X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

এবারও কোরবানির চামড়ায় গরিবের হক নিশ্চিত হবে না?

ডা. জাহেদ উর রহমান
২৫ জুলাই ২০২০, ১৭:১৩আপডেট : ২৫ জুলাই ২০২০, ১৭:২১

ডা. জাহেদ উর রহমান এই বছর কোরবানির চামড়ার দাম কত হতে যাচ্ছে? এ সম্পর্কে একটা যৌক্তিক অনুমান করা যাবে,যদি চামড়ার দাম গত বছর কেমন ছিল সেটামনেকরাযায়।এরপরএবারের প্রেক্ষাপট আলোচনা করলেই বুঝতে পারবো আসলে কী হতে যাচ্ছে।
গত বছর ঈদের চামড়ার দাম নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের রিপোর্টের শিরোনাম ছিল—‘৩১ বছরের মধ্যে চামড়ার সর্বনিম্ন দাম’। রিপোর্টের কিছু অংশ এরকম—‘সংশ্লিষ্টরা বলছেন,গত ৩১ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে পশুর চামড়া। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ৮০ হাজার টাকার গরুর চামড়ার দাম দিচ্ছেন ২শ টাকারও কম। এক লাখ টাকার গরুর চামড়া বিক্রি হচ্ছে ৩শ টাকা।’ গত বছর গরুর চামড়ার দাম নেমে এসেছিল আগের বছরের তুলনায় অর্ধেকে। চামড়ার ন্যূনতম মূল্য না পেয়ে মাটিতে লাখ লাখ চামড়া পুঁতে ফেলার বহু ঘটনা পত্রিকায় এসেছে।
খুবই মজার ব্যাপার, ২০১৮ সালেও বাংলা ট্রিবিউন ঠিক একই সময়ে একই রকম রিপোর্ট করেছিল, যার শিরোনাম ছিল—‘৩০ বছরের মধ্যে চামড়ার দাম সর্বনিম্ন’। অর্থনীতির বিবেচনায় এই শিরোনামগুলোর মধ্যে আসলে ভ্রান্তি আছে। চামড়ার দাম আসলে কতটা কমে গেছে,সেটি বোঝার জন্য মুদ্রাস্ফীতিও বিবেচনায় নেওয়া উচিত।

২০১৮ সালের কথাই ধরা যাক। ৩০ বছর আগে যে চামড়া ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল আর ২০১৮ সালে যে চামড়া ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়,মুদ্রাস্ফীতি হিসাব করলে এই দাম ৩০ বছরের তুলনায় কিছুই নয়, প্রায় মূল্যহীন। আর গত বছর যা হয়েছে সেই মূল্য নিয়ে কথা বলাটাই হাস্যকর ব্যাপার। 

গত কয়েক বছর থেকেই কোরবানির ঈদের আগে চামড়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা এক ধরনের প্রেক্ষাপট তৈরি করেন যেটা দেখেই আসলে অনুমান করা যায় সেই বছর চামড়ার দাম নিয়ে কী হতে যাচ্ছে। দেখে নেওয়া যাক এবার তারা কী বলছেন। 

বাংলা ট্রিবিউনের এক রিপোর্টে জানা যায়, চামড়া শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ জানিয়েছেন,২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ট্যানারি শিল্প কোনও ব্যবসা করতে পারেনি। আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়াজাত পণ্যের বাজার ছোট হয়ে গেছে। তাদের কাছ থেকে এটাও জানা যায়, এখন চামড়া শিল্প কারখানায় জমা রয়ে গেছে ৩২শ’কোটি টাকার কাঁচা চামড়া। চামড়া কেনা নিয়ে তারা সিদ্ধান্তহীনতায় থাকলেওচামড়া পাচার হওয়া রোধ করতে আবার চামড়া কেনাও নাকি তাদের ‘কর্তব্য’।

সবকিছুর সঙ্গে করোনার প্রভাবে গোটা বিশ্বে যে অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, সেটাকে যুক্ত করা হলে তো এই বছর চাহিদা হয়ে যাওয়ার কথা একেবারে শূন্যের কোঠায়। কিন্তু তারপরও তারা এই বছর চামড়া কিনতে চান। তাহলে প্রশ্ন আসেই—কেন তারা চান?

