X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১
গানের শিল্পী, গ্রামোফোন, ক্যাসেট ও অন্যান্য: পর্ব ১৪ (গ)

পংকজের কণ্ঠ-সুর: কবিগুরু থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত

শহীদ মাহমুদ জঙ্গী
০৫ ডিসেম্বর ২০২২, ১৫:৫৩আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০২২, ১৯:১৯

১৯১১ সাল। পঞ্চম জর্জের অভিষেক। পরাধীন দেশে, স্কুলে স্কুলে অনুষ্ঠান হচ্ছে। পংকজ কুমার মল্লিক তখন স্কুলে নিচের ক্লাসের ছাত্র। স্কুলের এক শিক্ষক একটি গান তৈরি করে ফেললেন। প্রথম লাইনটি ছিল ‘হে ভারত আজি রাজার চরণে কর রে ভক্তি দান।’ অনুষ্ঠানে গানটি গাওয়ার জন্য শিক্ষক মশাই পংকজকে পছন্দ করলেন এবং গানটি শিখিয়ে দিলেন। সেই হিসাবে ১১ বছর বয়সেই কোনও অনুষ্ঠানে পংকজের প্রথম গান গাওয়া। 

গানটি গেয়ে এসে বাসায় উৎসাহের সঙ্গে অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিচ্ছিলেন, নিজের গান গাওয়ার কথা বলছিলেন, ওই সময় ওনার মেজো জামাইবাবু বাড়িতে ছিলেন। জামাইবাবু এলেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে একের পর এক গান গাইতেন। পংকজের গান গাওয়ার কথা শুনে তিনি থিয়েটারের কিছু গান তাকে শেখালেন। গানগুলোর মধ্যে ছিল, ‘জয়দেব’ গীতিনাট্যের বিখ্যাত গান- ‘এই বলে নূপুর বাজে’, গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘বলিদান’ নাটকের গান, ‘উলু নয়, রোদন ধ্বনি, প্রাণ কাঁপে শাঁখের ডাকে’, এছাড়াও এই যাত্রায় শেখানো গানের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলালের গান ছিল।
 
বলা যেতে পারে, সেটাই পংকজের গান শেখার শুরু। স্কুলে গান গাওয়া, জামাইবাবুর কাছে গান শেখা শিশু পংকজের মধ্যে উৎসাহের জোয়ার এলো। তিনি ভাবলেন গানের জন্য হারমোনিয়াম বাজানো শেখা দরকার। একটি হারমোনিয়ামের ব্যবস্থাও করতে পারলেন। কিন্তু কার কাছে হারমোনিয়াম বাজানো শিখবেন?
 
শেষ পর্যন্ত নিজে নিজেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়লেন। শুরু করলেন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাওয়ার চেষ্টা। ‘এই বলে নূপুর বাজে’ গানটি দিয়েই শুরু। গানের সুর চিন্তা করে রিড চাপছেন কিন্তু ভেসে আসছে অন্য সুর। অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর ‘এই’ শব্দটির সুর হারমোনিয়ামে তুলতে পারলেন। আনন্দিত পংকজ চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। খুব কঠিন হলেও আস্তে আস্তে পুরো গানটিই হারমোনিয়ামে তুলতে সক্ষম হলেন। 

কলেজে পড়াকালে পংকজ দুর্গাদাসবাবুর কাছে গান শিখতেন। ইতোমধ্যে গানের গলা কিছুটা তৈরি হয়েছে। পছন্দের কবিতায় নিজে নিজে সুরও দিচ্ছেন। একদিন গান শিখতে গিয়ে দেখেন দুর্গাদাসবাবু ঘরে নাই। একা বসে আছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘চয়নিকা’ বইটি চোখে পড়লো। ‘সঞ্চয়িতা’ তখনও প্রকাশ হয়নি। সঞ্চয়িতার পূর্বসূরি ‘চয়নিকা’ তুলনামূলক ছোট আকারের।

