X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘ঘরের ভেতর বিভীষণ ঢুকে গেছে’

প্রভাষ আমিন
২৮ অক্টোবর ২০২১, ১৭:০১আপডেট : ২৮ অক্টোবর ২০২১, ১৭:০১

প্রভাষ আমিন নুজহাত চৌধুরী, প্রিয়জনেরা ডাকেন শম্পা। গুণে অনন্যা নুজহাত শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর কন্যা। একাত্তরে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাক হানাদারদের পরিকল্পনায় তাদের এ দেশীয় দোসররা বাস্তবায়ন করেছিল এক ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ। বাংলাদেশের বিজয় ঠেকাতে না পেরে তারা জাতিকেই ঠেকিয়ে দিতে চেয়েছিল। তাই তো বেছে বেছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। আলীম চৌধুরী চোখের ডাক্তার ছিলেন। আলবদররা বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করার আগে তার চোখ তুলে নিয়েছিল। পিতার অসমাপ্ত স্বপ্ন সমাপ্ত করতে নুজহাত চৌধুরীও ডাক্তার হয়েছেন, চোখেরই ডাক্তার। বাবার মতো তিনিও মানুষের চোখে আলো দেন। নুজহাত চৌধুরী একজন ব্যস্ত ডাক্তার। কিন্তু শুধু ডাক্তারিতেই সীমাবদ্ধ রাখেন না নিজেকে। ডাক্তার হিসেবে মানুষের চোখের মতো সমাজকর্মী হিসেবে সমাজের চোখে আলো দেওয়ার কাজটাও করছেন তিনি। যে বাংলাদেশের জন্য জীবন দিয়েছেন বাবা আলীম চৌধুরীসহ ৩০ লাখ শহীদ, সেই বাংলাদেশ গড়তে তার নিরলস চেষ্টা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উন্নত, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে তিনি সামনের কাতারের সৈনিক। তিনি মাঠে স্লোগান দেন, মঞ্চে বক্তৃতা দেন, উপস্থাপনা করেন, লেখালেখি করেন, টকশো’তে কথা বলেন যুক্তি দিয়ে। সরাসরি কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত না হলেও আওয়ামী লীগের প্রতি তার পক্ষপাত, দুর্বলতা গোপন করেন না। কিন্তু আরও অনেকের মতো তিনি অন্ধ আওয়ামী লীগার নন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটির সত্যিকারের শুভাকাঙ্ক্ষী।

আওয়ামী লীগে যখন বিচ্যুতি আসে তিনি প্রতিবাদ করেন। হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আঁতাতকে অনেকে ‘কৌশল’ বলে জায়েজ করার চেষ্টা করেছেন। নুজহাত চৌধুরী তখন স্পষ্টভাবে বলেছেন, এ ধরনের কৌশলও আওয়ামী লীগের মৌলিক চেতনা, যেটা বাংলাদেশেরও মূল ভিত্তি; তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননার প্রতিক্রিয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে যে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব হয়েছে, তা বাংলাদেশের ইতিহাসেই এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। কিন্তু শুরুতে কলঙ্ককে যতটা কালো ভেবেছিলাম, এখন দেখছি তারচেয়ে আরও অনেক বেশি কালো। গত সপ্তাহে কলাম ‘দায় ও ব্যর্থতা কার?’ শিরোনামে সময় মতো এই তাণ্ডব ঠেকানোর ব্যবস্থা না করায় সরকার এবং রুখে দাঁড়ানোর ব্যর্থতার দায় সরকারি দল আওয়ামী লীগকে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি, রুখে দাঁড়ানো তো পরে, আগে দাবি উঠুক, আওয়ামী লীগ যেন সহিংসতায় অন্তত অংশ না নেয়।

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন রাজপথে নেমে এসেছে। তাদের দাবি একটাই– বাংলাদেশ যেন পথ না হারায়। তেমনই এক সম্প্রীতি সমাবেশে ডা. নুজহাত চৌধুরী শম্পা বলেছেন, ‘আমাদের ঘরের ভেতর বিভীষণ ঢুকে গেছে। সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে যারা উন্নয়নের গতিপথকে রুদ্ধ করতে চায়, দেশকে যারা মিনি পাকিস্তান করতে চায়; তাদের কেউ কেউ আমাদের ভেতরে ঢুকে গেছে। এদের চিহ্নিত করতে হবে।’ তার এই শঙ্কা আমাকেও গ্রাস করেছে। শত্রু ঘরে ঢুকে গেলে তাকে চেনা মুশকিল, ঠেকানো মুশকিল।

