X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি’

নিরুপমা রহমান
২৬ মার্চ ২০২২, ১১:৪৮আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২২, ২১:৫৫

নিরুপমা রহমান চোখ বন্ধ করে মায়ের মুখটা যখন ভাবি, তখন আরও কতশত ভাবনা, স্মৃতি, চিন্তা মানসপটে ভেসে ওঠে। আশ্চর্যজনকভাবে, মায়ের মুখখানি তখন কেবলমাত্র মায়ের মুখ আর থাকে না, হয়ে ওঠে আমার ফেলে আসা দিন, আমার বড় হয়ে ওঠা, বাবা-মা-ভাই-বোন-বন্ধুবান্ধব-আত্মীয় পরিজন দিয়ে ঘিরে থাকা আমার জীবনের গল্পের চিত্রপট। আমার মননে আর মানসে চিরচলমান এই চিত্রপটের সমস্তটায় আমি অনুভব করি আমার ফেলে আসা জন্মভূমিকে। তাই আমার এই যাপিত জীবনের গল্পের ভেতরকার গল্পে কখন যে আমার জন্মদাত্রী মা আর আমার ফেলে আসা জন্মভূমির মুখটা একাকার হয়ে গেছে, নিজেই হয়তো টের পাইনি। যতবার ‘আঁখি মেলে তোমার আলো প্রথম আমার চোখ জুড়ালো’ লাইনখানি গাই, ততবার বাংলা নামের দেশখানি আর সেই দেশে থাকা আমার মায়ের মুখখানি একাত্ম, একার্থ হয়ে যায় আমার মনে, আমার মানসে। এই পরিণত বয়সে এসে যখন ফিরে তাকাই, তখন দেখি আমার  ভাবনায়, চিন্তায়, চেতনে যে বাংলাদেশ, যে বাঙালিয়ানা, যে দেশপ্রেম, যে স্বদেশবোধ তার উৎসমুখে দাঁড়িয়ে আছেন আমার জন্মদাতা মা-বাবা। বড় হতে হতে ধীরে ধীরে যেমন তাঁদের আরও বেশি করে ভালোবাসতে শিখেছি, তাঁদের জানতে চেয়েছি, বুঝতে চেষ্টা করেছি; ঠিক তেমনি তাঁদের মানস আর মননের উদ্দীপনাতেই আমার জন্মভূমি বাংলাদেশকে, বাঙালিকে, বাংলা ভাষাকে, আমাদের বাঙালিয়ানার বোধকে, আমাদের ইতিহাস– সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে দেখবার, চেনবার, জানবার প্রয়াসে সামিল হতে শিখেছি।

তাই আজ অভিবাসী জীবনের ‘কুড়ি কুড়ি বছর পার’ করেও যখন বুঝি আমার ‘আমি’টা বড্ড বেশি বাঙালি, আমার বাংলা ভাষা, আমার বাংলা গান-সাহিত্য, আমার আটপৌরে বাঙালি জীবনের যাপিত অভ্যাস-অভ্যস্ততা আমার ‘আমি’টাকে এক তিলও ছেড়ে যায়নি, তখন মোটেও অবাক হই না। মা কী ছেড়ে যান কখনও, না কী যেতে পারেন, অথবা আমরাই কী তাঁকে যেতে দেই কখনও? এমনি করেই আমার জন্মদাত্রী মায়ের মুখাবয়বে আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের সমাপতন ঘটে আমার চিন্তায়, আমার চেতনায়। তাই আমার সাধারণ ছাপোষা এই জীবনে আমার দেশ মায়ের ভালো থাকবার সঙ্গে আমার মায়ের ভালো থাকা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকে, আমার মায়ের কল্যাণ কামনার প্রার্থনাতে বাংলাদেশের কল্যাণ কামনা জুড়ে যায় আপনাআপনি, আমার স্বদেশভাবনা তাই ভূখণ্ড বাংলাদেশকে ছাপিয়ে আমার মা, আমার প্রিয়জনদের ঘিরে ভাবনার প্রতিফলন ঘটায়। রবিঠাকুরের কথাগুলি বড় যথার্থ বলে বোধ হয় আমার চিন্তায়, আমার চেতনে ‘দেশ মানুষের সৃষ্টি । দেশ মৃন্ময় নয়, সে চিন্ময় । মানুষ যদি প্রকাশমান হয় তবেই দেশ প্রকাশিত । … দেশ মাটিতে তৈরি নয়, দেশ মানুষে তৈরি।‘

