X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

সরল বিশ্বাস বনাম গরল মতলব

মাসুদ কামাল
১৫ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৩২আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০২১, ১৯:০৬
মাসুদ কামাল ৭২ ঘণ্টা বিষয়ক নির্দেশনার বিষয়ে প্রতিকার পাওয়া গেলো ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই। মাঝে শুক্রবার ও শনিবার ছিল। না হলে হয়তো আরও আগেই কিছু একটা হতো। বিচারক রায় দিলেন ১১ নভেম্বর। আর বিচারক সম্পর্কে প্রধান বিচারপতি সিদ্ধান্ত জানালেন ১৪ নভেম্বর। দুটি বিষয়ই ছিল আলোচিত, মানুষ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল– কী সিদ্ধান্ত আসে। ১১ নভেম্বর ছিল বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ অভিযোগ মামলার রায়। রায়ে সব আসামিকে (পাঁচ জন)  খালাস দেওয়া হয়। মানুষের প্রত্যাশা কি এরকমই ছিল? সবার কথা বলতে পারবো না, তবে আমি নিজে এবং আশপাশের যত লোকের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের কেউই এমন রায় চাননি।

কিন্তু মানুষের চাওয়া অনুযায়ী তো রায় হয় না। রায় হয় সাক্ষ্য-প্রমাণ ও আইনের ভিত্তিতে। হয়তো এই মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণ সেরকম ছিল না। তাই দুই নারী যে ধর্ষণের অভিযোগ করেছেন, সেটা বিচারকের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। এরকম হতেই পারে। তাই অন্য অনেকের মতো রায়ে আমি বিস্মিত হয়েছি, দুঃখিত হয়েছি, কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারিনি। বিচার, বিচারক বা রায়ের ক্ষেত্রে নিয়মটা এরকমই। কোনও রায়ে আপনি অসন্তুষ্ট হতে পারেন, দুঃখিত হতে পারেন, এমনকি রাগান্বিতও হতে পারেন, কিন্তু আপনি বলতে পারবেন না বিচারক দুর্নীতি করেছেন।  বলতে পারবেন না যে বিচারক পক্ষপাতমূলক রায় দিয়েছেন।

আমরা যখন ছোট ছিলাম, বড়দের কাছে শুনতাম বিচারকরা নাকি অনেকটা ভিন গ্রহের মানুষের মতো। তারা কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে যান না, মানুষের সঙ্গে তেমন একটা মেলামেশা করেন না। এই যে অসামাজিক জীবনযাপন, এর কারণ আর কিছু নয়, যাতে নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে পারেন সেই লক্ষ্যে। বিচারের সময় যাতে তিনি নির্মোহ থাকতে পারেন, সেজন্য পরিচিতির গণ্ডিটা পর্যন্ত তিনি ছোট রাখেন।

কিন্তু সেই দিন কি এখন আর আছে? সময় পাল্টে গেছে, মানুষ পাল্টে গেছে, বদলে গেছে মানুষের মূল্যবোধ। বিচারকদের এখন আর ভিন গ্রহের প্রাণী বলে মনে হয় না। বরং তার এই পৃথিবীরই মানুষ। পৃথিবীর মানুষেরা যেভাবে জীবনযাপন করেন, তারাও তেমনি। সাধারণ মানুষেরা কী করেন? বর্তমানে বসে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেন, ভবিষ্যতের কথা ভেবে সঞ্চয় করেন, ব্যাংক থেকে লোন নেন, বিনিয়োগ করেন। এই সবই আটপৌরে মানুষের আচরণ, চিন্তা। বিচারকরা তেমন চিন্তা করলে, খুব কি দোষ দেওয়া যাবে?

তাই মানুষই যদি মানবেন, তাহলে তাদের মানবিক সীমাবদ্ধতাগুলোকেও মানতে হবে। মানুষ মাত্রই ভুল হয়, হতে পারে। বিচারকও মানুষ, তারও ভুল হতে পারে। কাজেই তার রায়ে ভুল হতে পারে। এটা নতুন কিছু নয়। যুগে যুগে হয়ে এসেছে। কিন্তু সেই ভুলের কি কোনও প্রতিকার হবে না? অথবা সেই ভুলের বিচারটি কীভাবে হবে?

বছর বিশেক আগের একটা ঘটনার কথা এই প্রসঙ্গে স্মরণ করতে চাই। দেশের আইনমন্ত্রী তখন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। আমি প্রিন্ট মিডিয়া দৈনিক জনকণ্ঠে চাকরি করি। আমরা গিয়েছিলাম মওদুদ আহমদের ইন্টারভিউ করতে। এক পর্যায়ে ঠিক এরকম একটা প্রশ্ন আমি করেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম, বিচারকের ভুল একটা সিদ্ধান্তের কারণে যদি কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তার দায় কে নেবে? বিচারককে কি বিচারের সম্মুখীন করা যাবে না?