পংকজ বইটি হাতে নিলেন। খুলতেই ‘চির আমি’। পড়ে মুগ্ধ হলেন। তিনি তখন পর্যন্ত জানতেন না ‘চির আমি’ কবিতা নাকি গান। মুগ্ধতার মধ্যেই কিছুটা সময় কেটে গেলো। তারপর, নিজের অজান্তেই সুর দিতে লাগলেন। তার মন উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। তিনি ঘরে বসে থাকতে পারলেন না। পাশেই, ছোট একটা পার্ক ছিল। গণেশ পার্ক। সেই পার্কে চলে গেলেন। বসলেন গাছের ছায়ায়, বেঞ্চিতে। সেখানে বসেই বাকি সুর দেওয়া সম্পন্ন করলেন। সুর দেওয়া শেষ হলে, তার মন আনন্দে নেচে উঠলো। রবীন্দ্রনাথকে সবাই তখন রবিবাবু বলে ডাকতেন। রবিবাবুর লেখা বাণীতে পংকজ সুর দিয়েছেন, এই ভাবনায় তিনি আনন্দে আপ্লুত হলেন। 

এরপর তিনি ‘আনন্দ পরিষদ’-এ গেলেন। সেখানে  একটি অর্গান ছিল। এবার অর্গানে সুর তুলে, গলা মেলাতে লাগলেন। ‘উঁহু, উঁহু, একটু একটু যেন অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে’-  পেছন থেকে কণ্ঠ ভেসে আসলো। 
পংকজ চমকে ফিরে দেখেন- লক্ষ্মীনারায়ণ মিত্র।
 
পংকজ বললেন, ‘কী বলছেন লক্ষ্মীদা, আপনার কথার মানে আমি বুঝতে পারছি না। এটা তো রবি ঠাকুরের কবিতা, আজই আমি নিজে নিজে সুর লাগিয়েছি…’।

লক্ষ্মীনারায়ণ উত্তরে বললেন, ‘সে কী, এটা তো রবি ঠাকুরের একটা গান, ওর নিজেরই সুর দেওয়া আছে। আর, তুমি তো তাই গাইছো, মাঝে মাঝে সামান্য তফাৎ হচ্ছে।’ 

পংকজের হৃদয়-মন বিস্ময়ে আনন্দে আচ্ছন্ন হয়ে যায়।
 
তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘আমি যে ঠিক কী বলেছিলাম এরপর, তা আজ আর মনে নেই। হয়তো বলে উঠেছিলাম- বিশ্বাস করুন লক্ষ্মীদা, গানটি শোনা দূরের কথা, কবিতাটির বাণীই এই প্রথম আমার চোখে পড়লো। বিশ্বাস করুন, এটা আমার নিজের সুর, এই মাত্র নিজে নিজে লাগিয়েছি …। কিন্তু একি! একি বিস্ময় এলো আমার জীবনে! আমি কেবল সুর দিতেই পারি না, কবির দেওয়া সুরের সঙ্গে আমার সুর কিনা প্রায় মিলে যায়!’ 

এই ঘটনা পংকজের মধ্যে নতুন ধরনের আস্থা তৈরি করে। এবং বলা যেতে পারে সুরের জগতে তার প্রবেশের ইচ্ছাকে আরও দৃঢ় করে। সেদিন তার মধ্যে, আরেকটি হৃদয় ছোঁয়া ইচ্ছার জন্ম হয়, সেটা হচ্ছে রবিবাবুর গান শেখা। 

আর তার ভাষায় যাকে তিনি প্রতিদিন শত শত প্রণাম করেন, তিনি হচ্ছেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দিনেন্দ্রনাথ তাকে শিখিয়েছেন গান। দিনেন্দ্রনাথ থেকেই তিনি প্রথম রবীন্দ্রসংগীত শেখেন, গানটি ছিল- হেরি অহরহ তোমারি বিরহ ভুবনে ভুবনে রাজে হে...। 

কৈশোরের স্বপ্ন ছিল ওস্তাদ গায়ক হবেন কিন্তু রবীন্দ্রসংগীত তার পথ বদলে দিলো। একদিকে রবীন্দ্রসংগীত চর্চা, অন্যদিকে সুরারোপ, এই দুটি ক্ষেত্রেই তখন তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। 

ওই সময়ে গানের প্রতি এমনভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছেন যে গানের জন্য সমস্ত সময় ব্যয় করেছেন। ১৯২২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন (এসএসসি) পাস করার পর বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন। এখানেই কলেজ জীবনে শুরু ও শেষ। 

