X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
গানের শিল্পী, গ্রামোফোন, ক্যাসেট ও অন্যান্য: পর্ব ১৪ (খ)

পংকজ-রাইচাঁদ জুটি: বাংলা ও হিন্দি সিনেমায় প্লে-ব্যাক শুরুর ইতিহাস

শহীদ মাহমুদ জঙ্গী
১৩ নভেম্বর ২০২২, ১৬:০৬আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২২, ১৬:৫১

নির্বাক ছবির যুগ। তখন সিনেমা বা ছবি বলা হতো না, বলা হতো বায়স্কোপ অথবা বই। নির্বাক ছবিতেও মিউজিকের ব্যবস্থা থাকতো। ছবি শুরু হতো পর্দায়। ফিল্মের গল্প এগিয়ে যেতো, গল্পের বিভিন্ন মুহূর্তের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হলে পর্দার আড়ালে বসে ছবির আবহসংগীত উপস্থাপন করতে হতো। 

সেই সময়ে, একদিন ইম্প্রেসারিও হরেন ঘোষ বেতার অফিসে এলেন। তিনি পংকজ কুমার মল্লিক ও রাইচাঁদ বড়ালকে ছবিতে মিউজিক দিতে পারবে কিনা জানতে চাইলেন। পংকজ ও রাইচাঁদের সিনেমার মিউজিক সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না। হরেন ঘোষের সঙ্গে কথা বলে তারা তাদের করণীয় সম্পর্কে ধারণা পান। দুজনেই নতুন এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সম্মত হন। 

হরেনবাবু তাদের জানান, ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্রাফট’ নামের একটি কোম্পানি এই নির্বাক ছবিটি তৈরি করছে। ছবির নাম ‘চোরকাঁটা’। কলকাতার শ্যামবাজারে ‘চিত্রা’ সিনেমা হাউজে ছবির প্রদর্শন হবে। পংকজ-রাইচাঁদ যুগলকে সেই ছবির মিউজিক করতে হবে। 

নির্বাক ছবির মিউজিক সিনেমা হলের মঞ্চের পাশে যে স্থানে বসে পরিবেশন করা হতো, সেই স্থানকে মিউজিক বক্স বলা হতো। মিউজিক বক্সে যন্ত্রশিল্পীরা একসঙ্গে বসে আবহসংগীত পরিবেশন করতেন। 

হরেনবাবুর সঙ্গে কথাবার্তা পাকা হয়ে যাওয়ার পর পংকজ ও রাইচাঁদ কাজে নেমে পড়লেন। বেতারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যোগ্য যন্ত্রশিল্পীদের নিয়ে একটি টিম গঠন করলেন। দুজনেই ছবির গল্প ভালো মতো পড়লেন। সংগীত পরিকল্পনা তৈরি করলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী নিজেদের তৈরি সুর তো ব্যবহার করলেনই, কিছু কিছু জায়গায় রবীন্দ্রনাথের গানের সুরও ব্যবহার করলেন। এভাবেই রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিও নির্বাক ছবিতে যুক্ত হয়েছিল। 

ইন্টারন্যাশনাল ফিল্মক্রাফট-এর পর তৈরি করলো আরও একটি নির্বাক ছবি। নাম ‘চাষার মেয়ে’। এবারও পংকজ ও রাইচাঁদ সংগীত পরিচালনায়। এবারও নিজেদের সুরের সঙ্গে রবীন্দ্রসুর যুক্ত করা হলো। তবে সময় একটু বেশি পাওয়াতে পংকজ- রাইচাঁদ জুটি আরও সুন্দরভাবে এবারের কাজটি গুছিয়ে করলেন। 

দুটি ছবির মিউজিকই দর্শকদের প্রশংসা অর্জন করেছিল। 

সবাক ছবির সূচনা লগ্নে ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্রাফট নতুন নামে পরিচিত হলো। নতুন নাম—নিউ থিয়েটার্স লিমিটেড।কোম্পানির সর্বময় কর্তা বীরেন্দ্রনাথ সরকার বাংলা ছবির ঐতিহাসিক যাত্রায় প্রধানতম ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলেন। ১৯৩১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নিউ থিয়েটার্স কোম্পানি হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করে। 