ব্যারিস্টার মওদুদের আইন সম্পর্কিত লেখাপড়া নিয়ে সন্দেহের কোনোই সুযোগ নেই। তিনি জ্ঞানী মানুষ। দেশ বিদেশের নানা উদাহরণ দিয়ে তিনি যা বললেন, তার বটম লাইন হলো- বিচারক যে রায় দিয়ে থাকেন, সেটা তিনি ন্যায়-নীতির ওপর ভিত্তি করে সরল বিশ্বাসে দিয়ে থাকেন। এ নিয়ে তাকে কোনও বিচারের মুখোমুখি করা যাবে না। এ রকম হলে তো তিনি বিচারই করতে পারবেন না। এই একটি জায়গা, বিচারকের সততা ও নৈতিকতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলা যাবে না। না হলে তো বিচার বিভাগই আর থাকে না।

ভদ্রলোকের যুক্তিটা আমার ভালো লেগেছিল। বিষয়টি নিয়ে পরে আরও অনেক আইন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। গড়পড়তায় সবাই এই একই লাইনে কথা বলেছেন। আমার নিজের কাছেও মনে হয়েছে, আসলেই একটি জায়গাকে তো অন্তত প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। না হলে শেষ ভরসার জন্য আর কোন জায়গাটা থাকলো?

তবে ইদানীং কেন জানি মনে হচ্ছে শেষ ভরসার সেই জায়গাটি আমরা আর নিরাপদ রাখতে পারছি না। এরমধ্যে রাজনীতি ঢুকে যাচ্ছে, অর্থনীতি ঢুকে যাচ্ছে। কখনও কখনও ইগো ঢুকে যাচ্ছে। আমরা বোধ করি আমাদের ইনস্টিটিউশনগুলো ভেঙে দিচ্ছি। শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের বিতর্কিত করে তুলছি। আবার কখনও কখনও শ্রদ্ধার সেই চেয়ারগুলোতে এমন লোককে নিয়ে বসাচ্ছি, যারা সেই আসনের যোগ্যই নয়।

উদাহরণ কিন্তু আমাদের সামনেই আছে। বেশি অতীতে যাওয়ার দরকার নেই, এই ক’দিন আগেই আমাদের একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির বিচার হলো। সাজা হলো অর্থ কেলেঙ্কারির দায়ে। রায় যখন হয়েছে, তখন ধরেই নেওয়া যায় তিনি অন্যায়টি করেছেন। তিনি এখন অবসরপ্রাপ্ত, বিদেশে। দেশ ছেড়ে চলে না গেলে হয়তো জেলেই থাকতে হতো। যে অন্যায়ের জন্য ওনার সাজা হলো, সেটা উনি যে সময়ে করেছেন তখন তিনি প্রধান বিচারপতির আসনে ছিলেন। তাহলে দেশের একজন প্রধান বিচারপতিও অন্যায় করতে পারেন? অথবা উনি কি তাহলে বিচারপতি হওয়ার যোগ্য ছিলেন না? অযোগ্য লোককে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে বসানো হয়েছিল? প্রধান বিচারপতির পদে থাকা একজন ব্যক্তিকে যখন সাজা দেওয়া হয়, তখন বিচারপতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনোভাব কেমন হয়? মানবজাতির এই একটি প্রজাতি ভুল করতে পারে না বলে মানুষের মধ্যে যে ধারণাটি রয়েছে, সেটি কি আর অটুট থাকে? মানুষ তো তাহলে ভাবতে শুরু করবে, কেউই অসাধারণ নয়, সবাই সাধারণ। ভুল, অন্যায়, অপরাধ- সবাই করে।

আমরা কিন্তু কেবল এস কে সিনহার বিচার করিনি, দেশের একজন প্রধান বিচারপতিরও বিচার করেছি। ফলে এর মাধ্যমে ক্ষতি যা হওয়ার তা হলো, বিচার বিভাগের ওপর, বিচারকদের ওপর মানুষের শ্রদ্ধাবোধটা একটু হলেও ঝাঁকুনি খেলো।

