X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সায়গনে পালিয়েছিল, কাবুলে ঘুঁটি চেলেছে

আনিস পারভেজ
১৯ আগস্ট ২০২১, ১৯:৪২আপডেট : ১৯ আগস্ট ২০২১, ১৯:৪২

আনিস পারভেজ দু’য়ের মিলিয়ে ফেলা কতটা যৌক্তিক—সায়গনের সঙ্গে কাবুল?  গ্রাফিক্যালি কিছুটা সাদৃশ্য আছে হয়তো, হেলিকপ্টারে মার্কিন সৈন্যদের তুলে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা একেবারে বিপরীত। সায়গন থেকে হানাদার মার্কিনিরা পালিয়েছিল, পরাস্ত হয়েছিল একটি পরাশক্তি ভিয়েতনামের জনসৈন্যের বীরাক্রমণে। কাবুলে মার্কিন বাহিনী সুকৌশলে তালেবানদের বসিয়ে যাচ্ছে মসনদে, সামনে ভিন্ন নাটক আছে বলে। যা দেখছি তা আসলে নাটক, উচ্চমানের শঠতা।  

ভিয়েতনামে ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত আমেরিকা যুদ্ধ করেছে। মার্কিনিরা নাপাম বোমা ফেলে, প্রায় পুরো যুব সমাজকে ভিয়েতনামে যেতে বাধ্য করে। রণাঙ্গনে গিয়ে মাত্র কৈশোর পেরোনো মার্কিন যুবক হত্যা ও ধ্বংসের নৃশংসতায় কেঁপে ওঠে, প্রশ্ন করে– কেন এ যুদ্ধ। পর্যায়ক্রমে ভিয়েতনামি গেরিলারা শক্তিশালী হয়। কফিনে করে মার্কিন সৈন্যদের লাশ আসতে থাকে আমেরিকার ছোট বড় শহরে, পরিবারে পরিবারে মাতম। অচিরেই যুদ্ধবিরোধী জনমত প্রবল হয় আমেরিকায়, এবং আটলান্টিক পেরিয়ে ইউরোপে। ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে রাস্তায় নামে, ১৯৬৯ চিহ্নিত হয় যুদ্ধ ও পররাষ্ট্র গ্রাসবিরোধী প্রতিবাদের বছর হিসেবে।

ঘরের প্রবল চাপ এবং রণাঙ্গনে ভিয়েতনামিদের কাছে উপর্যুপরি মার খেতে খেতে আমেরিকা পরাজয় স্বীকার করে বাড়ি ফিরে আসে। মানুষের কাছে দানব হেরে গেলো, হেরে গেলো অস্ত্র। বেরটল্ট ব্রেখটের পঙতি, “সার্জেন্ট বিরাট বিশাল তোমার সাঁজোয়া গাড়ি/গুঁড়িয়ে দিতে পারে শহর বন্দর জনপদ/ কিন্তু, দুর্বলতা মাত্র একটি—চালাতে যে মানুষ লাগে,” আকাশে বাতাসে রণিত হলো। মানুষ জিতলো অমানুষের বিরুদ্ধে, যাদের ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্র।  

সেদিন ভিয়েতনামে মানুষ জিতলেও, এবার কিন্তু দানব একটা নাটক করে গেলো, মুখোশের আড়ালে তার অন্য মন্ত্র, ভিন্ন এজেন্ডা।

প্রাচীনকাল থেকেই আফগানিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। আলেকজান্ডারের সেনারা এ পথে ভারতে এসেছিল। মঙ্গোল এসেছিল এ করিডোরে ভারত আক্রমণ করতে। এর উত্তর সীমান্ত দিয়ে ছিল সিল্ক রোড—পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্যের পথ। গত শতাব্দীতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন চেয়েছিল আফগানিস্তান দখলে নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে তাদের ভাবাদর্শ জোর করে চাপিয়ে দিতে। বহিঃশক্তির আক্রমণে আফগানিস্তান দুর্বল হয়েছে কিন্তু হারেনি।

বিগত দুই দশকে আফগানিস্তানের গুরুত্ব বেড়েছে নানাবিধ কারণে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে জ্বালানি ও খনিজ, যার প্রতি লোভ সব পরাশক্তিরই। সেসব দখলে নিতে প্রয়োজন সেই দেশগুলোকে অভ্যন্তরীণ গোলযোগে দুর্বল করে দেওয়া। তারপর মুরুব্বির নাটক করে সেসব দেশগুলোর সম্পদ দখলে নেওয়া।  

ইরানও আফগানিস্তানের লাগোয়া দেশ, যার সঙ্গে আমেরিকার চরম শত্রুতা। বহু ছলেবলেও আমেরিকা ওখানে কিছু করতে পারছে না। ১৯৫৩-তে ক্যু করে অল্প কিছু দিনের জন্য ইরানে গেড়ে বসেছিল। খোমেনির বিপ্লবের পর আর নাক গলাতে পারেনি। ইতোমধ্যে তুরস্ক আঞ্চলিক শক্তি হয়ে উঠছে, যার সঙ্গে আমেরিকার বিরোধ। প্রয়োজন অস্থিতিশীল করা তুরস্ক ও ইরানকে।

