X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রয়োজন অনলাইন-অফলাইন সমন্বয়

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
১০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭:১৮আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭:১৮
ড. প্রণব কুমার পান্ডে কোভিড -১৯ অতিমারি অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, পরিবহন এবং অন্যান্য খাতের সঙ্গে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। অর্থনীতি এবং স্বাস্থ্যের ওপর অতিমারির প্রভাব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সত্ত্বেও, শিক্ষার ওপর মারাত্মক ভাইরাসের বিপর্যয়কর প্রভাব এখনও বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি তেমনভাবে আকর্ষণ করতে পারেনি। অধিকাংশ উন্নত দেশ তাদের সনাতন ক্লাসরুমভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে অনলাইন ব্যবস্থায় রূপান্তরের মাধ্যমে এই ভাইরাসের ধ্বংসাত্মক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। তাছাড়া, উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভ্যাকসিন কভারেজের অনুপাত বেশি। অতএব, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগের পরিমাণ উন্নত দেশের তুলনায় অনেক বেশি।

১৮ মার্চ ২০২০ থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ রয়েছে। কোভিড-১৯-এর অবস্থার উন্নতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বহুবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অতিমারির অবস্থা অপ্রত্যাশিতভাবে খারাপ হয়ে যাওয়ার ফলে সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে বেশ কয়েকবার। ফলে, সরকারি স্কুল, কলেজ এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষাগত জীবন নিয়ে চিন্তিত। মারাত্মক ভাইরাসের ধ্বংসাত্মক প্রভাব একটি প্রজন্মকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। কারণ, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিশুরা শিক্ষার পরিবেশ থেকে অনেক দূরে রয়েছে।

যদিও সরকার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেবা বিতরণ ব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে ডিজিটালাইজড করেছে, তবু আমরা প্রচলিত ক্লাসরুমভিত্তিক শিক্ষণের পরিবেশকে অনলাইন পদ্ধতিতে পরিণত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এর কারণ হলো গ্রামীণ অঞ্চলের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে ডিভাইস, ইন্টারনেট এবং বিদ্যুতের ব্যয় বহন করার ক্ষমতা নেই। এমনকি যারা ডিভাইস ব্যবহার করে তাদের রয়েছে ইন্টারনেট সংযোগের সমস্যা এবং নিরবচ্ছিন বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকার অভিজ্ঞতা। ফলস্বরূপ, এই দেড় বছরে, স্কুল থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের বাল্যবিবাহের অনুপাতও উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
সরকারের  বিভিন্ন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, আমরা এখনও অনলাইনে শিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষকদের প্রস্তুত করার জন্য সংগ্রাম করছি। অন্য কোনও বিকল্প খুঁজে না পেয়ে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক ক্রিয়াকলাপে ব্যস্ত রাখার জন্য অ্যাসাইনমেন্টের কার্যক্রম শুরু করে। তারপরেও, এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। কারণ, অ্যাসাইনমেন্ট লেখা শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন ঘটনা।

একটি সরকারি কলেজের শিক্ষকের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা করার সময় তিনি আমাকে যে ধারণা দিলেন তা হলো তাদের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বিভিন্ন ইন্টারনেট সোর্স থেকে কপি করে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিচ্ছে। খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী পরিশ্রম করে অ্যাসাইনমেন্ট প্রস্তুত করছে। শিক্ষার্থীরা এর জন্য এককভাবে দায়ী নয়, কারণ শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশের  অ্যাসাইনমেন্ট লেখা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। অতএব, এই বয়সে অ্যাসাইনমেন্ট লেখার সময় অন্যায় উপায় অবলম্বন করার অভ্যাস এই শিক্ষার্থীদের দীর্ঘমেয়াদে সাহায্য করবে না। ফলে, শিক্ষকদের ওরিয়েন্টেশন প্রদান করা প্রয়োজন যারা তাদের শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টশন করবেন।

এদিকে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য অগ্রাধিকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ১৮ বছরের বেশি বয়সী শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রেখেছে। ইতোমধ্যে, প্রায় ৮০,০০০ শিক্ষার্থী ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ গ্রহণ করেছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে, তারা তাদের দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ করবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে টিকাদান সম্প্রসারণের পাশাপাশি মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) অনলাইন শিক্ষার নির্দেশিকা তৈরির জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে। আমরা ইতোমধ্যে জানতে পেরেছি যে ইউজিসি অনলাইন পরীক্ষার বিষয়ে একটি নির্দেশিকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠিয়েছে।

অনলাইন পরীক্ষা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন পরীক্ষার নির্দেশিকাটিকে স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কাস্টমাইজ করার কাজ করছে। কারণ, অনলাইন পরীক্ষার গ্রহণের জন্য আইনি সংস্কার বাস্তবায়নের প্রয়োজন হয়। এখন পর্যন্ত, অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া ছাড়া কর্তৃপক্ষের কার্যত কোনও বিকল্প নেই। অনলাইন পরীক্ষার প্রক্রিয়া আগে শুরু করা উচিত ছিল। কারণ, অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলো তাদের অনলাইন ক্লাস অনেক আগেই শেষ করেছে। ফলে অধিকাংশই শিক্ষার্থী গত এক বছর থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য অপেক্ষা করছে। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না বিধায় নিজেদের অ্যাকাডেমিক ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা নিয়ে সময় পার করছে।

গত দেড় বছরের কোভিড-১৯ অতিমারি অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যেতে পারে যে, আমরা কখন আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু করতে পারবো তা এই মুহূর্তে অনুমান করা কঠিন। ফলে, আমাদের অবশ্যই কোভিড-পরবর্তী নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। বেশ কয়েকটি কোম্পানি ভ্যাকসিন আবিষ্কার করলেও কেউই নিজেদের ভ্যাকসিনকে প্রাণঘাতী ভাইরাসের দূষণের বিরুদ্ধে শতভাগ নিরাপদ দাবি করতে পারেনি। দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পর অনেকেই সংক্রমিত হয়েছেন এমন প্রমাণ রয়েছে। এমনকি মারাত্মক ভাইরাসের বিভিন্ন ভেরিয়েন্ট একটি নির্দিষ্ট বিরতির পরে কোভিড পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলেছে।

পশ্চিমের দেশগুলো অতিমারির চতুর্থ তরঙ্গের মধ্য দিয়ে গেলেও আমরা তৃতীয় তরঙ্গের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তবে আমরা এখনও নিশ্চিত নই যে আমরা কখন মহামারির চতুর্থ তরঙ্গের মুখোমুখি হবো। যাহোক, এটা নিশ্চিত যে যতক্ষণ না আমরা আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যাকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসতে পারবো, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের একটি নির্দিষ্ট বিরতির পর মারাত্মক ভাইরাসের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে। কারণ, করোনা তার রূপ পরিবর্তনের জন্য ইতোমধ্যে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে।

উপরোক্ত পরিস্থিতিতে, শিক্ষা খাতের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই অনলাইন এবং অফলাইনে শিক্ষাদান ও পরীক্ষার বিধান রেখে একটি গাইডলাইন তৈরি করতে হবে। আমরা ১৫ অক্টোবর বা তার আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলতে পারলেও যদি আবার কয়েক মাসের মধ্যে আরেকটি তরঙ্গের মুখোমুখি হই তবে আমাদের আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে। অতএব, শিক্ষা খাতে অতিমারি দ্বারা সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক জীবন বাঁচাতে শারীরিক এবং অনলাইন সিস্টেমের সমন্বয়ে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ক্লাসরুমভিত্তিক পঠন ও পাঠনের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তকে আমরা সবাই স্বাগত জানাই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া খুব জরুরি। কারণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি স্কুল ও কলেজের অধিকাংশ শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন ধরে বাড়িতে থাকতে থাকতে মানসিক অবসাদের শিকার হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় চালু করা হলে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে চাঙা হবে এবং তাদের শিক্ষা জীবন এগিয়ে যাবে। একই সময়ে, আমাদের অবশ্যই একমত হতে হবে (যেটি  আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব সময় বলেছেন) এই মর্মে যে আমরা অবশ্যই সন্তানদের এই প্রাণঘাতী ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলতে পারি না।

পরিশেষে, অনলাইন এবং অফলাইন শিক্ষার সমন্বয়ের বিষয়টি খুব দ্রুততার সঙ্গে ভাবতে হবে। আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক জীবনকে খুব সহজে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের একটি প্রজন্মের অ্যাকাডেমিক জীবন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০২০ সালের শুরুতে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া শিক্ষার্থীদের ২০২২ সালে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত হবে। এই শিক্ষার্থীরা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যক্রম থেকে খুবই অল্প কিছু শিখবে। অতএব, তাদের অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যক্রমের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো অনেক কঠিন হবে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ফলে, কোভিড-১৯ অতিমারির সময় এবং এমনকি অতিমারির পরেও অনলাইন এবং অফলাইন পদ্ধতির মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিকায়নের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। যদি আমরা সিস্টেম বদলে দিতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে কোভিড-১৯-এর মতো কোনও অতিমারি দেখা দিলেও আমাদের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পিছিয়ে থেকেও ব্রাজিলিয়ান-গ্রানাডিয়ানের গোলে আবাহনীর দারুণ জয়
পিছিয়ে থেকেও ব্রাজিলিয়ান-গ্রানাডিয়ানের গোলে আবাহনীর দারুণ জয়
শিশু হাসপাতালে আগুন: পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
শিশু হাসপাতালে আগুন: পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
অটোরিকশায় বাসের ধাক্কা, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা নিহত
অটোরিকশায় বাসের ধাক্কা, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা নিহত
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে: জাতিসংঘ
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে: জাতিসংঘ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