১৯৩১ সালের ১৪ মার্চ উপমহাদেশের প্রথম সবাক ছবি ‘আলম আরা’ মুক্তি পায়। একই বছর ১১ এপ্রিল স্বল্পদৈর্ঘ্য সবাক বাংলা ছবি ‘জামাই ষষ্ঠী’ মুক্তি পায়। একই বছরের ৩০ ডিসেম্বর বাংলায় প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক ছবি ‌‘দেনা-পাওনা’ মুক্তি পায়। শরৎচন্দ্রের কাহিনি নিয়ে ছবিটি প্রযোজনা করেছিল নিউ থিয়েটার্স। পরিচালনা করেছিলেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী আর ক্যামেরায় ছিলেন নীতীন বসু।
 
এই ছবির সংগীত পরিচালনা করেছিলেন পংকজ ও রাইচাঁদ। 

পংকজের জন্য নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গৌরবের বিষয়, তিনি প্রথম বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য বা ফিচার ফিল্মের দুজন সংগীত পরিচালকের অন্যতম একজন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। 

জীবনে প্রথম সবাক ছবির সংগীত পরিচালনায় যুক্ত থেকে, ঐতিহাসিক কাজটি করতে পেরে, স্বাভাবিকভাবেই পংকজ বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিলেন। কিন্তু ছবিটি যখন মুক্তি পেলো, ছবির টেলপে দেখা গেলো সংগীত পরিচালক হিসাবে রাইচাঁদের নাম দেওয়া হয়েছে বড় করে, তার নিচে অনেক ছোট অক্ষরে পংকজের নাম! অথচ দুজনেই সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব সমানভাবে পালন করেছেন। তাছাড়া পংকজ এককভাবে ছবির গানের সুর করেছেন বলেও দাবি করেন। 

সেই সময় তিনি খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। ব্যাপারটাকে তার প্রতি নিউ থিয়েটার্স-এর বৈষম্য ও অবহেলা ধরে নিয়ে মানসিকভাবে যন্ত্রণাময় সময় পার করেছেন। তবে যখন বয়স বেড়েছে, তখন নামের বড়-ছোট বিষয়টা নিয়ে তার ভাবনা প্রকাশ করেছেন অন্যভাবে— ‘কেন এই অবিচার? এই মর্মভেদী প্রশ্ন আমাকে সেই মুহূর্তে আলোড়িত করেছিল। আজ প্রবীণ বয়সে যে কথা মনে পড়লে হাসি পায়, সেদিন সে কথা অশ্রুমোচন করিয়েছিল।’

‘দেনা পাওনা’র পর দ্বৈত ও এককভাবে মিলিয়ে পংকজ প্রচুর ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন। 

শুরুতে প্লেব্যাক মিউজিকের ধারণা না থাকায় গানে লিপসিং হতো না। ডায়লগ থ্রোয়িংয়ের মতো অভিনেতা-অভিনেত্রীকেই  পর্দায় নিজ কণ্ঠে গান করতে হতো।

পংকজ কুমার মল্লিক সিনেমায় অভিনয়ে ইচ্ছুকদের, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে যারা অভিনয় করতে চান, তাদের অভিনয়ের সঙ্গে গানও জানতে হতো। এই দুই গুণধারী অভিনয়শিল্পী পাওয়া বেশ মুশকিল ছিল। যে কারণে শুরুর দিকে অভিনয়শিল্পীর সংকট ছিল প্রকট। প্লে-ব্যাক প্রথা চালু না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট তীব্র ছিল। 

