
ঢাকা থেকে যে সহস্র মাইলের যাত্রা। এই যাত্রা নতুন নয়। ঋতু বদল হলেই, তাকে দেখতে পথে নামি। প্রকৃতি যেমন দেখি, তেমনি দেখি পথের দু’পাশের মানুষকে। তাদের বাজার-হাটে যাওয়া, স্কুল-কলেজ থেকে ফেরা, আড্ডা, কৃষিকাজ করা, সবই দেখি। কেমন করে বদলে যাচ্ছে দুই পাশের মানুষের পোশাক। কথা বলার ভঙ্গি , আচরণ। দোকানের সাইনবোর্ড, গণপরিবহনে লেখা বাণী, স্লোগান। শুধু তো সফর নয়, কাজও করতে হয় পথে নেমে। মানুষের অফিসে যাই। ব্যক্তিগতভাবে যাদের জানি, তাদের অন্দরের রূপটা অজানা নয়। অনৈতিকতার মোড়কে জড়ানো মানুষগুলো, পবিত্রতার মুখোশে ঢেকে রেখেছে নিজেদের। এদের ব্যক্তিগত জীবন বিশৃঙ্খল। কিন্তু অন্যের আচরণ ও নৈতিকতার তারা অতন্দ্র প্রহরী। নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে বসেন। রাষ্ট্র ও ধর্মের ইজারা নিয়ে আরোপ করেন নিষেধাজ্ঞা। ইদানীং কোনও কোনও স্থানীয় প্রতিনিধিরা এই ভূমিকায় নাকি প্রকাশ্যে এসেছেন। তাদের এই প্রকাশ্য হওয়া দেখে বিস্মিত হই না। কারণ, তারা ভেতরে ভেতরে অনেক আগে থেকেই কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। পরিবার ও সমাজের ভেতরে থেকে এই কাজটি করা হয়েছে। আমরা তাদের পেতে রাখা ফাঁদ বুঝতে পারিনি। আমাদের সহজ, সরল বিশ্বাস, আনুগত্যকে তারা ব্যবহার করেছে। তাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল বাঙালি সংস্কৃতি। আমাদের আচার ও উৎসবকে বিভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি করে তারা থামিয়ে দিয়েছে। ছোট করেছে পরিসর। আমাদের সম্মিলিত উদযাপনকে তারা বিভক্ত করেছে। এখানে রাজনীতির দোষ একটিই। ষড়যন্ত্র বুঝতে না পেরে, ভোটের স্বার্থে সবাই তাদের বরণ করেছে। আবার ধর্মের কথা যদি বলি। ধর্মের মূল আদর্শ, আচরণের সঙ্গেও এরা নেই। ধর্মের সৌন্দর্যে উগ্রতার কোনও ঠাঁই নেই। আধিপত্য ও মৌলবাদ কোনও সুন্দর সইতে পারে না। তারা এই কাজটি করে সুন্দর রাজনীতিকে দমন করতে। আমরা জানি না, কবে এই সত্যটি বুঝতে পারবো।
ঢাকায় ফিরে এসে সহকর্মীদের সঙ্গে চায়ের আড্ডায় যোগ দেই। একজন সহকর্মী জানালেন, তিনি বাজারে গিয়েছিলেন। সাধারণ সালোয়ার কামিজ পরেই। বাজারে তাকে দেখে একজন ভর্ৎসনা করতে শুরু করেছিল। কেন বাজারে গেলেন? এই যে আমার সহকর্মীকে একজন বাজারে এভাবে অপদস্থ করলো, আশপাশের কেউ এসে সহকর্মীর পাশে দাঁড়ায়নি। সহকর্মী ভীত ও বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন। কাজ সেরে চলে আসেন। প্রশ্ন হলো, ওই ব্যক্তিকে প্রকাশ্য বাজারে এমন করে নৈতিকতা, আব্রু রক্ষার দায়িত্ব দিলো কে? খবর এলো এরমধ্যেই কারা যেন বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালের ওপর ওয়াজের পোস্টার সেঁটে গেছে। জানি না, প্রিয়জন ও সহকর্মী যাদের দ্বারা নিগৃহীত হয়েছিল তাদের সঙ্গে এদের আত্মীয়তা আছে কিনা। তবে এতটুকু বলতে পারি, বদলে গেছে অনেক কিছুই। যা আমাদের পরিচয়ের বাইরে। মুজিববর্ষ উদযাপিত হলো। বিজয় ও স্বাধীনতার ৫০ পেরিয়ে এসে যদি দেখি, সমাজের পরিচয়টাই বদলে গেছে, তাহলে সে হবে পরাজয়। আমরা বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহার না করে যদি সমগ্রের স্বার্থে চর্চা করতাম, তাহলে হয়তো আমরা এভাবে বদলে যেতাম না। তারপরও কেন যেন ভরসা জাগে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ম্যাচে মেহেদী হাসান মিরাজ যেমন করে বলেছেন তামিম ইকবালকে, ‘আমাকে বল দেন, আমি ম্যাচটা ঘুরিয়ে দেই’। তেমন কোনও তরুণ দল নিশ্চয়ই নিজের পরিচয়ে আবার আমাদের ফিরিয়ে নেবেন।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী