X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মার্কিন সেনা প্রত্যাহার কি তালেবানদের ক্ষমতায় ফেরাবে?

আনিস আলমগীর
১৫ জুন ২০২১, ১৫:১৭আপডেট : ২৪ জুন ২০২১, ২২:৪৭

আনিস আলমগীর টুইন টাওয়ার হামলার ২০ বছর পূর্তির দিন, আগামী ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ পুরোপুরি আফগানিস্তান ছাড়ছে মার্কিন সেনারা। ২০০১ সালে আফগান আক্রমণের মধ্য দিয়ে আমেরিকা ‘ওয়ার অন টেরর’ সূচনা করেছিল। সেই যুদ্ধের অবসান হয়েছে কিন্তু আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাবাহিনীর উপস্থিতির অবসান হয়নি এতদিনেও। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তালেবান ও আমেরিকার মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত বাহিনীকে মে মাসের মধ্যে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল।

তবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর গত এপ্রিল মাসে বলেন যে ১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হামলার ২০তম বার্ষিকীর মধ্যেই এই সেনা প্রত্যাহার শেষ হবে। কিন্তু বিপদ দেখা দিয়েছে অন্যত্র। মার্কিনিরা যাওয়ার আগেই আফগানিস্তানে প্রায় প্রতি সপ্তাহে বোমা বিস্ফোরণ হচ্ছে। নারীর প্রতি আগের মতো সহিংসতা বেড়েছে। টার্গেট করে প্রগতিশীল লোকদের হত্যা করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে মার্কিন অনেক বর্তমান এবং প্রাক্তন আইন প্রণেতারা আশঙ্কা করছেন, বিদেশি বাহিনী চলে যাওয়া এবং আফগান সরকারের সঙ্গে তালেবানদের স্থগিত শান্তি আলোচনা আফগানিস্তানকে একটি সর্বকালের গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে যাচ্ছে, যা তালেবানকে আবার ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে পারে।

অন্যদিকে বিদেশি সেনা চলে যাওয়ার পরে কাবুলের সেনাবাহিনীকে রক্ষা করার জন্য এবং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালানোর জন্য তুরস্ক তার সেনাদের কাবুলে রাখার প্রস্তাব করেছে। এ নিয়ে তারা মার্কিনিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও করেছে। কিন্তু তালেবানরা বলে দিয়েছে– তা চলবে না। তুরস্ককেও চুক্তি অনুযায়ী চলে যেতে হবে।

কাতারে তালেবান মুখপাত্র সুহাইল শাহীন রয়টার্সকে বলেছেন, ‘বিগত ২০ বছরে তুরস্ক ন্যাটো বাহিনীর একটি অংশ ছিল, সুতরাং ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি আমরা আমেরিকার সঙ্গে যে চুক্তি করেছি তার ভিত্তিতে তাদেরও আফগানিস্তান থেকে সরে যাওয়া উচিত। তুরস্ক একটি দুর্দান্ত ইসলামিক দেশ। তার সঙ্গে আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। ভবিষ্যতে দেশে নতুন ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে আমরা তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও সুসম্পর্ক স্থাপনের আশাবাদী।’

এমন পরিস্থিতিতে, বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের কর্মীদের নিয়ে শঙ্কিত, ল্যান্ডলক আফগানিস্তান থেকে কীভাবে নিরাপদে তাদের কর্মীদের সরিয়ে নেবে ভাবছে। সুরক্ষা উদ্বেগের কারণে অস্ট্রেলিয়া গত মাসে তার কাবুল দূতাবাস বন্ধ করে দিয়েছে। চলমান পরিস্থিতি অন্য দেশগুলোকেও তাদের দূতাবাস বন্ধে প্ররোচিত করতে পারে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কংগ্রেসের শুনানিতে সম্প্রতি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে কাবুলের মার্কিন দূতাবাস বন্ধ করছেন না। তিনি প্রতিশ্রুতি রাখতে পারবেন কিনা সেটাও প্রশ্ন।

পেন্টাগন বলছে এরইমধ্যে মার্কিন সেনাদের ৫০ শতাংশেরও বেশি প্রত্যাহার করা হয়েছে। আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ কাজে লিপ্ত তুরস্কের ৫০০-এরও বেশি সৈন্য এখন সেখানে বৃহত্তম বিদেশি সামরিক বাহিনী। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার কারণে ওয়াশিংটনের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের যে ফাটল ধরেছে সেটি উন্নত করতে কাবুল বিমানবন্দরের সুরক্ষার দায়িত্বটা তুরস্কের দরকার ছিল। আঙ্কারার প্রত্যাশা নষ্ট হয়ে গিয়েছে কিনা এখনও বলা যাচ্ছে না। ১৪ জুন ২০২১ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের বৈঠক হলেও ফলাফল কি সেটা এখনও দৃশ্যমান নয়।

