X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

কোভিড-১৯ এবং ভার্চুয়াল কোর্ট: আমরা কি প্রস্তুত?

মো. সামীর সাত্তার
২৩ এপ্রিল ২০২০, ১৬:২৫আপডেট : ০১ মে ২০২০, ১৩:২৫

মো. সামীর সাত্তার ন্যায়বিচার ও আইনগত সুরক্ষা পাওয়ার বিষয়টি মৌলিক অধিকার, যা বাংলাদেশের সংবিধানের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণের কারণে সম্প্রতি সেই মৌলিক অধিকার স্থগিত রয়েছে। এই মহামারির ফলে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত (কমপক্ষে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত) সারা দেশের আদালত বন্ধ ঘোষণা করা হয়, এতে বিচারাধীন মামলাগুলো সেই সময় পর্যন্ত মুলতবি হয়ে পড়েছে। এটিই যথাযথ সিদ্ধান্ত। কারণ, আদালতে ব্যাপক লোকের উপস্থিতি করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি করে। এজন্য পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সারা বিশ্বের আদালতগুলো স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার করে ‘ভার্চুয়াল কোর্ট’র মাধ্যমে মামলাগুলো পরিচালনা করছে।
অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো প্রযুক্তির দুনিয়ায় তাদের পদচিহ্ন রেখে দিয়েছে। তাদের বিচার ব্যবস্থা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিচার কাজ পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে। আমরাও একই পথে অগ্রসর হচ্ছি, আর দেশে এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। সম্প্রতি শিশুদের বিচারিক আদালতকে ডিজিটালাইজেশনের আওতায় নিয়ে আসার প্রস্তাব দেয় শিশুদের নিয়ে কাজ করা বিশেষ কমিটি ‘দ্য স্পেশাল কমিটি ফর চিলড্রেনস রাইট’। এই সংকটের মধ্যে এই কমিটি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এক জরুরি বৈঠক করে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, মাননীয় প্রধান বিচারপতির অনুমোদন সাপেক্ষে শিশু আদালতের জরুরি মামলাগুলো ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শুনানি করা হবে। এতে কোনও শিশুকে আদালতে উপস্থিত করাও হবে না এবং করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও নেই।

এই ‘ভার্চুয়াল কোর্ট’ স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া সুপ্রিম কোর্টের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। এর অনেক সুবিধা আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—চলমান মামলাগুলো ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে করলে প্রাণঘাতী করোনার বিস্তার প্রশমিত করবে, বিচারকের কার্যকারিতাকে সহজ করবে। এছাড়া আদালতের কার্যক্রম সহজ ও দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করার মাধ্যমে সত্যিকার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। যদিও ‘ভার্চুয়াল কোর্ট’ ধারণাটি বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের (হাইকোর্ট ডিভিশন) বিধি ১৯৭৩ (১৯৭৩ সালের বিধি) মোতাবেক প্রধান বিচারপতি এই পদক্ষেপে গ্রহণ করতে পারেন। এমনকি সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত (suo moto) হয়েও এই উদ্যোগ নিতে পারেন। ১৯৭৩ সালের বিধিমতে, প্রধান বিচারপতি আদালতের বিচারকার্য সুষ্ঠু ও দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করার জন্য যেকোনও কোর্ট পরিচালনার দিকনির্দেশনা (practice directions) জারি করার ক্ষমতা রাখেন। সেই প্রদত্ত ক্ষমতা ব্যবহার করে ভার্চুয়াল আদালতের শুনানি অনুষ্ঠিত হতে পারে। ভারতে করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের মধ্যেও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিচার কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে পরিচালনার জন্য দেশটির সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কয়েকটি দিকনির্দেশনা জারি করেন। ১৯৭৩ সালের বিধিমতে, মাননীয় প্রধান বিচারপতি কাজ সংক্রান্ত কোর্ট পরিচালনার দিকনির্দেশনা (practice directions) জারি করতে পারেন। যার মধ্যে সাধারণ প্রশাসন, শপথ, ই-ফাইলিংয়ের ব্যবস্থা, এফিডেভিটের মতো কাজও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব নির্দেশনার মধ্যে যেখানে বিচারকরা কোথায় বসবেন সেই ‘কোর্ট পয়েন্ট’ হতে পারে। এছাড়া এক বা একাধিক নির্ধারিত ‘রিমোট পয়েন্ট (দূরবর্তী স্থান)’ হতে পারে, যেখানে মামলার শুনানির জন্য আইনজীবী ও সাক্ষী উপস্থিত থাকতে পারেন। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ১৯৭৩ সালের বিধি এবং অন্যান্য বিধানের মধ্যে যদি কোনও অসঙ্গতি থাকে, তাহলে তখন ১৯৭৩ সালের বিধির এক বা একাধিক বিধি সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত করার ক্ষমতাও রয়েছে। 

