X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংখ্যালঘু শব্দের যথার্থ বণ্টন

হায়দার মোহাম্মদ জিতু
০৫ জানুয়ারি ২০২২, ২০:৩৯আপডেট : ০৫ জানুয়ারি ২০২২, ২০:৩৯
হায়দার মোহাম্মদ জিতু নিজের অবয়ব দেখতে যেমন আয়না প্রয়োজন তেমনি সংস্কৃতি ও আচরণ বুঝতে সমকালীন কবি-সাহিত্যিক, সংস্কৃতি কর্মীদের কর্ম বিবেচনা আবশ্যক। এ হিসেবে বাঙালির সবেধন নীলমণি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচনা বাঙালির অসাম্প্রদায়িকতার মানস চিত্রিত করে। মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান। মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ। এ  ধরনের রচনার মধ্য দিয়ে তৎকালীন সময়ের ঐক্যবদ্ধ চিন্তার সামাজিক বাসনা ও চেষ্টা স্পষ্টতর হয়।

বৈরী বিষয় হলো, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়গুলোর আরও উন্নতি হওয়ার কথা রইলেও কিছু লেবাসধারীদের কারণে এই বিষয়গুলোতে নতুন করে সন্দেহ ঢুকতে শুরু করেছে। কারণ, বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জীবনাচরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে শৈশব-কৈশোরে ধূর্তভাবে ধর্মের কাঁটাতার ও আগ্রাসনকে মগজে ঢোকানোর স্রোত চলছে।

প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হিসেবে গাঁয়ের পিঁপড়ে নিয়ে খেলার বিষয়টিকে তুলে আনা যায়। পিঁপড়ে নিয়ে খেলার সময় মারতে হলে লাল পিঁপড়াকে উৎসাহিত করা হয়, কালো পিঁপড়াকে নয়। কারণ, লাল পিঁপড়া হিন্দু এবং কালো পিঁপড়া মুসলিম। এই বিষয়টিতে ছোট্ট অথচ সূক্ষ্ম নিরীক্ষণ আছে। তা হলো, হিন্দু হলে তার মানে তাঁকে মারা যায় এবং সেটার বৈধতা আশপাশ মিলিয়ে দিচ্ছে শৈশবেই! পাশাপাশি ছোটতেই পাশবিকতার চরম স্তরকে অভ্যাসে রূপ দেওয়ার প্রশিক্ষণ চলছে।

সাম্প্রদায়িকতার আরেক ঊর্বর কারবারি নতুন নতুন গজে ওঠা সমাজসেবীরা। পেশাভিত্তিক জীবন বিবেচনায় এদের আয়-ব্যয়ের হিসাব না মিললেও এরাই উঠতি মাদ্রাসা-মক্তব ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্মাতা। ক্ষেত্রবিশেষে এদের কারও কারও অক্ষরজ্ঞানও নেই। ফলাফল ভাবনাহীনভাবে আবার কোথাও কোথাও ভাবনা থেকেই ড্রেস কোড হিসেবে মাথায় টুপি যুক্ত করা হচ্ছে।

বিশদ বিবেচনায়, এসবই আগামীর বাংলাদেশকে বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদের উঠোন থেকে একপেশে টানেলে বন্দি করার মতলব। বহু ব্যঞ্জনার বিষয়সমূহকে আড়াল করে ধর্মের দোহাইয়ে বিভাজনের সংস্কৃতির প্রসারের চেষ্টা। এছাড়া আরেক উপদ্রব হলো, নিছক কিছুতে গালি হিসেবে ‘মালাউন’ শব্দকে ব্যবহার, হিন্দুদের ‘বিধর্মী’ বলা। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন উত্থাপন জরুরি, হিন্দু ধর্মও তো একটি ধর্ম। তাহলে তারা ‘বিধর্মী’ হয় কী করে? তাছাড়া খোদ ইসলাম অন্য ধর্ম এবং তাঁর অনুসারীদের কী পরিমাণ সম্মানের চোখে দেখে তাও এই শ্রেণির জানা প্রয়োজন।

বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তৎকালীন হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের স্মৃতিচারণে বন্ধু ননীকুমারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া একটি গল্পের উল্লেখ আছে। যেখানে বন্ধু হিসেবে তাঁরা নিজেরা অবাধ মেলামেশা ও যাতায়াতের স্বাধীনতা ভোগ করতে চাইলেও সমাজ সেটাকে সরল পথে নেয়নি। যার প্রমাণ বঙ্গবন্ধু ননীকুমারের বাসায় যাওয়ায় তাঁর গমনের স্থান ধুয়ে ফেলতে বাধ্য করা হয়।

অর্থাৎ বিভাজন বড়রাই করছে, করে চলেছে। আরও স্পষ্ট করে বললে, সাম্প্রদায়িকতা, অসাম্প্রদায়িকতা কিংবা ভালোবাসা-ঘৃণা সকল ‘চর্চা-শিক্ষা’ই পরিবার কেন্দ্রিক এবং প্রাথমিক। কাজেই পারিবারিক শিক্ষার বিষয় জোর দেওয়া জরুরি। পাশাপাশি বিশ্বায়নের এই সময়ে যখন মানুষ আসমান জমিনের রহস্য উদঘাটনে এগিয়ে চলছে সেখানে আমাদেরও এই আহ্বান গ্রহণ করা জরুরি।

চুটকি আছে, দুই ভাইয়ের ঝামেলা না হলে প্রতিবেশী দাওয়াত পায় না। মুরগির রানের বড় পিসটা খেতে পায় না। এই হিসেবে এখানেও কিছু মানুষ আছেন, যাদের জীবন, যৌবন, পেশা সবটাই ওই প্রতিবেশীর চরিত্রের মতো। অর্থাৎ, গোলমাল, ঝামেলা না বাধালে, না জিইয়ে রাখলে তাদের দোকান বন্ধ হয়ে যায়। বিস্তৃত অর্থে, এদের কাজই হলো ঝামেলা বাধিয়ে বিদেশি বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, ডাকা। যাতে তারা মাতবরির সুবিধা কাজে লাগিয়ে বাণিজ্য ও খবরদারি করতে পারে।

কিন্তু এদের এখন বোঝা জরুরি, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে আর কারও খবরদারি চলে না, চলবে না। এসব আর জনগণ বরদাশত করে না। প্রকৃত অর্থে, উন্নয়নে অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতার মানসই হবে এখানকার বন্ধুত্বের মাপকাঠি, আগামীর রাজনৈতিক ক্ষমতার মাপকাঠি। কোনও বিভাজন, সাম্প্রদায়িকতা এখানে প্রতিষ্ঠিত হবে না। ত্রিশ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমে অর্জিত এই দেশে ধর্মের কারণে কেউ সংখ্যালঘু বলে বিবেচিত হবে না, নত মস্তকে থাকবে না।

বাঙালির বেহুলা, লড়াকু শেখ হাসিনার বাংলাদেশে সংখ্যালঘু শব্দটি শুধু যারা চিন্তায় এবং সাম্প্রদায়িকতায় মশগুল তাদের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হবে। আরও বিস্তৃত অর্থে বললে, এই সহজিয়া বাংলার সংস্কৃতিতে এরাই সংখ্যায় অল্প। হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, আদিবাসী অন্য কেউই নয়। এই শিক্ষাই শৈশব-কৈশোর থেকে পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গড়ে উঠতে হবে। এই জাগরণই আমাদের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ।

লেখক: প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ।

[email protected]
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