সত্যিই তো দেশ তো শুধু ভৌগোলিক সীমারেখায় ঘেরা কোনও এক ভূখণ্ড নয়, আমার কাছে দেশ মানে তাই এক দল মানুষ যারা উৎসবে আনন্দে একাত্ম হয়; ঝড়ে-বন্যায়-রোগে-শোকে এক অপরকে ঘিরে রাখে; একসঙ্গে রুখে দাঁড়ায় শোষণে – উৎপীড়নে; সাম্যে – ঐক্যে একসঙ্গে গেয়ে ওঠে বিজয়ের গান। তাই পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের এক ব-দ্বীপের ভূখণ্ড বাংলাদেশ যদি হয় এক হৃদপিঞ্জর, তবে আমরা বাঙালিরা সে পিঞ্জরে লুকিয়ে রাখা হৃদয়, সেই হৃদয়ের স্পন্দন। আজ স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে এসে তাকালে দেখা যাবে বাংলাদেশের মানুষ সেই পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে গেছে বিশ্বময়। আর বিশ্বের যে কোণেই সে তার নতুন আবাস গড়েছে, সেখানেই আজ এক এক টুকরো বাংলাদেশের দেখা মিলবে। কারণ ওই একটাই বাংলাদেশ তো মৃন্ময়ী নয়, সে চিন্ময়ী আর সেই চিত্তের স্পন্দন তোলে চিন্ময়ী মায়ের সন্তানেরা, আমরা বাঙালিরা। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এসে ১৯২৯ সালে এক অভিভাষণে রবিঠাকুরের বলা কথাগুলো আমার কাছে আজও বড় প্রাসঙ্গিক আর তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়, যেখানে বাংলার শুধু ভৌগোলিক অধিকার সেখানে সে মানচিত্রের সীমাপরিধিকে ছাড়াতে পারে না । সেখানে তার দেশ বিধাতার সৃষ্ট দেশ ; সম্পূর্ণ তার স্বদেশ নয়। কিন্তু, ভাষা-বসুন্ধরাকে আশ্রয় ক’রে যে মানসদেশে তার চিত্ত বিরাজ করে সেই দেশ তার ভূ-সীমানার দ্বারা বাধাগ্ৰস্ত নয়, সেই দেশ তার স্বজাতির সৃষ্ট দেশ । আজ বাঙালি সেই দেশটিকে নদী প্ৰান্তর পর্বত অতিক্রম করে সুদূরপ্রসারিতরূপে দেখতে পাচ্ছে, তাই বাংলার সীমার মধ্য থেকে বাংলার সীমার বাহির পর্যন্ত তার আনন্দ বিস্তীর্ণ হচ্ছে । খণ্ড দেশকালের বাহিরে সে আপন চিত্তের অধিকারকে উপলব্ধি করছে । 

এই যে আমি বা আমার মতো অসংখ্য বাঙালি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে পরবাসী কিংবা অভিবাসী জীবনে বছরের পর বছর হৃদয়ের মণিকোঠায় এক টুকরো বাংলাদেশকে ধারণ করে, লালন করে বেঁচে থাকে তার রসদ কিন্তু আসে দেশ মায়ের সেই চিন্ময়ী রূপ থেকেই। আর সেই চিন্ময়ী রূপ আঁকা হয় আমাদের বাঙালিয়ানার বোধ থেকে। আমাদের চিত্তে, আমাদের মননে ভাবনার যে অবয়ব আছে আর আমাদের যাপিত জীবনে আচারে-উপাচারে-অভ্যাসে সামষ্টিক আচরণের যে আদল তৈরি হয় তা প্রকাশমান হয় আমাদের ভাষাতে, আমাদের সংস্কৃতিতে। তাই আমি মনে করে দেশ, কাল, পাত্র ছাপিয়ে বাংলা ভাষা, বাংলার চিরায়ত ও চিরচলমান সংস্কৃতি আর বাংলা নামের দেশটির সঙ্গে নিজেকে সচেতনভাবে যুক্ত করবার ও রাখবার নিরন্তর প্রয়াসের নামই বাঙালিয়ানা।

