X
মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪
২৪ বৈশাখ ১৪৩১

বুদ্ধদেব বসু সাম্রাজ্যবাদীর সিম্বল

দাউদ হায়দার
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:০৮আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৮:৩২

দাউদ হায়দার বঙ্গদেশে উপাধি বিতরণে আমরা অকৃপণ। কবে থেকে এই ধ্যাষ্টামো বলতে অপারগ। ঈশ্বরচন্দ্র হয়ে যান ‘বিদ্যাসাগর’। বঙ্কিম ‘ঋষি’, ‘সাহিত্যসম্রাট’। শরৎচন্দ্র ‘কথাশিল্পী’ (যেন আর কোনও লেখকের লেখায় কথার শিল্পবুনন নেই!)। নজরুল ‘বিদ্রোহী’। জসীমউদ্‌দীন ‘পল্লিকবি’। জীবনানন্দ ‘রূপসী বাংলার কবি’। আল মাহমুদ ‘ভাটি বাংলার কবি’। আর রবীন্দ্রনাথ?– বহুবিধ বিশেষণে ভূষিত। এই ভূষণ একজন লেখককে গণ্ডিবদ্ধ করা, বিশেষভাবে চিহ্নিতকরণ,সন্দেহ নেই। এর বাইরে আর যেন পরিচয় নেই।
আল মাহমুদকে একবার এক সমালোচক ‘ভাটি বাংলার কবি’ উল্লেখ করেছিলেন তাঁর লেখায়। আল মাহমুদ তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ভাটি বাংলার কবি কী জিনিস? আপনি-আমি কী বাংলাদেশের বাইরের? শহরে থেকে কবিতা লিখলেই কী শহুরে কবি? বাংলায় কয়টি শহর? বাংলার বিস্তীর্ণ জনপদ গ্রামীণ। গ্রামেই অধিকাংশ মানুষের বাস। বাংলার মানুষের সুখ-দুঃখগাথাই মূল জীবনচরিত,বাংলা কবিতার মৌলিক উপাদান। আমি বাংলার বাইরের ভিনগ্রহের নই। আমার কবিতা দেশ মাটি জলহাওয়ায় সিক্ত।’

সম্ভবত, ‘ভাটি বাংলার’ অপবাদ সইতে না পেরে জসীমউদ্‌দীনকে নিয়ে একটি লেখায় আল মাহমুদ বলেন, ‘বাংলার ত্রিশের কবিরা নায়ক-নায়িকার রূপবর্ণনার উপমায় বিদেশের প্রতীক আকছার ব্যবহার করেছেন, পুরানের দাসত্ব মেনেছেন, কিন্তু জসীমউদ্‌দীন নায়কের রূপ ভাটি বাংলার খাঁটি চিত্র অঙ্কিত করেছেন, ‘মুখখানি তার নতুন চরের মতো।’ এই চিত্ররূপ বাংলা কবিতার আসল সৌন্দর্যে ভরপুর।’

নিজের কবিতার কথা বলেননি। তাঁর কবিতায় অজস্র উপমা আছে, বিস্তর প্রতীক আছে, যা আজ প্রবাদে পরিণত।

আমাদের মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি-প্রাবন্ধিক-অনুবাদক-অধ্যাপক, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে, বাংলা আধুনিক কবিতা পড়াচ্ছিলেন একবার, উপমা-অন্তমিল প্রসঙ্গে আল মাহমুদের ‘তোমার হাতে’ কবিতা প্রসঙ্গ টানেন। ‘তোমার হাতে ইচ্ছে করে খাওয়ার/ কুরুলিয়ার পুরনো সেই কই ভাজা;/ কাউয়ার মতো মুন্সী বাড়ির দাওয়ায়। দেখবো বসে তোমার ঘষা মাজা/ বলবে নাকি, এসেছে কোন গাঁওয়ার?’