তবে এটা পরিষ্কার যে মার্কিনিরা যাওয়ার আগেই তালেবানরা আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। দেশের আগামী দিনের একটি জোরালো রাজনৈতিক খেলোয়াড় হিসেবে বৈধতা অর্জন করেছে। অবশ্য তারা এখনও আফগান সরকারকে বৈধ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না, ‘কাবুল প্রশাসন’ বলে সম্বোধন করে।

আফগানদের মতো স্বাধীন চেতা জাতি বিশ্বে বিরল। ভারত বিজয়ের পর ব্রিটিশরা আফগানিস্তানের দখল নিতে বহু চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিল চূড়ান্তভাবে। তারা সব সময় যুদ্ধ করেছে তাদের চেয়ে বেশি শক্তিসম্পন্ন শক্তির সঙ্গে। এ নিয়ে কখনও আফগানরা বিব্রতবোধ করেনি। আফগানিস্তানে সোভিয়েতের দখলদারিত্বের সময় থেকে গত ফেব্রুয়ারির চুক্তি সম্পাদন পর্যন্ত কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ নির্ণয় করা কঠিন।

তবে আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে প্রাণহানির যে ধারণা পাই তাতে দেখা যায়, এই সময়ের মধ্যে ৯ শতাংশ সাধারণ আফগান প্রাণ হারিয়েছে। সোভিয়েতের আর্থিক ক্ষতির কোনও বিবরণী বাইরে আসেনি তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত ২০ বছরের যুদ্ধে দুই ট্রিলিয়ন ডলার হারিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৩০০ সৈন্য নিহত হয়েছে, আহতদের সংখ্যা ২১ হাজার আর আফগান সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর ৫৮ হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে।

আফগানিস্তানের এই শান্তি প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানেরও একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। তালেবান সৃষ্টি হয়েছিল সোভিয়েত দখলদারিত্বের সময়, আমেরিকার সিআইএ এবং পাকিস্তানের আইএসআই-এর সহায়তায়। লক্ষ লক্ষ আফগান সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশে আশ্রয় নিয়েছিল তখন। তারা উভয়ে জাতিতে পশতুন। আর আরবি ও পশতুন ভাষায় তালেবান অর্থ হচ্ছে ছাত্র। তালেবান নেতা মোল্লা ওমর তাদের সন্তান, তার উত্থানও পাকিস্তানের শরণার্থী শিবির থেকে।

আমেরিকা-পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের যৌথ উদ্যোগে তালেবান-আমেরিকান চুক্তি হওয়ার দৃশ্যপটে পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ ভারত পাত্তা পায়নি। ভারতের কাবুল নীতি ব্যর্থ হওয়ায় অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মোদির সরকারকে নিন্দা শুনতে হচ্ছে বিরোধীদের। মোদি সরকার এবং কূটনৈতিক পণ্ডিতদের আশঙ্কা, আফগান তালেবান এবং পাকিস্তানি তালেবান মিলে কাশ্মিরকে অশান্ত করতে পারে আগামীতে। তাদের হিসেবে, আফগানিস্তান তালেবান সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কাবুল আইএসআইয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে পাকিস্তানি তালেবানও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর হামলা বন্ধ করে দেবে এবং দুয়ে মিলে ‘প্রকৃত শত্রু’ ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই তীব্রতর করবে।

কাবুলে মার্কিন উপস্থিতিতে শান্তি আসেনি। মার্কিনিদের বিদায়ে সেটি আসবে সেই গ্যারান্টিও নেই। বরং আরেক অন্ধকার নেমে আসবে সেটাই আশঙ্কা অনেকের। তালেবানরা ইসলামি সরকার চায়, প্রতিপক্ষ বর্তমান আফগান সরকার গণতান্ত্রিক সরকার চায়। কাবুল সরকার এবং তালেবানরা যদি আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায় তবে সমন্বিত একটা সংবিধান রচনা করতে হবে। তারা যদি আন্তরিকতার সঙ্গে শান্তি কামনা করে তাহলে সমঝোতা হওয়া খুব কঠিন হবে না।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সিলেটে ভবন থেকে পড়ে যুবকের মৃত্যু
সিলেটে ভবন থেকে পড়ে যুবকের মৃত্যু
এক ফ্রেমে এত ‘সুন্দরী’, স্মৃতিকাতর সকলেই!
এক ফ্রেমে এত ‘সুন্দরী’, স্মৃতিকাতর সকলেই!
ফোরাম থেকে ব্যারিস্টার খোকনের অব্যাহতির আদেশ প্রত্যাহার
ফোরাম থেকে ব্যারিস্টার খোকনের অব্যাহতির আদেশ প্রত্যাহার
সাবেক মন্ত্রী আবদুল মান্নান সিদ্দিকীর ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী বৃহস্পতিবার
সাবেক মন্ত্রী আবদুল মান্নান সিদ্দিকীর ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী বৃহস্পতিবার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