পড়া শেষ করতে না পারার দুঃখ তার মধ্যে কাজ করতো। তিনি এই দুঃখ সহজ করে নিতেন তার মতো করে। তিনি লিখেছেন- ‘রবীন্দ্রনাথ, শুনেছি, একবার একটি মেয়েকে তার প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার কথা শুনে নাকি বলেছিলেন- তাই নাকি গো, তবে তোমার সাথে সাবধানে কথা কইতে হয়, আমি যে নন-ম্যাট্রিক!’ (প্রবেশিকা/মেট্রিক এখনকার এসএসসি সমমানের)।
 
তিনি হাস্যরস করে লিখেছেন- ‘ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে কবিগুরুর চেয়ে বিদ্যান হয়েছিলাম বটে, তবে কলেজের পাঠ পুরোপুরি সাঙ্গ করতে পারিনি।’ 

‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা পরা ওই ছায়া ভুলালো রে ভুলালো মোর প্রাণ’ রবীন্দ্রনাথের কবিতা। রবীন্দ্রনাথের সম্মতি না নিয়েই পংকজ এই কবিতায় সুর দিয়েছেন। তিনি গানটি  সমানতালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইতেন। এই সংবাদ কবিগৃহে পৌঁছে যায় যে বিনা অনুমতিতে কবির কবিতায় সুর দেওয়া হয়েছে এবং নিয়মিত গাওয়া হচ্ছে। ঠাকুর বাড়ির কারও সঙ্গে তখনও পংকজের পরিচয় ঘটেনি, কিন্তু তার সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য ঠাকুর বাড়িতে ততদিনে পৌঁছে গেছে। একদিন পংকজকে ডেকে পাঠালেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ।

পংকজ গেলেন ঠাকুর বাড়িতে। রথীন্দ্রবাবুর সাথে দেখা হলো। পংকজ বিনয়ের সাথে ডাকার কারণ জানতে চাইলেন। রথীন্দ্রনাথ পংকজকে বসতে বলে প্রশ্ন করলেন, ‌‘আপনি নাকি বাবামশাইয়ের কী একটা ছায়া ছায়া গান গেয়ে থাকেন?’ পংকজ ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলেন, ‘কোন গানের কথা বলছেন ঠিক বুঝতে পারছি না তো।’ সেই সময়ে বারান্দা দিয়ে এক মহিলা যাচ্ছিলেন… রথীন্দ্রনাথ তাকে ডেকে বললেন, ‘আচ্ছা রমা তোমার কি মনে আছে সেদিন কোন গানের কথা হচ্ছিল? ইনি এসেছেন, এরই নাম পংকজ কুমার মল্লিক।’

রমা বললেন, ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা-পরা ওই ছায়া’। তারপর যোগ করলেন, ‘কিন্তু গান নয় তো ওটা, ওটা তো একটা কবিতা।’
 
রথীন্দ্র বাবু এবার পংকজের কাছে জানতে চাইলেন এই লেখাটি উনি কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন। পংকজ এবার ভয় পেলেন। রথীন্দ্রনাথ এরপর কী বলতে পারেন ভেবে তিনি শঙ্কিত হলেন, অনেকটা মরিয়া হয়েই মিথ্যা বললেন, ‘গানের বইতে আছে।’
 
কবিপুত্র এবার বিস্মিত হলেন। গানের বইতে আছে অথচ তারা জানেন না। রথীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের জবাবে পংকজ জানালেন, গানের স্বরলিপিও আছে। বইটি এক বন্ধু  নিয়েছেন। বন্ধু কাশী গেছেন। ফিরলেই বইসহ তিনি আবার আসবেন। রথীন্দ্রনাথ আর কিছু বললেন না। 

একমাস পর কবিপুত্র স্বাক্ষরিত চিঠি পেলেন। তারিখ ও সময় নির্ধারণ করে পংকজকে ডাকা হয়েছে। চিঠিতে স্বাক্ষরকারী যদিও কবিপুত্র, কিন্তু চিঠির সারমর্ম হচ্ছে রবীন্দ্রনাথই এবার পংকজকে ডেকেছেন।
 
শঙ্কিত হলেন কিন্তু একই সাথে অনাবিল আনন্দে মন ভরে গেলো। কবির সঙ্গে সামনা-সামনি দেখা হবে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে? বিনা অনুমতিতে কবির কবিতা সুর করার জন্য সব অপরাধ স্বীকার করার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে পংকজ নির্দিষ্ট দিন ঠাকুর বাড়িতে গেলেন।
 
প্রথমেই কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে হলো। রথীন্দ্রনাথ সরাসরিই বললেন, তিনি জানতে পেরেছেন ‘দিনের শেষে’ কবিতার সুর পংকজই করেছেন। এবং কবিগুরু পংকজের কণ্ঠে গানটি শুনতে চেয়েছেন। 

রথীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে তিনি কবির ঘরে গেলেন। ঘরের একপাশে তক্তপোষে কবি। ঘরে আরও আট জন মতো ছিলেন। 

বাকিটুক পংকজের লেখায়—

‘ঘরের এককোণে ছিল অনুপম একটি অর্গান। হ্যামিলটনের বাড়ির সেই সংগীতযন্ত্রটিকে শুধু অর্গান না বলে একখণ্ড মনোরম আসবাব বললেই ভালো হয়। রথীন্দ্রবাবুর ইংগিতে অর্গানটিতে বসলাম। তারপর ধীরে ধীরে কবির বাণী গাইতে শুরু করলাম আমার সুরে স্বয়ং কবির সম্মুখে। দেখতে পাচ্ছি, কবি তখনও চোখ বুজে রয়েছেন, অস্ফুটভাবে কী বলছেন মাঝে মাঝে।’
 
‘তার সামনে ছোট একটি ডেস্কের ওপরে রয়েছে কিছু বই, কাগজ, কলম আর হরেক রকমের নানা-রঙের পেন্সিল।’ 

‘আমি তখন ভয়ে ঘর্মাক্ত হয়ে যাচ্ছি। গলা শুকিয়ে উঠছে। আড়চোখে কবির  দিকে গানের ফাঁকে ফাঁকে তাকাচ্ছি। কবি কিন্তু অচঞ্চল, আধো-নয়নে আত্মসমাহিত হয়ে আছেন, মাঝে মাঝে অস্ফুটভাবে কী যেন উচ্চারণ করছেন। গানও শুনছেন সতর্কভাবে তাও বুঝতে পারছি।’ 

‘সন্ত্রস্ত কণ্ঠে কোনমতে গান তো শেষ করলাম। কবির দিকে চেয়ে দেখি তিনি আরও ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েছেন। হয়তো বড় কিছু ভাব এসেছে মনে, তন্ময় হয়ে যাচ্ছেন; একটু পরেই তার লেখনী একটি অনুপম কবিতা সৃষ্টি করবেন। আমি দেখলাম সকলেই একে একে পা টিপে টিপে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন।’

পংকজ গান শেষ করে সেদিন আর দেরি করেননি। পাশের দরজা দিয়ে নিচে নেমে রাস্তায়। অন্য কোথাও না গিয়ে, সোজা নিজের ঘরে চলে গেলেন। 

‘দিনের শেষে’ নিয়ে পংকজের মধ্যে প্রগাঢ় আবেগ কাজ করতো। তার জীবনের গল্পে এই গান বিশাল এক অংশজুড়ে আছে। 

পরিচালক অভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়া ১৯৩৫ সালে ‘মুক্তি’ ছবি পরিচালনায় হাত দেন। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৩৭ সালে। এই ছবির সংগীত পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয় পংকজকে। একই সঙ্গে তিনি গায়ক ও অভিনেতার ভূমিকায়ও ছিলেন। ছবির প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার দায়িত্বও তাকে দেওয়া হয়। এই সুযোগে তিনি ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটি ছবিতে ব্যবহারের জন্য কবির অনুমোদন নিয়ে আসেন। গানটি ‘মুক্তি’ ছবিতে ব্যবহার করা হয় এবং গানের রেকর্ডও প্রকাশ করা হয়। 

কবি বেঁচে থাকা অবস্থায় কবির কবিতায় সুর দেওয়া এবং রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন পাওয়াকে বিশাল প্রাপ্তি বলে মনে করতেন পংকজ। ‘দিনের শেষে’ বহু দশক ধরেই শ্রোতাদের প্রিয় গান হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। 