এবারের তাণ্ডবের সূত্রপাতটা শান্তির শহর কুমিল্লায়। কিন্তু সবাই জানে কুমিল্লায় এখন এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের একচ্ছত্র আধিপত্য। গত সপ্তাহে কুমিল্লা বিভাগ করা প্রশ্নে সরাসরি সম্প্রচারে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করে প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রত করলেও নিজে কিন্তু কুমিল্লাবাসীর কাছে হিরো হয়ে গেছেন। কুমিল্লা বিভাগ প্রশ্নে আমি বাহাউদ্দিন বাহারের সঙ্গে একমত। কুমিল্লা বিভাগ হতে হবে ‘কুমিল্লা’ নামেই। বাহার দৃঢ়ভাবে নিজের অবস্থানে অনড় থেকেছেন, যা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। আর প্রধানমন্ত্রী যেভাবে ‘কু’ নামে কোনও বিভাগ দেবো না বলেছেন, তা একটি অঞ্চলের মানুষের প্রতি তার বিরাগ স্পষ্ট করে তোলে। অথচ তিনি অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হয়ে আচরণ করার শপথ নিয়েছেন। এক কুলাঙ্গার মোশতাককে দিয়ে পুরো কুমিল্লাকে বিবেচনা করা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। আর খুনি মোশতাক ছাড়াও কুমিল্লা কত হাজার কীর্তিমান মানুষের স্মৃতিধন্য, তার তালিকা দিতে গেলে এই লেখার কলেবরে কুলাবে না। আর এই লেখার বিষয়ও সেটা নয়। তবে সুযোগ পেয়ে বলে রাখি, একমাত্র বোন ছাড়া পরিবারের সবাইকে হারিয়ে শেখ হাসিনা অনেক আগেই সর্বংসহা হয়ে গেছেন। ব্যক্তিগত শোক, দুঃখ, প্রতিহিংসার অনেক ঊর্ধ্বে তাঁর অবস্থান। পিতা হত্যার বিচার করতে গিয়েও তিনি প্রতিহিংসা নয়, আইনের শাসনের এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন। তাই তার প্রতি অনুরোধ, এক কুলাঙ্গার মোশতাককে দিয়ে পুরো কুমিল্লার মানুষকে বিবেচনা করবেন না। তারা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসে, মোশতাককে ঘৃণা করে। বরং কুমিল্লার মানুষ ৭৩ সালেই মোশতাককে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তখন জাসদ নেতা রশিদ ইঞ্জিনিয়ারের বিরুদ্ধে মোশতাককে জেতাতে ব্যালট বাক্স হেলিকপ্টারে দাউদকান্দি থেকে ঢাকায় নিতে হয়েছিল। আশা করি প্রধানমন্ত্রী কুমিল্লাবাসীর আবেগের প্রতি সম্মান রেখে 'কুমিল্লা' নামেই বিভাগ দেবেন।

সুযোগ পেয়ে একটু অঞ্চলপ্রীতি দেখিয়ে দিলাম। তবে বলছিলাম বাহারের কথা। শুনি ‘কুমিল্লার হিরো’ বাহারের কথা ছাড়া নাকি কুমিল্লায় গাছের পাতাও নড়ার সাহস পায় না, সেখানে এত বড় তাণ্ডব কীভাবে ঘটলো? হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ প্রামাণিক হামলার জন্য সরাসরি স্থানীয় এমপি বাহারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করেছেন। আমি বাহাউদ্দিন বাহারকে যতটুকু চিনি, এ অভিযোগ আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু সরাসরি বাহারের না হলেও তার লোকজনের সম্পৃক্ততার কথা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে। পবিত্র কোরআন  অবমাননাকারী ইকবাল স্থানীয় কাউন্সিলরের স্নেহধন্য। ভোরে এই ঘটনার লাইভ সম্প্রচার করা ফয়েজের সঙ্গে এমপি বাহারের একাধিক সেলফি এখন ফেসবুকে ঘুরছে। আরেক আসামির বাবা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা। সাম্প্রদায়িক হামলার জন্য সরাসরি বাহার নির্দেশ দিয়েছেন, এমনটা বিশ্বাস না করলেও দলের ঘরে যে বিভীষণ ঢুকেছে; তা বুঝতে পণ্ডিতও হতে হয় না, ডাক্তারও হতে হয় না।