নীতীন বসু নিউ থিয়েটার্সের আলোকচিত্র পরিচালক। পরে তিনি নিজ যোগ্যতায় চিত্র পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরিচালক হিসাবে তার প্রথম ছবি হিন্দি ‘দেবদাস’। দ্বিতীয় ছবি বাংলা ‘ভাগ্যচক্র’ এবং একই ছবির হিন্দি রূপ ‘ধূপছাও’। 

পংকজ নিউ থিয়েটার্সে বেতনধারী সংগীত পরিচালক ছিলেন। কাজেই উনাকে নিয়ম করেই স্টুডিওতে যেতে হতো। নীতীন পংকজের পাশের পাড়ার লোক। পূর্বপরিচিত। প্রতিদিন স্টুডিওতে যাওয়ার সময় গাড়িতে পংকজকে তুলে নিতেন।

‘ভাগ্যচক্র’ পরিচালনার সময় নীতীনের কাজ বেড়ে যায়। তিনি খুব সকাল সকাল স্টুডিওতে যেতেন। একদিন নীতীন আসার সময় হয়েছে, সেই সময়ে পাশের বাড়িতে সেকালের বিখ্যাত একটি ইংরেজি গানের রেকর্ড বাজছিল। 

প্যাগান (Pagan) ছায়াছবির গান। রামন নোভারো’র (Ramon Novarro) গাওয়া, গানের কথা—
‘Come with me where moonbeams 
light Tahitian skies 
And the starlit waters linger in your 
eyes 
Native hills are calling, to them we 
belong
And we’ll cheer each other with the 
Pagan love song. 

পংকজ এই গানের সঙ্গে নিজেও গলা মিলিয়েছেন। গানে পুরোপুরি ডুবে আছেন। এদিকে নীতীন এসে হাজির। অপেক্ষা করছেন। পংকজ বুঝতেই পারেননি। গান শেষ হয়। 

পংকজের বাবা এসে খবর দেন নীতীন এসেছেন। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে গাড়িতে ওঠেন। নীতীন গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। চুপচাপ। পংকজ একটু ভয় পেলেন। ভাবলেন আজ কিছুক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে, সে কারণে হয়তো রেগে গেছেন। পংকজ দেরি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনও ফল হয় না, নীতীন কোনও উত্তর দেয় না। 
নীতীন পথে একবার গাড়ি থেকে নামলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন। হাতে সদ্য কেনা কিছু ম্যাগাজিন। অফিসে এসে যে যার রুমে চলে গেলেন। 

নীতীন কিছুক্ষণ পর পংকজকে ডেকে পাঠান। পংকজ এলে, পথে কেনা ম্যাগাজিনের মাঝখান থেকে একটি রেকর্ড বের করেন। পংকজ বুঝতে পারেন ম্যাগাজিনের সঙ্গে নীতীন রেকর্ডও কিনেছেন। রেকর্ডটি গ্রামোফোনে চাপিয়ে দেন। গান বাজতে শুরু করে। গানটি ছিল রামন রোভারো-এর গাওয়া সেই ইংরেজি গান, সকালে যেই গানের সঙ্গে পংকজ গলা মিলিয়েছেন। 

রেকর্ড চালিয়ে দিয়েই নীতীন নির্দেশ দিলেন, ‘পংকজ, শিগগির ওটার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গা, ঠিক বাড়িতে যেমন গাইছিলি— নে, নে, কুইক।’

পংকজ কিছু না বুঝেই গান শুরু করলেন। তিনি লক্ষ করলেন নীতীন বিভিন্ন দিক থেকে তাকে নিরীক্ষণ করছেন। গান শেষ হওয়ার পরপরই আনন্দে নীতীন নাচতে থাকেন। তিনি যে একটি অফিসে আছেন সেটাই ভুলে যান, বলতে থাকেন- ‘পেয়েছি রে পংকজ পেয়েছি! এতদিনে যে কত বড় সমস্যার সমাধান হলো!’