এবার কোরবানির ঈদ সামনে রেখে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক চামড়া ব্যবসায়ীদের নতুন করে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বছরের পর বছর এই খাতে ঋণ দেওয়া হয় এবং তার বড় অংশই হয়ে যায় খেলাপি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাপ্ত তথ্য মতে, চলতি বছরের মার্চ শেষে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮৭ কোটি টাকা, যা এ খাতে বিতরণ করা ঋণের প্রায় সাড়ে ৩৭ শতাংশ। একক খাত হিসেবে বর্তমানে চামড়া খাতে খেলাপির হারই সবচেয়ে বেশি। চামড়া খাতের খেলাপি ঋণ এই দেশের সার্বিক খেলাপি ঋণের হারের (১১.৪) এর প্রায় সাড়ে তিন গুণ। এই খাতের খেলাপি ঋণের বেশির ভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, খেলাপি ঋণের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে প্রতি বছর দুই থেকে তিন হাজার কোটি টাকা মূলধন বরাদ্দ করা হয় জনগণের করের টাকায়।

হ্যাঁ, একদিকে ঋণের টাকায় পানির দামের চামড়া কিনেন তারা,আবার সেই টাকা ব্যাংককে ফেরত না দিয়ে আত্মসাৎ করেন–এর চেয়ে ভালো ব্যবসায় আর কী হতে পারে? এই ব্যবসার জন্যই ‘চামড়া কিনবো কি কিনবো না’এই খেলায় মেতে ওঠেন প্রতিটি কোরবানির ঈদের আগে।

কোরবানি প্রসঙ্গে ফিরে আসছি লেখার শেষ অংশে। তার আগে দেখে নেবো আমার এই লেখার সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান। করোনার সবচেয়ে বড় অভিঘাত পড়েছে এই দেশের অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত ৬ কোটির বেশি মানুষের ওপরে। ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে’সবকিছু খুলে দেওয়া হলেও দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থার কাছাকাছিও নয় এখনও। ফলে এই মানুষগুলো এখনও অত্যন্ত খারাপভাবে জীবন-যাপন করছে। তাদের ওপরে রয়েছে ক্ষুদ্র ঋণের বকেয়া কিস্তিসহ বর্তমান কিস্তি পরিশোধের প্রচণ্ড চাপ। এই অবস্থায় এদের জন্য সরকার কী করেছে, সেটা একটু দেখে নেওয়া যাক। এসব সাহায্যে কী পরিমাণ অনিয়ম এবং চুরি হয় সেটা আমরা জানি, কিন্তু এই আলোচনার সুবিধার্থে ধরে নেই সরকারি সাহায্য বিতরণে কোনোরকম চুরি বা অনিয়ম হয়নি।

২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার পর থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত তিন মাসে সারাদেশে বিতরণ করা হয়েছে এক লাখ ৮৬ হাজার ৭৮৯ মেট্রিক টন চাল। এতে উপকারভোগী পরিবারের সংখ্যা এক কোটি ৬২ লাখ ৮ হাজার ৪৪৩। উপকারভোগী লোকসংখ্যা সাত কোটি ১১ লাখ ১৮ হাজার ৯৫২ জন। অর্থাৎ তিন মাসে একজন মানুষ গড়ে চাল পেয়েছেন ২.৬২ কেজি। প্রতিদিনের হিসাব করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪.৫৫ গ্রাম।  

এই তিন মাসে সাধারণ ত্রাণ হিসেবে নগদ বিতরণ করা হয়েছে ৮৭ কোটি ৯৫ লাখ ৫২ হাজার ৬৩৩ টাকা। এতে উপকারভোগী পরিবার সংখ্যা ৯৬ লাখ ৩৫ হাজার ৭৯৪।

উপকারভোগী লোকসংখ্যা চার কোটি ২৭ লাখ ২০ হাজার ৪৭৩ জন। অর্থাৎ তিন মাসে একজন মানুষ গড়ে আর্থিক সাহায্য পেয়েছেন ২০.৫৮ টাকা। প্রতিদিনের হিসাব করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১১.৩৮ পয়সা।  

এদিকে সাধারণ ছুটি শুরুর দেড় মাস পর ‌সরকার ৫০ লাখ পরিবারকে ২৫০০ টাকা করে দেবার ঘোষণা দিয়েছিল। যে কোনও বিচারেই এই অঙ্ক অত্যন্ত অপ্রতুল। কিন্তু সেই টাকা দিতে গিয়েও ভয়ঙ্কর দুর্নীতির চিত্র আমাদের সামনে আসে। তাই সেটা ঠিকঠাক করে বিতরণ করার জন্য টাকা বিতরণের গতি ধীর হয়ে যায়। আমরা অনেকেই শুনলে অবাক হবো সেই ৫০ লাখ পরিবারের মধ্যে ৩৪ লাখ পরিবারের কাছে এখনও টাকা পৌঁছেনি। (৮ জুলাই, ২০২০, দৈনিক প্রথম আলো)

করোনার অভিঘাতের আগে সরকারি হিসাবেই বাংলাদেশের পৌনে চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতো। করোনার অভিঘাতে আরও প্রায় একই সংখ্যক মানুষ এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ বর্তমানে বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা সাত কোটির মতো হতে পারে বলে আমার ধারণা। কীভাবে বেঁচে আছে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ,ভেবে দেখি কি আমরা?

এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেই নতুন সংকট হিসেবে যুক্ত হয়েছে দেশের একটা বিরাট অংশে বন্যা। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে এত দীর্ঘস্থায়ী এবং এত বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যা আর হয়নি। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিটা উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণের অপর্যাপ্ততার কথা আমরা সবসময় মিডিয়ায় দেখি। বোধগম্য কারণেই এই বছর ত্রাণের অপর্যাপ্ততার খবর আগের চাইতে আরও অনেক বেশি। 

আবার কোরবানিতে ফিরে আসা যাক। দেশে কোরবানির সংখ্যার যে প্রবৃদ্ধি প্রতি বছর হয় সেই হিসেবে এবার ৪৫ লাখ গরু আর অন্তত ৮০ লাখ ছাগল-ভেড়া কোরবানি হবার কথা ছিল। কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধি এবার হবে না, বরং করোনার কারণে গত বছরের চাইতে এই সংখ্যা কমে যাবে এটা অনুমান করা যায়। ধরে নেওয়া যাক এই প্রাক্কলিত সংখ্যার চাইতে ২০% কম প্রাণী কোরবানি হবে। তাহলে গরুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬ লাখ। একেবারে কমিয়ে, গড়ে ৮০০ টাকা করে ‌চামড়ার দাম ধরা হলেও চামড়ার মূল্য দাঁড়ায় ২৮৮ কোটি টাকা। এবার ছাগল ভেড়া কোরবানি হওয়ার সংখ্যা হবে ৬৫ লাখের মতো। গড়ে ১০০ টাকা ধরলেও এখানে চামড়ার মূল্য দাঁড়ায় ৬৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট মূল্য ৩৫০ কোটি টাকার বেশি। এই টাকার পরিমাণ সরকার তিন মাসে মানুষকে যে নগদ টাকা দিয়েছিল (প্রায় ৮৮ কোটি টাকা) তার প্রায় চারগুণ।

উপরে আলোচিত প্রেক্ষাপটে এই দেশের কোটি কোটি মানুষের কাছে কোরবানির চামড়ার মূল্যটা আর্থিক সাহায্য হিসেবে পাওয়াটা কতটা কাজে লাগতো সেটা আমরা বুঝতে পারি। এই টাকাটা এই বছরের মতো মূল্যবান নিকট অতীতে আর কোনও বছর ছিল না। কিন্তু সেটা হতে যাচ্ছে না।

সব বছর যেমনই হোক এই বছর অন্তত সরকার করোনা এবং বন্যা পরিস্থিতি বিবেচনা করে অনেক আগেই চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। কারণ ট্যানারি মালিকদের কথা মতোই তাদের চামড়ার প্রয়োজন নেই, আবার চামড়া বেশি দামে ভারতে পাচার হয়ে যায়। সুতরাং রফতানি করা হলে দেশের তুলনায় চামড়ার অনেক ভালো মূল্য পাওয়া যাবে এটা নিশ্চিত।

গত বছর ২০০/৩০০ টাকায় নেমে এসেছিল একটা মাঝারি আকারের গরুর চামড়ার দাম। এ বছর সেই টাকায়ও চামড়া বিক্রি করা যাবে না, এটা নিশ্চিত।

গত বছর বিক্রি করতে না পেরে লাখ লাখ চামড়া মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল। এ বছর দেওয়া হবে আরও অনেক বেশি। নষ্ট হবে বহু সম্পদ, আর বাকিগুলো চলে যাবে ব্যবসায়ী নামের কতগুলো লুটেরার হাতে। এমন এক সময় এটা করা হবে যখন করোনার অভিঘাতে আধপেটা খাওয়া মানুষগুলো বন্যায় একেবারে জেরবার হয়ে আছে। চামড়া বিক্রির সামান্য কিছু টাকাও তাদের কাছে হয়ে উঠতে পারতো অতি মূল্যবান।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
থাইল্যান্ডে সফর দুই দেশের ফলপ্রসূ অংশীদারত্বের নতুন যুগের সূচনা করেছে: প্রধানমন্ত্রী
থাইল্যান্ডে সফর দুই দেশের ফলপ্রসূ অংশীদারত্বের নতুন যুগের সূচনা করেছে: প্রধানমন্ত্রী
‘গরমে অসুস্থ’ হয়ে মারা যাওয়া সেই শ্রমিকের পরিবারের পাশে জেলা প্রশাসন
‘গরমে অসুস্থ’ হয়ে মারা যাওয়া সেই শ্রমিকের পরিবারের পাশে জেলা প্রশাসন
ওমরাহ করতে স্ত্রীসহ সৌদি আরব যাচ্ছেন মির্জা ফখরুল
ওমরাহ করতে স্ত্রীসহ সৌদি আরব যাচ্ছেন মির্জা ফখরুল
ঢাকার অধস্তন আদালতগুলোতে এসি লাগাতে আইনি নোটিশ
ঢাকার অধস্তন আদালতগুলোতে এসি লাগাতে আইনি নোটিশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