানিয়ে ছেপে দিতেন, মুন্নী সাহা নামে।
সে কারণেই আমি কখনোই দাবি করতে শিখিনি যে আমি লিখতে পারি, বা লিখেছি।
প্রশংসা করে সাগরেদ-শিষ্যদের এগিয়ে দেওয়ার অসম্ভব মহান এক অনুভবের নাম সঞ্জীব চৌধুরী। আমাদের যাদের, সেই সময়ে কাগজে কাজ করার ভূতে ধরেছিল, সেসব বাউন্ডুলেদের ‘লাই’ দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার গুরু। এ প্রজন্ম যাকে চেনে শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী, তোমাকে বলে দেবো কী যে একা দীর্ঘ রাত গানের, সঞ্জীব... গাড়ি চলে না চলে না’র সঞ্জীব চৌধুরী হিসেবে।
আমরা সঞ্জীব দা’র লাই পাওয়া দলের সেই ‘একস্লিপ’, ‘দূরের জানালা’, ইষ্টিকুটুম বাহিনীর সদস্য হয়ে যখন ‘মানুষ পড়া’ তত্ত্বের পাগলা সাংবাদিককে চিনতে শুরু করেছি, তখন ভোরের কাগজেও ৩/৪ বছর কাজের অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে।
তো, প্রতিদিনই আমার এই ফিচার, ওই লেখা, সেই রিপোর্ট নিয়ে প্রশংসা করেন, সঞ্জীবদা, আর আমি পাত্তা দিই না।
একদিন আমাকে নিয়ে গেলেন শ্রদ্ধেয় ছফা ভাইয়ের কাছে।
ছফা ভাই আমাকে দেখেই বললেন, কাজল... (সঞ্জীব চৌধুরীর ডাকনাম কাজল) এটা মুন্নী সাহা? আমিতো মনে করেছিলাম কোনও ব্যাটাছেলে। ইষ্টিকুটুমদের জন্য লেখে, মেয়েদের নাম দিয়ে!
আমি ‘জি’ বলে ছফা ভাইকে সালাম করে বসতে না বসতেই ছফা ভাই বললেন– ‘ও মেয়ে আপনার ভারী মিষ্টি হাত, লিখবেন। যা মন চায় লিখবেন!’
ছফা ভাই আমার কাছে মহাগুরু। সঞ্জীবদা’র গুরু বলে কথা!
আজকের কাগজের ডেস্ক থেকে ভোরের কাগজের ডেস্ক, ফিচার পাতা, ইষ্টিকুটুমের সম্পাদনার জার্নির সময়কালটা পেরুতে পেরুতেই সঞ্জীবদার ‘লাইয়ে’ আমি একটু বেয়াদব হয়েছি বইকি! ওস্তাদ সঞ্জীব কোনও কিছু লিখতে বললে, আমি ‘পেংছেং’ করি। তো ছফা ভাইয়ের ওই প্রশংসা, নির্দেশ বিরাট একটা অস্ত্র হলো দাদার।
চোখ কুঁচকে গালি দিতো একটু শ্লেষ কটাক্ষের ভঙ্গিতে, ‘আহমদ ছফা প্রশংসা করেছেন, সেই অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না, মুন্নী?’
ওই গালিটাকে আমি ভয় পেতাম। আর ভয়ে ভয়ে সব কাজ করে দিতাম, লিখতাম। যেকোনও অ্যাসাইনমেন্ট করতে গিয়ে সঞ্জীবদা’র কাছ থেকে অ্যাঙ্গেল বুঝে নিয়েই লেখা লিখতাম। এ কারণেই আজকের ‘আমিটা’ যতটুকু, যা হতে পেরেছি তার যদি বিন্দুমাত্র ভালো কিছু থাকে, ওটা সঞ্জীবদা’রই শ্রম আর কেয়ার।
আজ ‘সে-ই গালিটা’ মিস করি। খুব...
একজন বন্ধু- গাইড-গুরু-সহমর্মী-সহকর্মী... ‘জেনুইন সঞ্জীবদা’ মিস করি।
শুভ জন্মদিন স. চৌ…
লেখক: সাংবাদিক