যাই হোক, যতই সহজ অথবা কার্যকর শোনাক না কেন, ভার্চুয়াল কোর্ট স্থাপনে এর নিজস্ব কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ‘এক সমাধান সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য’ এই ধারণাটি এক্ষেত্রে সঠিক নাও হতে পারে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর কারণে সহজেই ভিডিও কনফারেন্স প্রযুক্তি ব্যবহার করার মতো ভাগ্য সব দেশের নেই। অতএব, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি না করা পর্যন্ত এর সুফল গ্রহণ করা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, জারি করা কোর্ট পরিচালনার দিকনির্দেশনা (practice directions) পালন করা ছাড়াও, ‘রিমোর্ট পয়েন্টে’ মামলাকারীর কাছে ভিডিও কনফারেন্স প্রযুক্তির সুবিধা রয়েছে কিনা, তাও সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের দেখতে হবে। অন্যথায় সুপ্রিম কোর্টের নেওয়া যেকোনও প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ, এটার পেছনে ব্যয় এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ও উন্নতমানের ভিডিও কনফারেন্স প্রযুক্তির ব্যবহার করা। এক্ষেত্রে কৌশলগত উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সমর্থন পাওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।

এছাড়া গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রেও বিশেষ নজর রাখতে হবে। মামলাকারীর ব্যক্তিগত ডিভাইসে মামলার শুনানির রেকর্ড করার মধ্যে গোপনীয় তথ্য প্রকাশ পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা মামলাকারী ব্যক্তি অন্য পরিস্থিতিতে অবৈধ মামলার সুবিধার্থে তা ব্যবহার করতে পারেন। অথবা নিরপরাধ ব্যক্তির অসুবিধার জন্য তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দিতে পারে। ভিডিও কনফারেন্স প্রযুক্তি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিশেষ কোনও চুক্তি না থাকার কারণে আরও অন্য ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে যে প্রশ্নটা করা প্রয়োজন তা হলো—সুপ্রিম কোর্ট সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনও প্রকার চুক্তি বা লিখিত অঙ্গীকার ছাড়াই কি সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশনগুলো ব্যবহার করবে। কোনও সফটওয়্যার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাধারণ নিয়মাবলি ও শর্তগুলো কি কার্যবিবরণীর পবিত্রতা রক্ষা করতে পারবে, যা পৃথক পৃথক মামলাকারী ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে? অধিকাংশ সফটওয়্যার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তথ্য নিয়ে কাজ করার জন্য ক্ষুদ্রাক্ষরে/ছোট প্রিন্টে লেখা ‘নিয়ম ও শর্তাবলি’ ব্যবহার করে এবং তা তাদের পক্ষেই কাজ করে, আর তা তাদের বৃহৎ ক্ষমতা দেয় ব্যবহারকারীর তথ্য নিয়ে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করার বা রেখে দেওয়ার। প্রকৃতপক্ষে, শর্তাবলিগুলো যেকোনও সময়ে একতরফা পরিবর্তন করা সম্ভব যা ব্যবহারকারীদের জন্য বাধ্যতামূলক। উদাহরণস্বরূপ, অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে জুম’র (zoom) গোপনীয়তার নীতিতে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, ‘আমরা সংরক্ষণ বা প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য আপনাদের তথ্য যুক্তরাষ্ট্র অথবা আমাদের কোনও তৃতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তর করতে পারি।’ মামলাগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে এটা যথার্থ নাও হতে পারে, যেখানে মামলাকারীরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না বা ইচ্ছুক নয় তাদের মামলার তথ্য তৃতীয় কোনও পক্ষ সংরক্ষণ করুক, যা তারা নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারে। বিশেষত বর্তমান সময়ে ও যুগে যখন তথ্য ও প্রযুক্তি একে অন্যের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এই সমস্যাটি আরও বেশি, যেহেতু তথ্য সুরক্ষার কোনও কাঠামো নেই, যা গোপনীয়তা লঙ্ঘনের জন্য ব্যক্তিবর্গকে জবাবদিহি করতে পারে। প্রতিটি পদক্ষেপে ‘গোপনীয়তা অধিকারের’ বিষয়টি সরকারের সুবিবেচনায় থাকা উচিত, যেহেতু এটা মৌলিক অধিকার। তথ্য গোপনীয়তা যেকোনও গণতান্ত্রিক দেশের অবিচ্ছেদ্য এবং সর্বদা সংবেদনশীল। কারণ, গোপনীয়তা নাগরিকের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত।