পীরগঞ্জ শেখ হাসিনার শ্বশুরবাড়ি এবং নির্বাচনি আসন। উপনির্বাচনে সেখানে জয়ী হয়েছেন স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রীর ও স্পিকারের আসন পীরগঞ্জে ঘাসও নাকি আওয়ামী লীগ করে, সেখানে কীভাবে অপশক্তি সংখ্যালঘুদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে পারে? এখন জানা যাচ্ছে, পীরগঞ্জে হামলার মূল আসামি একজন ছাত্রলীগ নেতা। হাজীগঞ্জের ঘটনায়ও সরকারি দলের সম্পৃক্ততার কথা চাউর হয়েছে। এই তাণ্ডবের সময় প্রতিরোধ গড়ার বদলে সাম্প্রদায়িক স্ট্যাটাস দেওয়ার দায়ে ছাত্রলীগের তিন নেতাকে বহিষ্কারের খবর পড়েছি পত্রিকায়। নুজহাত চৌধুরীরাই আওয়ামী লীগের সত্যিকারের বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী। তিনি ঠিকই বুঝেছেন, ঘরে বিভীষণ ঢুকে গেছে। ভয়ংকর কথা হলো, এই বিভীষণের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।

নুজহাত চৌধুরী ঘরেরর শত্রু বিভীষণদের চিহ্নিত করা এবং দল থেকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছেন। কাজটা খুব সহজ কিন্তু অসম্ভব। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের চেয়ে ভালো করে আর কেউ আওয়ামী লীগকে চেনেন না। তিনি ছাত্রলীগের কর্মী থেকে ধাপে ধাপে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। তিনি জানেন কোথায় কে আওয়ামী লীগ আর কে সাম্প্রদায়িক হাইব্রিড। আর এই হাইব্রিডদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার ওবায়দুল কাদেরই। কিন্তু দলের হাইব্রিড এবং বিভীষণদের চিহ্নিত বা বহিষ্কারের কোনও দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। ভয়টা হলো এই বিভীষণরা না আবার আওয়ামী লীগকে গিলে খায়।

ফেসবুকে ছাত্রলীগ নামধারীরা যে ভাষায় তর্ক করেন, তা দেখলে তাকে শিবিরও মনে হয় না; মনে হয় জেএমবির জঙ্গি কেউ। দেশে এখন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চলছে। প্রায়ই পত্রিকায় দেখি ‘শিবির নেতা’, ‘জামায়াত নেতা’, ‘বিএনপি নেতা’ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছে। আর আওয়ামী লীগে রাজাকারের ভিড়ের কথাটি এসেছে ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যেও। গতকাল এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘যার সঙ্গে তার বনবে না, তাকে বলবে রাজাকারের ছেলে। অথবা বলবে রাজাকারের নাতি বা শান্তি কমিটির সদস্য ছিল তারা। এসব অভিযোগ করে একজন আরেকজনের প্রতিপক্ষকে (আওয়ামী লীগের এক মনোনয়ন প্রত্যাশী আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশীর বিরুদ্ধে)। এসব অভিযোগের স্তূপ হয়ে গেছে পার্টি অফিসে।’ তবে শুধু ‘অভিযোগের স্তূপ’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ঘরের ভেতর বিভীষণ যে ঢুকেছে, সেটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। সব অভিযোগ হয়তো সত্যি নয়। আবার সব অভিযোগ মিথ্যাও নিশ্চয়ই নয়। কীভাবে রাজাকারের নাতিরা আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়লো সেটা তদন্ত করতে হবে। অভিযোগের স্তূপ যাচাই বাছাই করতে হবে। এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তির কবল থেকে দেশ ও আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে দলে একটা কঠোর শুদ্ধি অভিযান দরকার। যাতে আওয়ামী লীগ ঘরের শত্রু বিভীষণের কবল থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু সমস্যা হলো, বেশ কয়েক বছর ধরেই এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু রাজাকারের নাতি এবং বিভীষণদের চিহ্নিত ও বহিষ্কার করার কোনও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। সব সংগঠনে যদি সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ঢুকে পড়ে তাহলে দেশটাকে বাঁচাবে কারা?

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

  

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