যেহেতু এই প্রয়াস আমাদের একেকজনের একেকরকম, তাই বাঙালিয়ানার সামষ্টিক ভাবনার মাঝেও আছে বহুত্ব। আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, ধর্মীয়, পেশাগত পরিচয়ের বহুত্ব ছাপিয়ে, দেশ-কালের ব্যবধান ঘুচিয়ে কেবলমাত্র বাংলা ভাষার টানে  বা বাংলাদেশে জন্মেছি বলে আমরা আমাদের নিজেদের বাঙালি, বাংলাদেশি বলে দাবি করতে ভালোবাসি, পরিচয় দিতে গর্বিত হই। আবার ঘুরে ফিরে সেই রবিঠাকুরের কথাতেই ফিরি ‘বাঙালি বাংলাদেশে জন্মেছে বলেই যে বাঙালি তা নয়; বাংলা ভাষার ভিতর দিয়ে মানুষের চিত্তলোকে যাতায়াতের বিশেষ অধিকার পেয়েছে বলেই সে বাঙালি।’

বাঙালির সমষ্টিগত এই পরিচয়ে মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই বহুত্বের অভিধা নিহিত থাকে। খুব সহজাতভাবেই সেই বহুধাবিভক্ত পরিচয়গুলো বৃহত্তর পরিচয়ের অন্তর্গত হয়ে সমষ্টিগত বৃহত্তর পরিচয়টিকে গভীরতর ব্যঞ্জনা দেয়, প্রগাঢ়তর বোধে পরিণত করে। এমনতর বোধই বাঙালির বাঙালিয়ানা, বাঙালির আত্মপরিচয়। আর তাই মনে রাখা খুব জরুরি বাঙালির এই আত্মপরিচয়ের বোধ, বাঙালির বাঙালিয়ানা প্রকৃতপক্ষে গভীরতর এক ঐক্য ভাবনায় বহুত্বের সম্মিলন।  

‘বঙ্গভূমিকা’ গ্রন্থের সূচনায় বিদগ্ধ ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্য বিশারদ সুকুমার সেন অতি স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘ভাষা নিয়ে জাতি, জাতি নিয়ে দেশ। বাংলা ভাষার উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি জাতির ইতিহাস শুরু।’ সেই ইতিহাসে বাংলা ভাষা বরাবর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।  শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে, নানান শাসকের শাসন – শোষণের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে উনিশ শতকের গোড়া থেকে বাঙালির জাতীয়তাবোধের যে জোরালো প্রকাশ তথা জাগরণ ঘটলো তাই-ই ধীরে ধীরে বাঙালির বাঙালিয়ানার বোধকে পরিণত করেছে আর তারই এক সফল পরিণতি একাত্তরে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয় আসলে বাঙালির ব্যক্তিগত বহুত্ব বা বহুধাবিভক্তিকে ছাপিয়ে সামষ্টিক চেতনার জাগরণের এক সফল প্রয়াস, বাঙালির ঐক্যের বিজয়গাথা। আমি বিশ্বাস করি, রবিঠাকুর তাঁর ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’ প্রবন্ধে ‘চিন্তার ঐক্য, ভাবের ঐক্য, ভাষার ঐক্য, সাহিত্যের ঐক্য’ সাধনের মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার যে সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন, একাত্তরে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সেটাই বাস্তবে রূপ নেয়, জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের।    