সর্বোপরি চীন এখন আমেরিকার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি, যার সঙ্গে সরাসরি হাতাহাতি সম্ভব নয়। একমাত্র বিকল্প হচ্ছে অন্য কাউকে দিয়ে চীনের গায়ে খামচি দেওয়া।

লক্ষ করলে দেখা যায়, আফগানিস্তানের চারপাশের রাষ্ট্রগুলোতে আমেরিকার শকুনের নজর। তাই এখন আমেরিকার সুপার-ডুপার কৌশল হচ্ছে আফগানিস্তানে সন্ত্রাসের তীর্থ তৈরি করা, এখানে বেপথের জঙ্গি ইসলামকে তরতাজা হতে দেওয়া। এসব দেশে ধর্মের নৌকা পবনের আগে চলে। তাই তালেবানি স্রোত ইরান, তুরস্ক ও মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোতে ছড়াবে। আমেরিকার অস্ত্র ও অর্থে এ স্রোতকে ভয়ংকর করে তোলার সম্ভাবনা আছে। আমেরিকা সে রকমটিই চাইছে।  

সম্ভবত আমেরিকা সবচেয়ে বেশি চাইছে তাজিকিস্তান ও পাকিস্তানের মাঝামাঝি চীনের সঙ্গে আফগানিস্তানের যে এক চিলতে স্থলসীমান্ত আছে, তার ভেতর দিয়ে চীনের মুসলিম অধ্যুষিত শিনইয়াং প্রদেশে তালেবানি সন্ত্রাস রফতানি করতে। উইঘুর মুসলিমদের নিয়ে এমনিতেই মুসলিম বিশ্বের জনগণ চীনের প্রতি নাখোশ। অন্য অর্থে, চীনের শিনইয়াং ও কাশগরে বালি উত্তপ্ত হয়ে আছে, যা তালেবানি তেল পেলেই জ্বলে উঠবে।  

এ মুহূর্তে বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি অচল আফগানিস্তান, যেখানে ধর্মের খোলসে সন্ত্রাসের চর্চা হবে, যা সমস্ত অঞ্চলকেই অস্থিতিশীল করে রাখবে। গত বিশ বছরে আমেরিকা আফগানিস্তানকে অচল করেছে, যেমনটি করেছে ইরাক-মিসর ইত্যাদি দেশকে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও শান্তি আনয়নের ভান করে ধ্বংস করেছে সম্ভাবনাময় দেশগুলোকে, যেখানে স্থিতি এলে আর্থসামাজিক উন্নতির নিশ্চিত সম্ভাবনা ছিল, দেশগুলো হতো শক্তিশালী, আমেরিকার ধমকে কাজ হতো না। বসন্ত বিপ্লবের মাধ্যমে ধ্বংস করেছে মধ্যপ্রাচ্যের সেসব দেশগুলোকে, যেখানে সত্যিকারের জনবিপ্লব প্রায় এসে গিয়েছিল। আমেরিকা কৌশলে ভেক বিপ্লব করে বসিয়েছে নিজেদের পুতুল সরকার।

আমেরিকার নতুন ভেক আফগানিস্তানকে তালেবানদের হাতে ছেড়ে যাওয়া। বিশ বছর আফগানিস্তানকে অচল করে এসব এলাকার স্বভাবজাত দুর্নীতিকে উসকে দিয়ে জনগণকে করেছে সরকারবিরোধী। পাশাপাশি খাল কেটেছে তালেবানদের প্রত্যাবর্তনের জন্য। তাঁবেদার সরকারের অপশাসনে অতিষ্ঠ জনগণের অনেকেই বরণ করে নিয়েছে তালেবানদের। অসহায় ও বঞ্চিতদের এ ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।  

তালেবানের বীরের বেশে প্রত্যাবর্তন প্রকৃত অর্থে আমেরিকার জন্য কোনও পরাজয় নয়, সামনে জিতে যাওয়ার জন্য একটি চাল মাত্র। এই একটি চালে আমেরিকা জিততে চাইছে ইরান, তুরস্ক ও মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোর বিরুদ্ধে। আমেরিকার এই চাল সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এখানে চীনকে ঠেকাতে। চীন ইতোমধ্যে বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভে এ অঞ্চলে টাকা ঢালছে, গড়ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা নিজের প্রভাবকে সুদৃঢ় করতে।  

কাবুল থেকে আমেরিকার সৈন্যদের চলে যাওয়া পলায়ন নয়, ওরা কাজ শুরু করে দিয়ে বাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু সায়গন থেকে তারা ঠিকই পালিয়েছিল। ভিয়েতনামে মানুষ ও তাঁর ন্যায়বোধ জিতেছিল। আফগানিস্তানে উড়ছে অন্যায়ের পতাকা, হাসছে দানব। আমরা অনেকে বুঝতেই পারছি না যা দেখছি তা নিছক ভেলকি।

লেখক: যোগাযোগ ও সিনেমা গবেষক।   

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডুবন্ত শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেলো আরেক শিশুরও
ডুবন্ত শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেলো আরেক শিশুরও
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