পংকজ কুমার মল্লিক কিন্তু এই গানের সুর সেই সময়ের বেতার গায়ক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র নিজের বলে দাবি করেছিলেন। এই বিষয়ে লেখক গবেষক সন্তোষ দে যোগাযোগ করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সঙ্গে । সন্তোষ দে লিখেছেন, ‘‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তাকে জানান, শ্যামবাজারের এক ধনীগৃহের বৈঠকখানায় নিয়মিত গানের আসরে পংকজবাবু এবং বীরেনবাবু দুজনেই প্রায়শই যেতেন। সেখানেই তিনি তার দেওয়া সুরে ‘দিনের শেষে’ গানটি বন্ধু পংকজবাবুর কণ্ঠে তুলে দেন।’’

সন্তোষ দে লিখেছেন—এরপর ‘মুক্তি’ ছবির পরিচালক রাইচাঁদ বড়াল গানটি শুনে খুশি হয় এবং চিত্রপরিচালক প্রমথেশ বড়ুয়াকে শোনালে তিনি গানটি পছন্দ করেন। প্রশ্ন ওঠে রবীন্দ্রনাথের অনুমতি নেওয়ার। রাইবাবু খবর নিয়ে জানলেন, রবীন্দ্রনাথ তখন বরানগরে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের বাসভবন ‘আম্রপলি’তে আছেন। রাইচাঁদ কবির কাছে গেলেন। সঙ্গে নিলেন পংকজবাবুকে। পংকজবাবুর কণ্ঠে গানটি শুনে কবি পছন্দ করলেন। ওই সময় সেখানে প্রশান্ত চন্দ্রের ভাই প্রফুল্লচন্দ্র উপস্থিত ছিলেন। তিনি সন্তোষ দে-কে জানান, কবি গান শুনে খুব পছন্দ করেছিলেন। 

সন্তোষ দে জানাচ্ছেন, পুরো ঘটনা পংকজকে যখন বলেন, তখন পংকজ বীরেনের সুর দেওয়ার বিষয় মেনে নেন। 
প্রথমত বীরেন্দ্রের দাবি পংকজ মেনে নেননি। তার আত্মজীবনীতে বরং তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন যে শেষ বয়সে এসে তাকে এই ধরনের কথা শুনতে হচ্ছে যে ‘দিনের শেষে’র সুর অন্য কেউ করেছে।
 
দ্বিতীয়ত বলা হয়েছে ছবির সংগীত পরিচালক রাইচাঁদ, আসলে সংগীত পরিচালক ছিলেন পংকজ। বলা হয়েছে রাইচাঁদ গিয়েছিলেন পংকজকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে। সে সময় প্রফুল্লচন্দ্র উপস্থিত ছিলেন। প্রফুল্লচন্দ্র বলেছেন রবীন্দ্রনাথ গান শুনে খুব পছন্দ করেছিলেন। কবিগুরুর পছন্দের কথা বলেছেন। কিন্তু গানের সুরকার নিয়ে প্রফুল্লচন্দ্রের কোনও বক্তব্য নেই। 

গান যখন ছবিতে ব্যবহার হয়, এবং রেকর্ড আকারে বাজারে আসে তখনও রবীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন। এই গান নিয়ে নিজের জীবনীতে যখন সবিস্তারে পংকজ লিখলেন তখনও রাইচাঁদ বেঁচে ছিলেন। ১৯৮১ সালের ২৫ নভেম্বর রাইচাঁদ ইহলোক ত্যাগ করেন। পংকজের জীবনী প্রকাশের পর দীর্ঘ সময় তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু পংকজের সঙ্গে দ্বিমত করেছেন এমন কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। 

সিনেমার সংগীত পরিচালক হিসাবে পংকজ সফল ছিলেন। এই সফলতার পেছনে তার শিক্ষকসত্তারও অবদান আছে। অত্যন্ত চমৎকারভাবে তিনি গায়ক-গায়িকার কণ্ঠে গান তুলে দিতেন। পংকজের কাছে ‘মুক্তি’ ছবির গান শেখার বিষয়ে প্রখ্যাত অভিনেত্রী ও গায়িকা কানন দেবী স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে, ‘‘পংকজবাবুর গান শেখানোর ভঙ্গিটি ছিল বড় আকর্ষণীয়। সুর ও কথার ব্যঞ্জনা এমন সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন যে মনের প্রতি পরতে যেন গাঁথা হয়ে থাকতো। ওঁর কাছে আমার প্রথম শেখা গান ছিল ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’। শেখাবার আগে কি দরদ দিয়েই না উনি রবীন্দ্রনাথ ও তার গানের দর্শন বুঝিয়ে দিতেন। সেদিনের প্রত্যেকটি কথা আজও কানে বাজে। উনি বলেছিলেন গাইবার সময় একটা কথা সবসময় মনে রেখো, ‘সবার রঙ’-এ গানটি হোলির গান নয়, পূজোর গান।”