কেবল দুই বাংলার ভাটি বাংলার নয় গ্রামীণশহরে, শহরেও চলতি কথায় কাউয়া (কাক), গাঁইয়া (গ্রাম। গাঁওয়ার) অহরহ শুনি। ঢাকাইয়া কথ্যভাষা ‘পুংটা পোলা’ (পাজি ছেলে) তাঁর কবিতা নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

বাংলাদেশের একজন তথাকথিত প্রগতিশীল কবি, শহরে যাঁদের বাস, আল মাহমুদকে ‘ভাটি বাংলার, গ্রামীণ কবি’ আখ্যায়িত করেছেন, মূলত ঈর্ষায়। আল মাহমুদকেই যথার্থ পাঠক বুক টেনেছেন,টানায়, আল মাহমুদের বিরুদ্ধে অপবাদ বিস্তারিত। ‘তিনি জামায়াতে ইসলামী’, তিনি মৌলবাদী।’ ইত্যাদি।

ঠিক যে, আল মাহমুদ জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র ‘দৈনিক সংগ্রাম’-এ সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেছেন (গুজব, জামায়াতের নেতা যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের জীবনী লিখেছেন।), জামায়াতে ইসলামীর সাহিত্য সংস্থা (প্রকাশনা) ‘আধুনিক’-এর অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন। কেন কাজ করেছেন, ‘আধুনিক’-এ যুক্ত, কৈফিয়ত তাঁর, ‘আট সন্তানের জনক আমি। শিল্পকলা একাডেমি থেকে অবসরের পরে চাকরি নেই। অবসর ভাতা নেই। দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম। বাঁচামরা। বাধ্য হয়ে ‘সংগ্রাম-এ সম্পাদকীয় লেখা। কিন্তু আদৌ মৌলবাদী নই। মৌলবাদের সমর্থক নই, মৌলবাদের পক্ষে সাফাই গাইনি কখনও।’

-গাননি তবে, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না কাব্যগ্রন্থ (প্রকাশ: ১৯৮০) থেকে ভিন্ন মোচড়। গ্রন্থের প্রথম কবিতা হজরত মোহাম্মদকে নিয়ে। ইসলাম নিয়ে কিছু কবিতা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে ইসলাম, ইসলামধর্ম, ইসলামের জয়গাথা কবিতায় সোচ্চার। গভীরভাবে লক্ষ করলে বোঝা যাবে, যা বুঝেছেন শিবনারায়ণ রায়, বলেছেন আল মাহমুদের এই পর্বের কবিতা বিষয়ে, ‘ধর্ম নয়,আধ্যাত্মিক কবিতা।’

আশ্চর্য, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কাব্যগ্রন্থ রচনার পরে ‘মোহভঙ্গ’। আবার ফিরেছেন ‘ভাটি বাংলায়’। কিন্তু অপবাদ ঘোচেনি। অপবাদ মৃত্যুতেও।

আল মাহমুদের একাডেমিক শিক্ষা বেশি নয়, ম্যাট্রিকও পাস করেননি, কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে প্রথমে একটি মাসিক পত্রিকায় সামান্য কাজ, পরে দৈনিক ইত্তেফাক-এ প্রুফ রিডার। প্রুফ রিডারের পদ থেকে ‘মফস্বল পৃষ্ঠা’র দায়িত্বে। তখন থেকে ‘সাংবাদিক’। বলতেন মজা করে, ‘ভাটি বাংলাকে চিনেছি। যা আমার, আমাদের ধমনীতে।’

আল মাহমুদ কখনও বিপ্লবী ছিলেন না, ধর্মীয়ও নন। পাকেচক্রে বিপ্লবী। ধর্মীয়। মূলে দারিদ্র্য। স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ঘনিষ্ঠ হয়েছেন। এরশাদ সাহায্য করেছেন। ঢাকায় আড়াই কাঠা জমি দিয়েছেন, বাড়ি বানানোয় অর্থ জুগিয়েছেন।

আল মাহমুদকে ১৯৬৬ সাল থেকে জানি। আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন একদা, অগ্রজ জিয়া হায়দারের (কবি। প্রাবন্ধিক। অধ্যাপক। নাট্যকার। বাংলাদেশের বহুমান্য নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা) বন্ধু। একই বছরে (১৯৩৬) দুজনের জন্ম।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে (১৯৭১) আল মাহমুদ কলকাতায় আশ্রিত। দুঃখকষ্ট বিপর্যয়ে দিনযাপন। কলকাতার নামী কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে ফিরে কয়েক মাস বেকার। বিধ্বস্ত দেশ। এই সময়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধুয়ো তুলে ‘বিপ্লবী জাসদ’ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) রাজনৈতিক পার্টি। পার্টির মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠ। আল মাহমুদ সম্পাদক। প্রেসক্লাবে একদিন দেখা, সম্বোধন, ‘ওই মিয়া, সরকারের বিচিত্রায় (সাপ্তাহিক) যোগ দিয়েছ। গণকণ্ঠে আসো। ফিচার সম্পাদক হবে।’ চার মাস ছিলুম। পরে ‘দৈনিক সংবাদ’-এ সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্বে। একটি কবিতার কারণে জেলে অন্তরীণ। জেলের ‘আটখাতায়’ দিব্যি আছি। মাস কয়েক অতিক্রান্ত। এক সন্ধ্যায়, গোটা জেলজুড়ে মহা হৈ চৈ। কারণ কী? জাসদের কর্মীরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি আক্রমণ করেছে, কর্মীরা জেলে। পরদিন সকালে শুনলুম কর্মীরাই শুধু নন, নেতারা এবং গণকণ্ঠের সম্পাদকও জেলে। ওল্ড হাজতে।

জেলারকে, জেল সুপারকে বিস্তর বলে-কয়ে, মিনতি জানিয়ে ওল্ড হাজতে গেলুম। গিয়ে দেখি আল মাহমুদ। একটানা তিন মাস একসঙ্গে।

আল মাহমুদের বিপ্লব তখনও শুকিয়ে যায়নি। দিনরাত নানা গল্প। কলকাতার গল্প। কলকাতার কবি-সাহিত্যিকের গল্প। আমরা পড়ি মার্ক্স, এঙ্গেলস-এর বই। আল মাহমুদ বাড়ি থেকে আনিয়েছেন ‘বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ (ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত)। দিনরাত পড়েন। শব্দ নোট করেন। কবিতা লেখেন। কবিতায় আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেন। কবিতা পড়ে শোনান। এক সন্ধ্যায় বিমর্ষ। বললেন ‘বুদ্ধদেব বসু মারা গেছেন’। সারা রাত জেগে পরদিন (সকাল থেকে সন্ধ্যা) লিখলেন, ‘বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎকার’। ৮২ লাইনের কবিতা। শোনালেন। প্রথম শ্রোতা। বলি, ‘বুদ্ধদেবকে বলছেন শাপভ্রষ্ট দেবদূত। বিগলিত সম্ভাষণ। পরে বলছেন সাম্রাজ্যবাদী। অসম্ভব ঘেন্না উচ্চারিত। প্রকাশিত। এই প্রকাশে বুদ্ধদেবের চরিত্র উদঘাটিত।’

আল মাহমুদ বললেন, ‘বুদ্ধদেবের সাহিত্য নমস্য, মানুষ হিসেবে অশ্রদ্ধেয়। ভাবতেই পারছিনে তিনি একদা আমারই কুমিল্লার, বাংলাদেশে। তিনি সাম্রাজ্যবাদীর সিম্বল।’

*(দ্রষ্টব্য: কলকাতার এম সি সরকার থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের কবিতা।’)

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উপজেলা নির্বাচন অর্থ ও সময়ের অপচয় মাত্র: সাইফুল হক
উপজেলা নির্বাচন অর্থ ও সময়ের অপচয় মাত্র: সাইফুল হক
৮ নন্দিত শিল্পীকে নিয়ে আসিফ ইকবালের ‘ঐশ্বর্য’
৮ নন্দিত শিল্পীকে নিয়ে আসিফ ইকবালের ‘ঐশ্বর্য’
ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে: কৃষিমন্ত্রী
ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে: কৃষিমন্ত্রী
মানবাধিকার সমুন্নত রেখে জনগণকে সেবা দিতে আইজিপির নির্দেশ
মানবাধিকার সমুন্নত রেখে জনগণকে সেবা দিতে আইজিপির নির্দেশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