এসব কারণেই কি এবার রেইনট্রি হোটেলকাণ্ডের এই মামলার রায় নিয়ে মানুষের এত হতাশা? সেটা হতে পারে। হতে পারে তেমন হতাশা আমার মনেও রয়েছে। কিন্তু তা নিয়ে আমরা কথা বলবো না, বলতে পারবও না। সবাই যে প্রসঙ্গটি নিয়ে বলছেন, ওই যে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মামলা দায়েরের বাধ্যবাধকতা, কিংবা বাদীর যৌন-অভ্যস্ততা বিষয়ক বিচারকের পর্যবেক্ষণ, আমরা বরং সেই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে পারি। কী করে এমন কথা বলেন তিনি! ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টার পরে এলে মামলা না নেওয়ার যে পরামর্শ এই বিচারক পুলিশকে দিয়েছেন, সেটাকে এরইমধ্যে দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা তার এখতিয়ারবহির্ভূত বলে অভিহিত করেছেন। অনেকেই বলেছেন, এ ধরনের পরামর্শ ধর্ষকদেরই বরং উৎসাহিত করবে। ধর্ষণের পর তারা কোনও না কোনোভাবে ধর্ষণের শিকার নারীকে ৭২ ঘণ্টা আটকে রাখার চেষ্টা করবে। কেউ কেউ এমনও বলেছেন, এভাবে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া রীতিমতো হাস্যকর। উদাহরণ তো হাতের কাছেই আছে। এই যে আমরা একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করলাম, এখনও করছি, সেখানে তো ৫০ বছর পরেও ধর্ষণের অপরাধগুলো বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।

আবার ধরা যাক, বাদী দুই শিক্ষার্থীর যৌন অভ্যস্ততার বিষয়টি। তারা যৌনতায় আগে থেকেই অভ্যস্ত ছিল কিনা, এটা বিচারের পর্যবেক্ষণে কীভাবে আসে? এই বিষয়টা নিয়েও অনেকে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। আসলে প্রশ্নটা দাঁড়িয়ে গেছে মানসিকতার। এই ধরনের পর্যবেক্ষণের পেছনে বিচারকের কি মানসিকতা কাজ করেছে, তা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।

এসবের বিপরীতে সরকার, প্রধান বিচারপতি যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার প্রশংসা করতেই হয়। তাঁরা  দ্রুতই সর্বসাধারণ্যে আলোচনাটিকে থামিয়ে দিতে চেয়েছেন। তারা হয়তো ভেবেছেন, এই সংবেদনশীল বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশি বেশি আলোচনা হতে দিলে সেটা হয়তো শেষ পর্যন্ত গিয়ে পুরো বিচার বিভাগের ভাবমূর্তির ওপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এমন ভাবনা অমূলক বলা যায় না। আমরা কিন্তু মানুষের মুখে নানা কথা শুনি। এই যে হুটহাট পুলিশ চাইলেই রিমান্ড দেওয়া, এ নিয়ে মানুষের মতামত প্রায়ই শোনা যায়। আলোচনা বিস্তৃত হতে হতে হয়তো একটু বেশিই ছড়িয়ে পড়েছিল। নয়তো, উচ্চ আদালতই বা এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করবেন কেন?

আসলে সরকার ও বিচার বিভাগকে এখন আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। পুলিশ ও বিচার বিভাগের মধ্যে বিশাল একটা পার্থক্য রয়েছে। পুলিশ বিভাগের ওপর সাধারণ মানুষের কতটুকু আস্থা আছে- তা নিয়ে সমাজে সবসময়ই বিশাল একটা সন্দেহ ছিল। যত দিন যাচ্ছে, সে সন্দেহ বাড়ছেই কেবল। এই সন্দেহ হয়তো সবসময় যথাযথ নয়। কিন্তু তারপরও এটা দূর তো করা যাচ্ছে না। এমন আস্থাহীনতার মধ্যে থেকেও বিভাগটি কিন্তু তাদের কাজকর্ম ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে। কাজকর্ম চালিয়ে যেতে তেমন একটা সমস্যাও হচ্ছে না।  কিন্তু এই সুবিধাটি বিচার বিভাগের নেই। এখানে আস্থাটিই সবচেয়ে জরুরি বিষয়।

ছাত্রজীবনে আমার এক বন্ধু ছিলেন। খুবই মেধাবী সেই বন্ধু যখন বিসিএস পরীক্ষা দেন, প্রথম পছন্দ হিসেবে ‘পুলিশ’ লিখেন। আমরা জানতে চেয়েছিলাম- পুলিশ কেন? সে অকপটে জবাব দিয়েছিল- এখানে টাকা আছে, দাপট আছে! তার সেই কথা কতটুকু সত্য, কতটুকু মিথ্যা সে আলোচনায় না গিয়েও এতটুকু অন্তত বলতে পারি, জুডিশিয়ারিতে যাওয়ার আগ্রহ দেখানোর সময় কাউকে অন্তত আমি টাকা ও দাপটের কথা বলতে শুনিনি। তাই বিচার বিভাগের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা থাকার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আস্থাটি থাকলে, তাদের সিদ্ধান্ত আমার প্রত্যাশার বিপরীতে গেলেও সেটাকে ‘সরল বিশ্বাসে’ দেওয়া বলে মেনে নিতে পারি। এই আস্থাটা নষ্ট হয়ে গেলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। তখন সরল বিশ্বাসকেও গরল মতলব বলে মনে হতে পারে।
 
লেখক: হেড অব নিউজ, বাংলা ট্রিবিউন
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