X
সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫
২ আষাঢ় ১৪৩২

তার পদত্যাগ যথেষ্ট নয়

আনিস আলমগীর
০৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০২আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০২১, ১৮:৪০

আনিস আলমগীর তাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া সরব ছিল অনেক দিন থেকে। সোশ্যাল মিডিয়ার সেসব বক্তব্যে তিনি যেমন নিজেকে ‘আমি কী হনুরে’ ভাব নিয়ে কথা বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সোল এজেন্ট জাহির করতেন, এর কয়েকগুণ বেশি তার গালাগালি থাকতো প্রতিপক্ষকে। এরমধ্যে সবচেয়ে পরিচিত বিশেষণ- ‘মুরাদ টাকলা’। তার কারণে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রতিও বিরূপ মন্তব্য থাকতো। তার মিশন দেখে আমার মনে হতো যে করেই হোক তিনি আলোচনায় থাকতে চান। মনে হতো সোশ্যাল মিডিয়ায় তার নিজের এবং প্রতিপক্ষ মৌলবাদী গোষ্ঠীর এই নোংরা যুদ্ধ তিনি উপভোগ করছেন। কারণ, তিনি থামছিলেন না; বরং তার উল্টা-পাল্টা, ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর সায় আছে বলে সাফাই গেয়ে আসছেন।

তবে এক ইউটিউবারের সঙ্গে তারেক জিয়ার কন্যাকে নিয়ে তার নারীবিদ্বেষী, কুরুচিপূর্ণ ভিডিও ক্লিপ এবং ঢাকার চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সঙ্গে নানা অশোভন কথাবার্তা ও হুমকিপূর্ণ ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় মনে হয়েছে মোহাম্মদ মুরাদ হাসান প্রতিমন্ত্রীর পদে থাকার যোগ্যতা রাখেন না। সে কারণে তার বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হতে বাধ্য হয়েছি, যদিও তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, দেখাও হয়নি। তার শ্রবণ-অযোগ্য, অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় নয়, গণমাধ্যমেও আলোচনার বিষয় হয়েছে।

১ ডিসেম্বর ২০২১ মুরাদ হাসান তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে জায়মা রহমান সম্পর্কিত ভিডিও শেয়ার করেছেন। তার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হলে সেটাকে ডিফেন্ড করে বানানো আরেকটি ভিডিও শেয়ার করেছেন।

সর্বশেষ এলো তার ফোনালাপ ফাঁসের অডিও। ফলে এ ধরনের কুরুচিপূর্ণ কথা একজন সংসদ সদস্য, একজন প্রতিমন্ত্রী করতে পারেন কিনা প্রশ্ন উঠেছে সব মহলে। প্রশ্ন উঠেছে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দুর্দশা নিয়ে। কারণ, এগুলো রাজনৈতিক নেতার ভাষা হতে পারে না, আওয়ামী লীগের সঙ্গে যায় না। অবশ্য মুরাদ হাসান তার তোয়াক্কা করেন মনে হয়নি। পত্রিকায় দেখলাম, তিনি বলেছেন এই বক্তব্য (জাইমা সম্পর্কিত) প্রত্যাহারের কোনও প্রশ্নই আসে না।

বিবিসি বাংলাকে দেওয়া বক্তব্যে এর পক্ষে মুরাদ হাসান বলেন, তিনি বক্তব্য দেওয়ার আগে তাকে ‘নোংরা ভাষায়’ আক্রমণ করে কথা বলেছেন তারেক রহমানের কন্যা। ‘আমার মেয়ের বয়সের চেয়ে সে এক বছরের বড়। আমার কন্যার মতো বয়সী হয়ে যে নোংরা ভাষায় আমাকে নিয়ে ট্রল করেছে, সেটা তো কুচিন্তনীয়। এটা আমার কাছে খুব দুঃখজনক মনে হয়েছে। তার সম্পর্কে সামাজিক মাধ্যমের অনেক ছবি আমার কাছে চলে এসেছে।’

মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে তারেক রহমানের কন্যা কী বলেছেন আমি জানি না। কোথাও দেখিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় জাইমার কোনও অ্যাকাউন্ট নেই, তারেক রহমানের নেই, মির্জা ফখরুলের নেই– বিএনপির তরফ থেকে এটা অনেকবার বলা হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী তার অবস্থান থেকে জাইমা তাকে আক্রমণ করেছেন কিনা যাচাই করা কোনও ঘটনা না। সেটা না করে তিনি সমাজ-সংস্কৃতি বিবর্জিত ভাষায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কন্যাকে আক্রমণ করার অধিকার রাখেন না। জাইমার বাবা তারেক রহমানকে নিয়ে মুরাদ যদি কিছু বলে থাকেন সেটা নিয়ে তো কারও মাথাব্যথা নেই। তারা দুজনই রাজনীতি করেন। কিন্তু তাদের ছেলেমেয়েরা তো রাজনীতিতেই আসেনি, এখনও তারা প্রাইভেট পার্সন।