পংকজ নীতীনকে পুতুলদা বলে সম্বোধন করতেন। এরপর পংকজের বয়ানে—‘আমি তো তার নর্তনের ধাক্কায় হিমশিম খাচ্ছি। সমস্ত ব্যাপারটা বুঝলাম কয়েক মুহূর্ত পরে এবং ভারতীয় সিনেমার এমন এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের প্রথম ও প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে রইলাম, যে মুহূর্তে প্লে-ব্যাক পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটলো। শুধুই কি সাক্ষী! নিজের অজ্ঞাতেই আমি এই ঘটনার প্রধান চরিত্র হয়ে গেলাম, যদিও এই আইডিয়ার আবিষ্কর্তা আমি নই, স্বয়ং চিত্র-পরিচালক নীতীন বসু মহাশয়। একটা যুগান্তর ঘটে গেল নিঃশব্দে, অথবা অতি সামান্য শব্দেই। একা পুতুলদার চিৎকারে কতটুকুই বা শব্দতরঙ্গ  তুলতে পেরেছিল! ভারতীয় ফিল্ম-শিল্পে প্লেব্যাক প্রথার জনক হিসেবে সেদিন থেকেই তিনি অমরত্ব লাভ করলেন।’

নীতীন উদ্ভাবিত আইডিয়ার ওপর কাজ করলেন, নীতীন বসু নিজেই, তার ভাই রেকর্ডিস্ট মুকুল বসু, পংকজ কুমার মল্লিক ও রাইচাঁদ বড়াল। নিউ থিয়েটার্সের এই চার জন ১৯৩৫ সালে বাংলা ও হিন্দি ভাষাতে নির্মিত সিনেমা ‘ভাগ্যচক্র’ এবং ‘ধূপছায়া’তে  প্রথম প্লে-ব্যাক প্রথা চালু করেন। 

উপমহাদেশের সিনেমার জন্য এ এক অসাধারণ অর্জন। একটি সমবেত সংগীতের জন্য প্লে-ব্যাক করেছিলেন সুপ্রভা ঘোষ (সরকার), পারুল চৌধুরী (ঘোষ) ও উমাশশী দেবী। পংকজের মতে, ভারতে প্রথম প্লে-ব্যাক গায়িকার সম্মান তাদেরই প্রাপ্য। 

তবে এই প্লে-ব্যাক নিয়েও কিছু বিতর্ক তৈরি করেছিলেন হীরেন বসু। তিনি ১৯৮২ সালে দাবি করেন, মেহবুবের ছবি ‘মনমোহন’-এ তিনিই প্রথম প্লে-ব্যাক করেছিলেন। কিন্তু ‘মনমোহন’ ছবিটি ১৯৩৬ সালে মুক্তি পেয়েছিল। আর ‘ভাগ্যচক্র’ ও ‘ধূপছায়া’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৩৫ সালে। কাজেই হীরেন বসুর দাবির যুক্তিসঙ্গত কোনও ভিত্তি ছিল না। 

