X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে মমতার বিপর্যয় বিচিত্র নয়

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
২৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১৪:৪৯আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১৪:৫৬

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী ভারতে গণতন্ত্র চর্চার সুনাম সুখ্যাতি ছিল। এখন তার অবসানের পর্ব শুরু হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে গোয়ায় বিজেপির চিন্তন বৈঠকে ভারতের ধনবাদী গোষ্ঠী বিজেপিকে বাধ্য করেছিল গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থী নির্বাচিত করার জন্য। নরেন্দ্র মোদি দুই দফায় ১০ বছর গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং তার মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময় গুজরাট রাজ্যের উন্নয়নে চমক সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরু সমাজতন্ত্রের গোড়াপত্তন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সার্থক হয়েছিলেন ধনতন্ত্রের বিকৃত উৎকর্ষ সাধনে। নেহরু, ইন্দিরা, রাজীব তিনজনই তাদের কল্পিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিই অনুসরণ করেছিলেন। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় এলে পরিপূর্ণভাবে বাজার অর্থনীতি অনুসরণের পথ বেয়ে চলতে থাকে। ভারতের পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর তাই কামনা ছিল। তারা নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছিল। মোদি তাদের স্বার্থই রক্ষা করে চলছেন।

২০১৪ সালে বিজেপির নির্বাচনি প্রচারণা ছিল ধনবাদী অর্থনীতির অনুকূলে। তখন বিজেপির মারমুখী প্রচারণা ছিল ক্ষমতার প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে কংগ্রেসকে উৎখাত করার অভিলাষ। দুই দুইবার নরেন্দ্র মোদি লোকসভায় জিতে সরকার গঠন করেছেন। এখন বিজেপির চেষ্টা হচ্ছে রাজ্যস্তরে স্থানীয় দলগুলোকে উচ্ছেদ করা। এবার ২০২১ সালের এপ্রিল-মে মাসে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচন। আর বিজেপির টার্গেট হচ্ছে পশ্চিম বাংলা থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার উচ্ছেদ করা। তৃণমূল কংগ্রেস আঞ্চলিক দল এবং পশ্চিম বাংলায় তার শক্ত অবস্থান রয়েছে।

গত দুই বিধানসভার নির্বাচনে জিতে রাজ্য সরকার গঠন করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হয়ে রাজ্য চালিয়েছেন। ২০২১ সালের এপ্রিল-মে মাসে পুনরায় বিধানসভার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি সমস্ত শক্তি নিয়ে পশ্চিম বাংলায় নেমেছে। তাদের দৃঢ় সংকল্প তারা মমতার সরকারকে এবার পরাজিত করবে। বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায়। সুতরাং সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। বিজেপি নির্বাচনে টাকা খরচ করতে আর ক্ষমতার অপব্যবহার করতে দ্বিধা করে না। তাই মনে হচ্ছে এবারের নির্বাচনে মমতাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।

পুলিশ প্রশাসন রাজ্যের এখতিয়ারে কিন্তু পশ্চিম বাংলার বিধানসভার নির্বাচন নাকি এবার রাজ্যে পুলিশের দায়িত্বে অনুষ্ঠিত হবে না। এখানে নাকি কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্রের পুলিশ পাঠাবে। কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হচ্ছেন অমিত শাহ, তার কাছে ন্যায় অন্যায়ের বাচবিচার কম। পশ্চিম বাংলায় মুসলিম ভোট ২৭% কিন্তু হায়দারাবাদের ওয়াইসি নাকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কেন্দ্রে তার এমআইএম দলের পক্ষ থেকে মুসলিম প্রার্থী দাঁড় করাবেন। কয়দিন আগে বিহারের বিধানসভা নির্বাচনেও তিনি অনুরূপ কাণ্ড করেছিলেন আর বিহারে তার পাঁচজন প্রার্থী বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। বিহারে যদি ওয়াইসি প্রার্থী না দিতেন তবে রাষ্ট্রীয় জনতা দল আর কংগ্রেস জোট হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে রাজ্য সরকার গঠন করতে পারতো। পশ্চিম বাংলায়  অনুরূপ অবস্থা সৃষ্টি হওয়া বিচিত্র নয়। তৃণমূল কংগ্রেস ওয়াইসি এবং ফুরফুরার পীর সাহেবের সঙ্গে সমঝোতা করা উচিত।

