X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিসিবি ধনী কিন্তু ‘অসুখী’

এম. এম. কায়সার
০৬ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৩০আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২১, ০৯:০৩

এম. এম. কায়সার

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কোষাগারে কত টাকা আছে সেটি আলোচনার বিষয়বস্তু না থাকলেও প্রায়ই সংস্থাটির বড় কর্তারা এই ধনসম্পদের পরিমাণ জানিয়ে বড় সুখ খোঁজেন। 

স্বপ্নে ও বাস্তবে সবসময় নিজেকে ধনী ভাবতে ভালো লাগে ধনী মানুষের। তারা নিজেকে ধনী বলতে পছন্দ করেন। ধনীর তালিকায় নিজেকে ওপরের দিকে দেখতে চান। একটু আলাদা ব্র্যাকেটে নিজেকে রাখতে পছন্দ করেন তারা। বিসিবিও ঠিক তা-ই।

আইসিসির কাছ থেকে পাওয়া অর্থ এবং টিভি সম্প্রচার ও জাতীয় দলের স্পন্সর– মূলত এই তিন খাত থেকে বিসিবি যা আয় করে তা দিয়ে বেশ আয়েশে বছর চলে যায় তাদের। নিজেদের খরচ মিটিয়ে দেশের অন্য বোর্ডকে সহায়তার নজিরও গড়েছে বিসিবি। উদ্বৃত্ত জমা করে বিসিবির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বেশ সমৃদ্ধ। বোর্ড সভাপতি তো গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘আমাদের ফিক্সড ডিপোজিট এখন ৯০০ কোটি টাকা।’

করোনাকালে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলোর ক্রিকেট বোর্ড আর্থিক সংকটে পড়েছিল। অনেক বোর্ড ক্রিকেটারদের বেতন কমিয়ে দেয়, এমনকি বোর্ডের স্টাফ সংখ্যা হ্রাস করা হয়। তবে সৌভাগ্যের বিষয় হলো, বিসিবিকে সেই কষ্ট করতে হয়নি। আর্থিক ঝামেলা পোহানোর দরকার পড়েনি। টাকা কোনও সমস্যা না। তারপরও বিসিবি সুখী হতে পারছে কই?

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দলের চরম ব্যর্থতায় শুধু বিসিবি নয়, পুরো দেশের ক্রিকেটই এখন প্রশ্নের মুখে। বাংলাদেশের এমন হতাশাজনক পারফরম্যান্সে বিদেশি ক্রিকেট বোদ্ধারাও হতভম্ব। একটি দল যখন টানা ব্যর্থতার বলয়ে ডোবে এবং ক্রমশ আরও ডুবতে থাকে; তখন এটা নিশ্চিত যে, সমস্যাটা বেশ বড়। বাংলাদেশ ক্রিকেট এখন সেই বড় সমস্যায় পড়েছে।

এমন দুঃসময় যে একসময় আসবেই সেটা প্রায় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু ক্রিকেট বোর্ড চোখ বুজে বালির মধ্যে মুখ গুঁজে রাখা সেই উটপাখি যেন! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাফল্য লাভের ফর্মুলা বা পদ্ধতি কোনও রকেট সায়েন্স নয়। বিশ্বের বাকি দেশগুলো যে পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় ক্রিকেটে সামনে বাড়ে, আমরা যে সেখান থেকেও হাত ধুয়ে অনেক দূরে।

বিসিবির টাকার কোনও সংকট নেই। কিন্তু এই টাকা কোথায় এবং কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় খরচ করলে সার্বিকভাবে দেশের ক্রিকেটের উন্নতি হবে, তেমন কোনও মাস্টারপ্ল্যানই যে নেই। দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্রিকেট কোচিং এবং অ্যাকাডেমিগুলোকে নিজেদের আওতাধীন করতে পারতো বিসিবি। এসব অ্যাকাডেমিকে সামান্য কিছু অর্থায়ন করে তাদের একটা বিধিবিধানের মধ্যে আনা যেতো। আগামী দিনের তারকা ক্রিকেটার খোঁজার জন্য এখন শুধু বিকেএসপির দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে বিসিবিকে। 