সবাক চলচ্চিত্রের সূচনা লগ্ন থেকেই পংকজ অনেক ছবির সংগীত পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন, যেমন- প্রেমাঙ্কুর আতর্থী পরিচালিত, ‘দেনা পাওনা’, ‘সুবহ কী সিতারা’, ‘কপালকুণ্ডলা’। দেবকী বসুর পরিচালনায় ‘চণ্ডিদাস’। সৌরেন সেন পরিচালিত ‘রূপকথা’ ও ‘রূপকাহিনি’ (হিন্দি)। প্রমথেশ বড়ুয়ার পরিচালনায় ‘মুক্তি’ (বাংলা ও হিন্দি), ‘দেবদাস’ ও ‘রূপলেখা’। নীতিন বসু পরিচালিত ‘ভাগ্যচক্র’, ‘ধূপছায়া’ (ভাগ্যচক্রের হিন্দি), ‘দেশের মাটি’, ‘ধরতি মাতা’ (হিন্দি), ‘কাশীনাথ’ (বাংলা ও হিন্দি) এবং দিদি( বাংলা ও হিন্দি)। অমর মল্লিকের পরিচালনায় ‘বড় দিদি’ (বাংলা ও হিন্দি)। 
ফনী মজুমদারের পরিচালনায় ‘কপালকুণ্ডলা’ (হিন্দি)। সুবোধ মিত্রের পরিচালনায় ‘ডাক্তার’( হিন্দি), ‘দুই পুরুষ’ ও ‘রাইকমল’। প্রফুল্ল রায় পরিচালিত ‘অভিজ্ঞান’। কার্তিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘মহাপ্রস্থানের পথে’। মধু বসু পরিচালিত ‘মীনাক্ষী’ (বাংলা ও হিন্দি)। ইন্দর সেনের পরিচালনায় ‘চিত্রাঙ্গদা’ (বাংলা ও হিন্দি)। তপন সিংহ পরিচালিত ‘লৌহকপাট’। পল জিলস পরিচালিত ‘জলজলা’ (রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’-এর হিন্দি) এবং জ্ঞান মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘সম্রাট’। 

ইতোমধ্যে দুটি বিষয় সামনে চলে আসে, প্রথমটি হচ্ছে কলকাতার সবচেয়ে নামিদামি কোম্পানি নিউ থিয়েটার্স-এর রমরমা অবস্থার অবসান এবং দ্বিতীয়ত, বোম্বের (এখনকার মুম্বাই) ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সবদিক থেকে এগিয়ে যাওয়া। 

তারমধ্যে বোম্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল, ছবির জন্য বড় বাজেট। ছবিতে যারা কাজ করেন তাদের জন্য ভালো পেমেন্ট, সঙ্গে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, যা সেই সময় কলকাতায় পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। তাই ভালো প্রস্তাব এবং ভবিষ্যৎ চিন্তা করে, তখন অনেকে বোম্বে চলে যান। 

বোম্বে থেকে ভালো প্রস্তাব পংকজের জন্যও এসেছিল। কিন্তু তিনি কলকাতায় থেকে যান। এমনকি যখন নিউ থিয়েটার্সের মালিক বীনেন্দ্রনাথ সরকার কোম্পানির পড়তি অবস্থার কথা উল্লেখ করে, পংকজকে বোম্বের মতো টাকা দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয় জানিয়ে, বোম্বে চলে যাওয়ার অনুমতি দেন, তখনও তিনি যাননি। নিজ জীবনে নিউ থিয়েটার্সের অবদানের কথা চিন্তা করে পংকজ বোম্বের অফার ফিরিয়ে দেন। 

চলচ্চিত্রে প্রথম থেকেই গানের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সিনেমার গান গীতিকারদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। নতুন নতুন গীতিকার তৈরি হতে থাকে। সিনেমার জন্য গান লিখছেন, এমন সব গীতিকারের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। তখন নিউ থিয়েটার্স প্রযোজিত বাংলা সিনেমার জন্য যারা গান লিখেছেন তাদের মধ্যে ছিলেন বাণীকুমার, অজয় ভট্টাচার্য, শৈলেন্দ্রলাল রায়, সজনীকান্ত, সৌরিন্দ্রমোহন মুখাপাধ্যায় প্রমুখ। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের অনুমতি নিয়ে তার গানও নিউ থিয়েটার্সের ছবিতে থাকতো। 

হিন্দি সিনেমার জন্য গীতিকারদের মধ্যে ছিলেন আসগর হোসেন শোর, আরজু লখনৌবি, পণ্ডিত ভূষণ, পণ্ডিত সুদর্শন ও রমেশ পাণ্ডে। 

অনেক শিল্পীই পংকজের সুরে সিনেমার জন্য গান গেয়েছেন। সেই গান আবার রেকর্ড করেছেন। তাদের অনেকেই পংকজের প্রিয় ছিলেন। তাদের মধ্য প্রথম দিকে— সায়গল, সুপ্রভা ঘোষ (সরকার) ও পারুল চৌধুরী( ঘোষ)। পরবর্তী প্রজন্মের শৈল দেবী, ইলা ঘোষ (মিত্র), সুধা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধারানী, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নিঃসন্দেহে গীতা দত্ত। 