এতে কোনও সন্দেহ নেই, ভার্চুয়াল কোর্ট চালু হলে আমাদের বিচার ব্যবস্থা উপকৃত হবে। আর সময়ের প্রয়োজনেই ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে যেতে হবে। পর্যায়ক্রমে ও সময়োপযোগী পদ্ধতিতে এই প্রযুক্তির ব্যবহার হবে। এই করোনা সংকটের সময়ে ভিডিও কনফারেন্স অবশ্যই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে, যদি এটার প্রয়োগ সঠিকভাবে করা হয়। তাহলে এটা বাংলাদেশের পুরো বিচার ব্যবস্থার দক্ষতা বৃদ্ধি করবে। যাই হোক, ভার্চুয়াল কোর্ট সংক্রান্ত কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করার আগে অবশ্যই ওপরের চ্যালেঞ্জগুলো মাথায় রাখতে হবে এবং সমাধান করতে হবে। অন্যথায় পুরো উদ্যোগটি বিপর্যয় ঘটাতে পারে। যদি মামলাকারীদের বাস্তব পরিস্থিতি এবং সামগ্রিকভাবে সঠিক পদ্ধতিতে প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর সমন্বয় ঘটে, তাহলেই শুধু ভার্চুয়াল কোর্ট কার্যক্রম সফল হবে। ভার্চুয়াল কোর্টই এটার একমাত্র সমাধানের পথ নয়, বরং এটা আবশ্যক যে বাধাহীনভাবে কাজের পরিবেশের জন্য বিভিন্ন স্বতন্ত্র উপাদানকে সাবধানে সংহত করা। এ প্রসঙ্গে যে প্রশ্নটি করা দরকার তা হলো—বাংলাদেশ কি এই কাজের জন্য প্রস্তুত? এবং উত্তর যদি হয় ‘না’, তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমরা কীভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারি।

লেখক: ব্যারিস্টার, সাত্তার এন্ড কোং ‘ল’ ফার্মের প্রধান

/এসএএস/এমএমজে/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
নামাজ চলাকালে মসজিদের এসি বিস্ফোরণ, মুসল্লিদের মধ্যে আতঙ্ক
নামাজ চলাকালে মসজিদের এসি বিস্ফোরণ, মুসল্লিদের মধ্যে আতঙ্ক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