ওয়াইসিকে বিজেপির দাদাল, ভোট কাটুয়া নামে ডাকে অনেকে। কিন্তু তার যুক্তি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ দাবিদার দলগুলোর মুসলমানদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। অনেক রাজ্যে মুসলিমরা এসব অসাম্প্রদায়িক দলকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে, কিন্তু পরে এসব দলের বিধায়কররা নিজের দল ছেড়ে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার পরিবর্তনে সহায়তা করেছে। ফলে মুসলমানরা এদেরকে ভোট দিয়ে কোনও লাভ নেই।

কংগ্রেস আর বামফ্রন্ট জোট করেছে। পশ্চিম বাংলায় সাধারণ ভোটারদের মাঝে বিজিপি প্রীতি বেড়েছে আর ভারতীয় ভোটারেরা আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান নয়। পুরনো বামফ্রন্ট কর্মীরাও বামফ্রন্ট ত্যাগ করে গত দুই নির্বাচনে বিজেপির পক্ষে কাজ করতে দেখা গেছে। একের পর এক মমতার দলের বিধায়করা বিজেপিতে যোগ দিচ্ছে। নির্বাচনের আগেই তৃণমূল সমর্থকরা হতাশ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। এর আগে ত্রিপুরার মতো ছোট একটা রাজ্যের রাতারাতি ভোটের হাওয়ায় বিজেপি পয়সা ছিটিয়ে নিজের পক্ষে নিয়ে গেছে। বিজেপি পশ্চিম বাংলা বিধানসভার নির্বাচনে বস্তা বস্তা টাকা ছিটানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। পয়সা খরচের ব্যাপারে মমতারও ক্ষমতা রয়েছে, তবে তা বিজেপির সমান নয়। বিজেপি ফ্রান্স থেকে রাফায়েল যুদ্ধ বিমান ক্রয় করতে গিয়ে কমিশন বাণিজ্যে শত শত কোটি টাকা পেয়েছে। ধনবাদী গোষ্ঠী রয়েছে তার পেছনে।

ভারত আগে পাকিস্তানকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতো, এখন কিন্তু ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে চীন। এবং ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীনের হাতে পরাজয় বরণের পর যখন ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হন, তখন চীন-ভারত সীমান্তে ব্যাপক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করেছিলেন এবং সীমান্ত সুরক্ষার জন্য আধুনিক সমরাস্ত্র মোতায়েন করেছেন। ভুটান সীমান্তে গত বছর ঠিকাদারি করতে গিয়ে ভারত আর চীনা বাহিনী মুখোমুখী হয়েছিল, কিন্তু ভারতীয় সৈন্য এক ইঞ্চিও পিছপা হয়নি। লাদাখেও কয়েকটা ছোট ছোট সংঘর্ষ হয়েছে চীনের হাতে ভারতের ২০ জন সৈন্য নিহত হয়েছে কিন্তু আন্তর্জাতিক মিডিয়া বলেছে ভারতের হাতে চীন যে পরিমাণ সৈন্য রসদ হারিয়েছে তা ভারতের চেয়ে বেশি। ইন্দিরা গান্ধী ১৭ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আর তার ১৭ বছর সময়ে তিনি চীন সীমান্তের সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে খুবই যত্নবান ছিলেন। ভারতের এ যাবৎ যারা প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তাদের মাঝে ইন্দিরা গান্ধীই ছিলেন সাহসী এবং চীন মোকাবিলায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এখন দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদিও ইন্দিরায় অনুরূপ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ছয় দশকে চীন আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়, ইন্দিরা গান্ধীও সেই দশকের শেষের দিকে আণবিক বোমার মালিক হন।

ইন্দিরার প্রতি ভারতীয় ভোটাররা একনিষ্ঠ ছিল নরেন্দ্র মোদিকেও তারা অপছন্দ করে না। আর আপাতত নরেন্দ্র মোদির কোনও বিকল্প প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থীও নেই। তাই বলা যায় ভারতীয় ভোটারদের মনোভাব নরেন্দ্র মোদির অনুকূলে। সুতরাং রাজ্য পর্যায়ে স্থানীয় দল উচ্ছেদের যে পরিকল্পনা বিজেপি করেছে, তার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা অসম্ভব নয়। সুতরাং বলা যায় আগামী এপ্রিলে পশ্চিম বাংলা বিধানসভার নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেস হয়তো পরাজিত হতে পারে। তবে এখন মমতা প্রবীণ নেতাদের পর্যায়ে পৌঁছেছেন। তিনি কঠোর পরিশ্রমী। তার প্রতি ভোটারেরা সদয় হওয়া বিচিত্র নয়। দুর্নীতির বড় মাপের কোনও অভিযোগও নেই তার বিরুদ্ধে। আর গত এক মাসব্যাপী ভারতে কৃষক বিদ্রোহ চলছে। তারও একটা সুফল তৃণমূল পেতে পারে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