চলবে…

(১৪তম পর্বে আরও একটি অংশ (গ) আছে। সেটির শেষে এই পর্বের সবগুলো তথ্যসূত্র দেওয়া হবে)

লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও গীতিকবি

আরও:

পর্ব ১: অ্যাঞ্জেলিনা ইয়ার্ড থেকে সুপার স্টার গওহর জান হয়ে ওঠার ইতিহাস

পর্ব ২: শিল্পীদের আয়ের বিজ্ঞানসম্মত পথ খুলে দেয় গ্রামোফোন

পর্ব ৩: গান-বাণিজ্যে গওহর জান নায়িকা হলে, লালচাঁদ বড়াল নায়ক

পর্ব ৪: ‘সেকালের কলকাতার লোকেরা ছিলেন সংগীত-ছুট’

পর্ব ৫: রেকর্ডিং কোম্পানিগুলোর কাছে যোগ্য সম্মানি পাননি কে. মল্লিক

পর্ব ৬: অমলা দাশের কারণেই অনেক প্রতিভাবান শিল্পী এসেছিলেন

পর্ব ৭: প্রথম রেকর্ড হাতে পেয়ে ইন্দুবালা নিজেই ভেঙে ফেলেন!

পর্ব ৮: টাইটানিক থেকে ঢাকা, রেডিওর গপ্পো

পর্ব ৯: দৃষ্টি হারিয়েও সেই যুগের শ্রেষ্ঠ গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে

পর্ব ১০: আঙ্গুরবালা দেবীর গান গাইতে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শিল্পী ভয় পেতেন

পর্ব ১১: ভারতে গীতিকার হিসেবে প্রথম সম্মানী পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ 

পর্ব ১২: সাহানাকে রবীন্দ্রনাথ: আমি যদি সম্রাট হতুম, তোমাকে বন্দিনী করতুম

পর্ব ১৩: রবীন্দ্রনাথের পরে দিলীপকুমারের ওপরেই দাবি ছিল সর্বাধিক

 
/এমএম/এমওএফ/
সম্পর্কিত
‘পদ্মশ্রী’ প্রাপ্তিতে সংগীত ঐক্যর পক্ষ থেকে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে ফুলেল শুভেচ্ছা
‘পদ্মশ্রী’ প্রাপ্তিতে সংগীত ঐক্যর পক্ষ থেকে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে ফুলেল শুভেচ্ছা
৫০-এ সোলস: ব্যান্ডের লোগো নির্বাচন ও গান লিখতে পারবেন আপনিও
৫০-এ সোলস: ব্যান্ডের লোগো নির্বাচন ও গান লিখতে পারবেন আপনিও
রবীন্দ্রনাথের সকল গানের ভাণ্ডারি দিনেন্দ্রনাথ
গানের শিল্পী, গ্রামোফোন, ক্যাসেট ও অন্যান্য: পর্ব ১৬রবীন্দ্রনাথের সকল গানের ভাণ্ডারি দিনেন্দ্রনাথ
নজরুল-আব্বাসউদ্দীন: ইসলামি গান সৃষ্টি ও জনপ্রিয়তার নেপথ্য গল্প
গানের শিল্পী, গ্রামোফোন, ক্যাসেট ও অন্যান্য: পর্ব ১৫ (গ)নজরুল-আব্বাসউদ্দীন: ইসলামি গান সৃষ্টি ও জনপ্রিয়তার নেপথ্য গল্প
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
অবশেষে মুক্তির বার্তা
অবশেষে মুক্তির বার্তা
হলিউডের প্রস্তাব ফেরালেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফেরালেন ক্যাটরিনা!
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি জয়া
নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি জয়া