এরপর তিনি কাননকে ছবিতে এই গান দেওয়ার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন। গানের মাধ্যমে কী বোঝাতে চাইছেন তাও তিনি বুঝিয়ে দেন। কাননের ভাষ্যে, ‘নানাদিক থেকে নানা অনুভবের ছবি মেলে ধরে পংকজবাবু মনকে যেন সুরে বেঁধে দিতেন।’

শিক্ষকতার এই অসাধারণ প্রতিভা নিয়েই পংকজ বেতারের সংগীত শিক্ষার আসরের মাধ্যমে রবীন্দ্রসংগীত যেমন শিল্পীদের শিখিয়েছেন, একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন। যে কারণে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পংকজকে রবীন্দ্রসংগীতের যুগস্রষ্টা বলে প্রশংসা করেছেন। 

পংকজের গান মানুষ পছন্দ করতেন। পংকজ নিজে কোন গানগুলো পছন্দ করতেন? তিনি বলেছেন, গায়কের পক্ষে নিজের শ্রেষ্ঠ গান পছন্দ করা সম্ভব নয়। গায়কের শ্রেষ্ঠ গান শ্রোতারাই পছন্দ করতে পারেন। তারপরও রবীন্দ্রসংগীতের বাইরে তিনি নিজের কিছু পছন্দের গানের কথা জানিয়েছেন, দীর্ঘ না করা পছন্দের তালিকায় আছে-
বাণীকুমার রচিত ‘প্রভু আঁধার পারাবারে ফোটাও আলোর শতদল’, অজয় ভট্টাচার্য রচিত ‘যবে কণ্টক পথে হবে রক্তিম পদতল’, অজয় রচিত ‘ওরে চঞ্চল, এপথে এই যাওয়া’, একই গীতিকবির ‘শেষ হলো তোর অভিযান’। হিন্দি গানের মধ্যে উনি স্মরণ করেছেন- কত্থক নাচের বোলের ওপর, আরজু লখনৌবি রচিত ‘পিয়া মিলনকো জানা’, পণ্ডিত মধুর রচিত ‘তেরে মন্দির কা হূ’দীপক জল্ রাহা’, পণ্ডিত ভূষণ রচিত ‘তু ঢু’ঢতা হৈ জিসকো বস্তীমে য়া কী বন মে’, ফৈয়াজ হাশেমী রচিত ‘ইয়ে রাত ইয়ে মৌসম  ইয়ে হ’সনা হ’সানা’। 

১৯৫৯-এ দিল্লিতে প্রথম আকাশবাণী টেলিভিশন সম্প্রচার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যাপ্তি ছিল ওই নগরকে কেন্দ্র করে পঞ্চাশ মাইল ব্যাসার্ধ পর্যন্ত। এই টেলিভিশন কেন্দ্রের উদ্বোধনী গানটি ছিল রবীন্দ্রসংগীত, ‘তোমার আনন্দ ওই এলো দ্বারে, এলো এলো এলো গো ওগো পুরবাসী”- গেয়েছিলেন পংকজ।
 
এভাবেই বিভিন্ন ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন পংকজ। সংযুক্ত হয়েছিলেন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধেও। সেই সময়ে পি জি হাসপাতাল, রবীন্দ্রসদন ও শ্রীশিক্ষায়তন হলে চ্যারিটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সবক’টি অনুষ্ঠানে পংকজ গান গেয়েছিলেন। অনুষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত টাকা যুদ্ধরত বাংলাদেশকে পাঠানো হয়েছিল। 

পংকজের জন্ম- ১০ মে ১৯০৫। মৃত্যু- ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮। 

চলবে...

