X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের স্বাধীনতা শব্দটি

হায়দার মোহাম্মদ জিতু
০৭ মার্চ ২০২২, ২২:০৩আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২২, ২২:০৩

হায়দার মোহাম্মদ জিতু প্রবাদ, প্রবচন যে কোনও জাতি রাষ্ট্রের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আচরণের আবহে নির্মিত-বিনির্মিত হয়। সে হিসেবে বাঙালির জীবনে স্বাধীনতা শব্দটি সব সময়ই অসময়ের দশ ফোঁড় হয়ে বসেছিল। ইতিহাসের অনুরণনেও তা স্পষ্ট। এই মাটির স্বাধীনতার জন্য নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, প্রীতিলতা প্রমুখ লড়াই করেছিলেন। কিন্তু একক বঙ্গবন্ধু এক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। সহজিয়া বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে স্বাধীনতার আরাধ্য স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছেন।

এই আরাধ্য বাস্তবতা ঘরে ফসল হিসেবে ধরা দিতে বহু যাতনার সাক্ষী এই মাটি। তবে এটা প্রমাণিত যে একে ত্বরান্বিত এবং নেতৃত্ব পূর্ণ করে তুলেছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। এই ভাষণের মূল্যায়নে, কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন,

‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,

রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে

অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।

তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,

হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার

সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?

গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি:

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’

৭ মার্চের ভাষণকে মূল্যায়ন আরও আরও ডিসকোর্স এবং চিন্তা জরুরি। কারণ আজও কেউ কেউ এই ভাষণের দিন কেন বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন না এটাও নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এদের জবাব দেওয়া প্রয়োজন, জানানো জরুরি তৎকালীন সময়ে ক্ষমতা কাঠামো পাকিস্তানিদের হাতে ছিল। কাজেই আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে আক্রমণ মানেই বাঙালিকে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী বা বিছিন্নতাবাদী হিসেবে প্রকাশ, প্রচার এবং প্রমাণ করা হতো। স্বাভাবিকভাবে বৈশ্বিক সমর্থন ও সহানুভূতি তখন পাকিস্তানিদের মিলত।

আক্রান্তের প্রতিরোধ গড়বার এবং ঘুরে দাঁড়াবার সাহস যৌক্তিক। বাঙালি আক্রান্ত হওয়ার পরপর বিশ্বব্যাপী সেই সমর্থন পেয়েছিল। এই ভাষণের মাহাত্ম্য বোঝা যায় আরেক দিক দিয়ে। রেসকোর্সের মাঠে তরুণ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এ ভাষণের ভাষান্তরের করছিলেন। কিন্তু ভাষণ শুরুর খানিক পরে তাকে থামিয়ে ভিনদেশি সাংবাদিক মন্ত্রমুগ্ধের মতো বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনছিলেন। ভাষণ শেষে তিনি কিছু বুঝতে পেরেছেন কিনা এনিয়ে প্রশ্ন করলে, কেবল মাত্র বলেছিলেন, ‘Get Ready’। অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পারফরম্যান্স কোয়ালিটি তাকে ভেতরের গূঢ়ার্থ বুঝতে সহায়তা করেছিল।

তাত্ত্বিক স্টুয়ার্ট হলের রিপ্রেজেন্টেশন ধারণার এনকোডিং এবং ডিকোডিং ধারণা এক্ষেত্রে উল্লেখ্য। এনকোডিং মানে পারফর্মার নিজে যা করে। অন্যদিকে ডিকোডিং অর্থ, দর্শক সেখান থেকে যা বুঝতে পারেন। বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের সহযাত্রী এবং নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে ডিকোড করতে পেরেছিলেন। যার ফলাফল ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বা পারফর্মার হিসেবে এনকোডিং। একারণেই মঞ্জুরুল ইসলামের সাথে থাকা বিদেশিজন বাংলা ভাষা না বুঝলেও তার ভাবার্থ ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ, ডিকোড করতে পেরেছিলেন। এদিক বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পারফর্মিং উচ্চতা অনন্য।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে কলকাতা কিংবা নদিয়া অঞ্চলের ভাষা কিংবা তথাকথিত এলিট শ্রেণির ভাষা ব্যবহার করেননি। করেছেন নিপীড়িত মানুষের মুখের এবং ব্যবহারিক ভাষা। ‘ভাইয়েরা আমার ...’ এই এক আহবানে সকল, ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের বিভাজনকে এক জায়গায় নিয়ে এসেছেন। প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব। তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’। অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধু নিজে জনগণের সাথে, জনগণের হয়ে, জনগণের জন্য রক্ত দেবার অঙ্গীকার করেছেন।

এ ভাষণের তাৎপর্য অনুধাবনে ইউনেস্কো একে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে অভিহিত করেছে। বৈশ্বিকভাবে আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিংসহ ঐতিহাসিক ভাষণের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। কিন্তু অন্য সব ভাষণের থেকে এটি ওইখানটায় অনন্য যে বাকিরা ভাষণ দিয়েছেন স্থিরতামূলক পরিস্থিতির মাঝে। বঙ্গবন্ধু ভাষণটি দিয়েছিলেন, ক্যান্টনমেন্টে সেনাদের আক্রমণ প্রস্তুতি এবং চারদিকে হেলিকপ্টারের সতর্ক নজরদারির ভেতর। এর বাইরে দলের ভেতরে-বাইরে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার চাপ তো ছিলই।

বঙ্গবন্ধুর মুনশিয়ানা ওইখানটায় যে তিনি সকল কিছুই কৌশলে বাস্তবায়ন করে গেছেন। জানিয়ে গেছেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়া স্বরূপ, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক, বিচার বিভাগীয়, আইনশৃঙ্খলাসহ সকল কিছুতে অসহযোগিতার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। এসবই এই ভাষণের অন্তর্নিহিত নির্যাস।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পর্কিত আরও আরও ডিসকোর্স প্রয়োজন। এজন্য বৈশ্বিকভাবে দূতাবাসগুলোতে ‘বঙ্গবন্ধু স্টাডি সেন্টার’ চালু করা প্রয়োজন। এতে করে বিশ্বমঞ্চে বাংলাভাষা, বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দর্শনকে ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ যে কতটা গভীর অথচ স্পষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামের দিক নির্দেশনা সম্পন্ন ছিল সেটাকে আরও আরও অনুবাদ এবং মাধ্যমের সন্ধান করে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন। এটাই হোক নিবেদন।

লেখক: প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ

[email protected]

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