মুরাদ হাসান জাইমার রাজনীতিতে আসারও বিরোধী। মুরাদের ভাষায়, রাজনীতি করবে তার রাজকন্যা, রাজপুত্র। ভাবখানা এমন, রাজকন্যা আর রাজপুত্ররা ছাড়া বা জাইমারা ছাড়া অন্যদের রাজনীতিতে প্রবেশাধিকার নেই। যখন কেউ নিজের সন্তানকে রাজপুত্র আর রাজকন্যা বলেন, পক্ষান্তরে তিনি নিজেকেও মনে মনে রাজা বানান। রাজার মুখের ভাষা যদি এমন হয় এবং সেই ভাষা নিয়ে রাজা নিজেই আবার ‘ছ্যাবলার’ মতো গর্ব করে বলেন—‘আমার মুখ ভীষণ খারাপ’, সেই রাজ্যে প্রজাদের অবস্থান কোথায় বলার অপেক্ষা রাখে না।

মুরাদ হাসানের কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য ভাইরাল হওয়ার পর যখন নানা মহল থেকে সমালোচনা হচ্ছিল আর যথারীতি ‘সহমত ভাইয়েরা’ মুরাদের পক্ষ নিয়ে নরম সুরে সেটা জায়েজ করতে বসেছেন তখনই সিনেমার নায়ক-নায়িকার সঙ্গে মুরাদের ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। কী জঘন্য, কী নোংরা একজন মন্ত্রীর আচরণ—সেই ফোনালাপে তা ধরা পড়ে। ফোনালাপ মুরাদের– সেটা ফোনের অপর প্রান্তে থাকা নায়ক ইমনের ভাষ্যে প্রমাণিত। ইমন ওই ফোনালাপ নিয়ে মিডিয়াকে বলেছেন, মন্ত্রীকে ম্যানেজ করতে সে ওই সময় সায় দিয়েছিল। 

আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিজীবন আছে, কেউ আমরা ধোয়া তুলসি পাতা নই। প্রেম-ভালোবাসা, পরকীয়া অনেকের জীবনে থাকে। সম্মতির সম্পর্ক হলে অন্যের মাথা ঘামানোর কিছু নেই। কিন্তু বাংলা সিনেমার যে নায়িকা তাকে এড়িয়ে চলছেন, ফোন ধরেন না, তাকে জোর করে বিছানায় নিতে চাওয়া, ‘আমি এখন পুলিশ, ডিবি, এসবি, এনএসআই, ডিজিএফআই পাঠাচ্ছি, তোরে বাইন্ধা নিয়ে আসবে’ বলে হুমকি দেওয়ার এমন ঘটনা কোনও সভ্য সমাজে আছে? কোন রাষ্ট্রে আছে?

এটা কী ক্ষমতার অপব্যবহার বা ঔদ্ধত্য বলবো? নাকি আমাদের সিনেমা ‘পট্টিতে’ এখন এই সংস্কৃতির বিস্তার হয়েছে, ইচ্ছা হলে কোনও নায়িকাকে ‘সিনেমা মন্ত্রী’ বিছানায় নিতে পারেন? মন্ত্রীকে নায়িকা জোগান দেওয়ার জন্য নায়ককে ব্যবহার করা যায় বা ঢালিউডের নায়করা নিজেই পিম্প হিসেবে কাজ করে?  

মন্ত্রী নিজেকে প্রজাতন্ত্রের চাকর বলছেন কিন্তু তার পজিশনকে নিয়ে গেছেন দানবের জায়গায়। প্রজাতন্ত্রের চাকর জনগণের মনে বিশ্বাস এবং আস্থা জমাবেন। কিন্তু তিনি নিজেই যদি অপকর্মে লিপ্ত হন অন্যকে রক্ষা করবেন কখন? গণমাধ্যমে আজ নারীরা ধর্ষিত শীর্ষ কর্তাদের দ্বারা, সহকর্মী দ্বারা যৌন হেনস্তার শিকার। গণমাধ্যমমন্ত্রীর চরিত্র যদি এমন হয় তারা আশ্রয় চাইবে কার কাছে?

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে এভাবে প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার মুরাদ হাসানকে কে দিয়েছে সেটা আওয়ামী লীগাররা প্রশ্ন তুলতে পারেন এখন, কিন্তু রাষ্ট্রের জনগণ প্রশ্ন তুলতে পারেন—আমাদের কষ্টের করের টাকা এমন মানুষদের বেতন এবং ভোগের জন্য ব্যয় করা হোক আমরা চাই না। সংবিধানের ওপর শপথ নেওয়া একজন মানুষ এ ধরনের আচরণ করবে এটা কাঙ্ক্ষিত নয়। এটা সংবিধান অবমাননা। দেশীয় আইনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয় এবং সংসদ থেকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তার পদত্যাগ বা তাকে পদত্যাগ করতে বলা যথেষ্ট নয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শাহবাগে ছাত্রলীগের বিক্ষোভ, ঢাবিতে ককটেল বিস্ফোরণ
শাহবাগে ছাত্রলীগের বিক্ষোভ, ঢাবিতে ককটেল বিস্ফোরণ
ইসরায়েলি হামলায় আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধান ও দুই জেনারেল নিহত
ইসরায়েলি হামলায় আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধান ও দুই জেনারেল নিহত
কলকাতায় ভয়াবহ আগুনে পুড়লো ৪০০ দোকান
কলকাতায় ভয়াবহ আগুনে পুড়লো ৪০০ দোকান
আবার মঞ্চে ‘পাইচো চোরের কিচ্ছা’
আবার মঞ্চে ‘পাইচো চোরের কিচ্ছা’
সর্বশেষসর্বাধিক