লেখক: গবেষক, গীতিকবি ও প্রাবন্ধিক

তথ্যঋণ:
Revathi Krisnan: Mehboob, director of ‘Mother India’ who actually wanted to be actor’.
The Print. May 25, 2019. 
HQ Chowdhury: Incomparable Sachin Dev Burman.
শিলাদিত্য সেননিউঃ “উদ্যোগপতি থেকে সিনেমার নতুন যৌবনের দূত” আনন্দবাজার পত্রিকা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৯। 
সন্তোষকুমার দে ‘কবি কণ্ঠ ও কলের গান’ 
India today, March 14, 2016: “ First Indian  talkie film Alam ara was released on this day: Top silent era films” 
পংকজকুমার মল্লিক: ‘আমার যুগ আমার গান’
কানন দেবী: ‘সবারে আমি নমি’

আরও:

পর্ব ১: অ্যাঞ্জেলিনা ইয়ার্ড থেকে সুপার স্টার গওহর জান হয়ে ওঠার ইতিহাস

পর্ব ২: শিল্পীদের আয়ের বিজ্ঞানসম্মত পথ খুলে দেয় গ্রামোফোন

পর্ব ৩: গান-বাণিজ্যে গওহর জান নায়িকা হলে, লালচাঁদ বড়াল নায়ক

পর্ব ৪: ‘সেকালের কলকাতার লোকেরা ছিলেন সংগীত-ছুট’

পর্ব ৫: রেকর্ডিং কোম্পানিগুলোর কাছে যোগ্য সম্মানি পাননি কে. মল্লিক

পর্ব ৬: অমলা দাশের কারণেই অনেক প্রতিভাবান শিল্পী এসেছিলেন

পর্ব ৭: প্রথম রেকর্ড হাতে পেয়ে ইন্দুবালা নিজেই ভেঙে ফেলেন!

পর্ব ৮: টাইটানিক থেকে ঢাকা, রেডিওর গপ্পো

পর্ব ৯: দৃষ্টি হারিয়েও সেই যুগের শ্রেষ্ঠ গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে

পর্ব ১০: আঙ্গুরবালা দেবীর গান গাইতে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শিল্পী ভয় পেতেন

পর্ব ১১: ভারতে গীতিকার হিসেবে প্রথম সম্মানী পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ 

পর্ব ১২: সাহানাকে রবীন্দ্রনাথ: আমি যদি সম্রাট হতুম, তোমাকে বন্দিনী করতুম

পর্ব ১৩: রবীন্দ্রনাথের পরে দিলীপকুমারের ওপরেই দাবি ছিল সর্বাধিক

 
/এমএম/এমওএফ/
সম্পর্কিত
‘পদ্মশ্রী’ প্রাপ্তিতে সংগীত ঐক্যর পক্ষ থেকে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে ফুলেল শুভেচ্ছা
‘পদ্মশ্রী’ প্রাপ্তিতে সংগীত ঐক্যর পক্ষ থেকে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে ফুলেল শুভেচ্ছা
৫০-এ সোলস: ব্যান্ডের লোগো নির্বাচন ও গান লিখতে পারবেন আপনিও
৫০-এ সোলস: ব্যান্ডের লোগো নির্বাচন ও গান লিখতে পারবেন আপনিও
রবীন্দ্রনাথের সকল গানের ভাণ্ডারি দিনেন্দ্রনাথ
গানের শিল্পী, গ্রামোফোন, ক্যাসেট ও অন্যান্য: পর্ব ১৬রবীন্দ্রনাথের সকল গানের ভাণ্ডারি দিনেন্দ্রনাথ
নজরুল-আব্বাসউদ্দীন: ইসলামি গান সৃষ্টি ও জনপ্রিয়তার নেপথ্য গল্প
গানের শিল্পী, গ্রামোফোন, ক্যাসেট ও অন্যান্য: পর্ব ১৫ (গ)নজরুল-আব্বাসউদ্দীন: ইসলামি গান সৃষ্টি ও জনপ্রিয়তার নেপথ্য গল্প
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
একযুগ পর দলছুট, সঙ্গে সঞ্জীব চৌধুরী
একযুগ পর দলছুট, সঙ্গে সঞ্জীব চৌধুরী
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
এই জন্মদিনে আরেক সিনেমার ঘোষণা
এই জন্মদিনে আরেক সিনেমার ঘোষণা