দেশের বিভিন্ন স্তরের ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে বিনিয়োগ করলে সেখান থেকে আগামী দিনের ক্রিকেটার পাওয়া যেতো। কিন্তু উল্টো কাজ করছে বিসিবি। তৃতীয় বিভাগ বাছাই ক্রিকেটে রাজধানীর অ্যাকাডেমিগুলো যাতে অংশ না নিতে পারে সেজন্য এই বাছাই পর্বে এন্ট্রি ফি করা হয়েছে ৫ লাখ টাকা! বিসিবির পছন্দের দুটি দল কেবল এই বাছাই পর্বে খেলে। সেখান থেকে তারাই পরে দ্বিতীয় বিভাগের সুপার লিগে উঠে আসে। সেই ক্লাব থেকেই বিসিবি পেয়ে যায় পছন্দের কাউন্সিলর। বিসিবির নির্বাচনে যাদের নিশ্চিত ভোট পান পরিচালকরা। আমি নিশ্চিত পুরো পৃথিবীর কোনও টুর্নামেন্টেই এন্ট্রি ফি ৫ লাখ টাকা নেই। বিসিবির ফিক্সড ডিপোজিটে আছে ৯০০ কোটি টাকা। অথচ তৃতীয় বিভাগের বাছাই পর্বের জন্য এন্ট্রি ফি রাখে তারা ৫ লাখ টাকা! অথচ যা হওয়া উচিত ছিল ফ্রি এন্ট্রি!

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শিক্ষানবিশের জায়গা নয়। এখানে শিখে তবেই আসতে হয়। এটা পারফরম্যান্স দেখানোর জায়গা। আর শেখার কাজটা সুসম্পন্ন করতে হয় ঘরোয়া ক্রিকেটে। যে ঘরোয়া ক্রিকেট বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। হয়তো বলবেন, ঘরোয়া ক্রিকেট তো হচ্ছে। নিয়মিতই হচ্ছে। মানছি, নিয়মিত হচ্ছে। কিন্তু সেখানে কি শিখছেন ক্রিকেটাররা? কোন উইকেটে হচ্ছে এই ক্রিকেট? আদতে কি প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনও বালাই আছে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে? চারদিনের ম্যাচ কেন দুই দিনে শেষ হচ্ছে– কখনও কি সংশ্লিষ্টদের কাছে বোর্ড সভাপতি জানতে চেয়েছেন? আসলে ভালোবাসার জন্য প্যাশন লাগে। বিদেশি ট্যুরে গিয়ে খেলা দেখার জন্য বোর্ড কর্তাদের যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আগ্রহ থাকে, তার ছিটেফোঁটাও কি ঘরোয়া ক্রিকেট দেখার জন্য তারা জমা রাখেন?

উত্তর হলো– না। উদাহরণ তো হাতের কাছেই। বিশ্বকাপ দেখতে ওমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত গেছেন ক্রিকেট বোর্ডের কতজন আর সে সময় দেশের চারটি ভেন্যুতে চলা জাতীয় ক্রিকেট লিগের খেলা দেখেছেন বোর্ড পরিচালকদের ক’জন?

দেখে মনে হচ্ছে, বিসিবি সভাপতি এবং পরিচালকদের কাজ কেবল জাতীয় দলের ১৫ ক্রিকেটারকে নিয়ে। শুধু ঢাকা বা মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মধ্যে যেন আটকে আছে তাদের ক্রিকেট দর্শন। গোটা বাংলাদেশের ক্রিকেট কীভাবে চলবে, কীভাবে চলছে– বাস্তবসম্মতভাবে সেই হিসাবের খোঁজ কি কখনও নিয়েছেন বোর্ডের বড় কর্তারা? রংপুর-পাবনা থেকে কাউন্সিলরশিপ পেয়ে বোর্ডে বসা পরিচালকদের কি কখনও বোর্ড সভাপতি জিজ্ঞেস করেছেন– তোমার জেলায় কি ক্রিকেট লিগ হচ্ছে? রাজশাহী, চট্টগ্রাম বা যশোরের ক্রিকেট নিয়ে আমরা কি কখনও স্বস্তিদায়ক এবং সুনির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনা পেয়েছি? আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা তৈরির ছেলেভোলানো গল্প আমরা ৯ বছর ধরে শুনে আসছি। প্রতিবার নির্বাচিত হয়ে বোর্ড কর্তারা নতুন করে প্রতিশ্রুতি দেন– আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা এবার তারা বানিয়েই ছাড়বেন। কিন্তু প্রতিবারই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যেন ভাঙার জন্য!

পুরো দেশের ক্রিকেটের দিকে নজর না দিয়ে শুধু প্রতি সিরিজে, প্রতি ম্যাচে শুধু সাকিব, তামিম, মাহমুদউল্লাহ, মুশফিকের পারফরম্যান্স কাটাকুটি করলে আপনি হয়তো তর্কে জেতার সুখ পাবেন; কিন্তু ক্রিকেটের ‘সুখী মানুষ’ হতে পারবেন না! বিপুল ধনী বিসিবি এখন তেমনই এক ‘অসুখী’।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, রাইজিং বিডি

/এসএএস/জেএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিশ্বসাহিত্যের খবর
বিশ্বসাহিত্যের খবর
দেশজুড়ে এমপিরাজ শুরু হয়েছে: রিজভী
দেশজুড়ে এমপিরাজ শুরু হয়েছে: রিজভী
স্কুল ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