রবিঠাকুরের কল্পনাতে যে বাংলা নামের সোনার দেশ ছিল, সেই কল্পনাকে মূর্তময় বাস্তবতায় পরিণতি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।  ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যে গান রবিঠাকুর লিখেছিলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন দেশের জন্মযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেই গানকে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, বাঙালি জাতির প্রাণের গান হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেন। এ গানের প্রতি ছত্রে ছত্রে বাঙালির অনুভব, বাঙালির আবেগ-অনুভূতি ছড়িয়ে আছে। প্রাণ থেকে নিঃসরিত হওয়া এ গানের প্রতিটি কথায় বাংলা মায়ের প্রতি বাঙালি সন্তানের ভালোবাসা, দরদ, আদর মিশে থাকে। তাই তো যতবার এই গান গাই আমার মনের মুকুরে ভেসে ওঠা আমার মায়ের মুখচ্ছবিতে আমার বাংলাদেশের মুখ ভেসে ওঠে। আর ততবার আবার নতুন করে বোধ করি আমার ভাবনার বাংলাদেশে রবিঠাকুরের স্বপ্ন-কল্পনা আর বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস-চেতনা একাকার হয়ে গেছে। তাই আমার মানসচক্ষে বাংলাদেশকে আমি খুঁজে পাই রবিঠাকুরের চোখে, বঙ্গবন্ধুর তর্জনীতে।   

পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে জন্মেছিলাম। তাই একদিকে যেমন স্বাধীন দেশে লাল সবুজ পতাকার অধিকার নিয়ে জন্মেছিলাম, অন্যদিকে স্বাধীনতার ইতিহাসকে মিথ্যা আর কদর্যতার গ্লানিতে ঢেকে ফেলবার সময়ে বড় হতে হয়েছে। পাঠ্যবইতে কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় কিংবা বেতারের ইথারে আর যাই থাক, ছিল না মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসের চর্চা, ছিল না বাঙালির চিরায়ত দর্শন আর মূল্যবোধের অনুশীলন। বহুমাত্রিকতার বিভাজন নয় বরং তার মেলবন্ধনে যে প্রগাঢ় সামষ্টিক চিন্তা চেতনা বোধের ঐক্যের ফলে বাংলাদেশের জন্ম, সেই ঐক্যকে ভেঙে গুঁড়িয়ে চাপিয়ে দেওয়া বিভেদের অদৃশ্য দেয়াল তোলবার সময়ে কেটেছে আমার শৈশব, কৈশোর।

সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশের কথা খুব পড়েছি বইয়ের পাতায় কিংবা কণ্ঠ মিলিয়েছি দেশাত্মবোধক গানে কিন্তু সেসময়কার শিশু-কিশোরদের পাঠক্রমে কিংবা তাদের ধরাছোঁয়ার ভেতরকার জ্ঞানজাগতিক পরিমণ্ডলে বাঙালি মানসকে জানবার বা জানাবার অভিপ্রায় বা প্রয়াস কোনোটাই ছিল না। এখন ফিরে তাকালে মনে হয়, তখনকার দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, শাসকের আর প্রশাসনযন্ত্রের সুবিধার্থে দেশকে চেনানো হয়েছিলো আমাদের মানচিত্রের সীমারেখায়, তার ভৌগোলিক অস্তিত্বে। তা ছাপিয়ে দেশের যে মানবিক রূপ আছে, তা হয়তো ইচ্ছে করেই আমাদের মননে বা মানসে আনবার চেষ্টাই করা হয়নি।  

সেই অন্ধকার সময়ে আমাদের বড় করতে গিয়ে আমার বাবা-মা আমাদের হাতে দেশকে বোঝবার, জানবার, দেখবার যে দুটি প্রাথমিক উপাচার-উপকরণ তুলে দিয়েছিলেন, তা ছিল রবিঠাকুর আর বঙ্গবন্ধু। এই দু’জনকে জানতে গিয়ে দেশকে, দেশের মানুষকে জানতে চেয়েছি নাকি বাঙালিকে আর বাঙালির বাংলাদেশকে বুঝতে গিয়ে রবিঠাকুর  আর  বঙ্গবন্ধুকে বোঝবার আজন্ম প্রয়াসে নেমেছি তা বলা ভারী মুশকিল। আর সেই রবিঠাকুরকে পড়তে গিয়েই কিশোরবেলাতেই জানলাম

‘মানুষ যদি প্রকাশমান হয় তবেই দেশ প্রকাশিত। … প্রশ্ন উঠবে প্রাকৃতিক দান তো উপাদান মাত্র, তা নিয়ে মানবিক সম্পদ কতটা গড়ে তোলা হল । মানুষের হাতে দেশের জল যদি যায় শুকিয়ে, ফল যদি যায় মরে, মলয়জ যদি বিষিয়ে ওঠে মারীবীজে, শস্যের জমি যদি হয় বন্ধ্যা, তবে কাব্যকথায় দেশের লজ্জা চাপা পড়বে না।‘

সেই যে বাবা-মায়ের একান্ত চেষ্টাতে আমাদের শৈশব -কৈশোরের প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও বাংলার মাটি – মানুষকে ঘিরে রবিঠাকুর আর বঙ্গবন্ধুর চিন্তা, দর্শন, চেতনা আর  স্বপ্নকে  পড়বার ও জানবার সুযোগ পেয়েছি, হয়তো সে কারণেই আজ পরিণত বয়সে এসে আমার কাছে বাংলাদেশ তার মৃন্ময়ী রূপ ছাপিয়ে চিন্ময়ী হয়ে ওঠে। ‘আমার মুক্তির আলোয় আলোয়’ আমি আমার বাঙালিয়ানাকে ছুঁতে চাই।  

‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এ নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে’

যতবার পড়ি, ততবারই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর লেখা এই অংশটায় আমি আমার ভাবনাগুলিকে খুঁজে পাই। ব্যক্তিগত, সামাজিক, ধর্মীয় কিংবা পেশাগত বহুত্বের মাঝেও আমি সমষ্টিগত বৃহত্তর ঐক্যে আমার আত্মপরিচয়ের ঠিকানা খুঁজে পাই। আর তাই বোধ করি আমার মায়ের মুখে আমি আমার বাংলাদেশের অবয়ব দেখতে পাই।

একটা বিষয় মনে রাখা জরুরি যে পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে জন্ম হওয়া, বড় হওয়া শিশু- কিশোরেরাই কিন্তু আজ নিজের পরিবারের, সমাজের বা সরকারি – বেসরকারি নানান প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী স্বৈরশাসকেরা হয়তো আর ক্ষমতায় নেই কিন্তু তাদের প্রশাসনের পরিকল্পিত শিক্ষা পাঠক্রমের ফসল রয়ে গেছে সমাজের প্রতিটি স্তরে। কয়েক প্রজন্ম ধরে চলতে থাকা শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলাদেশ মানে কাব্যকথার সুজলা সুফলা ভৌগোলিক বাংলাদেশ, আর সেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বয়ান সম্ভব হয়েছে এক ছত্রে ‘হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে জনগণ জেগে উঠলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হলো’। এমন এক ছত্রে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ, আর তার আগের চব্বিশ  বছরের শাসন – শোষণকে এড়িয়ে যাবার যে প্রয়াস ছিল তা কয়েক প্রজন্ম ধরে আমাদের নিজেদের চিনতে, জানতে দেয়নি; বাঙালি বলে নিজেদের গর্বিত হতে শেখায়নি।

ইতিহাস বিকৃতি আর ধামাচাপা দেবার এমন পরিকল্পিত প্রয়াস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বুঝতেই দিতে চায়নি নয় মাসের এই মুক্তিযুদ্ধ কত আত্মত্যাগ, কত রক্ত, কত ত্যাগ আর কত কান্নার ফসল। অধ্যাপক মমতাজ উদ্দীন আহমদের বর্ণনায় ‘স্বাধীনতা মামার বাড়ির আবদার নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধ কোনও অর্বাচিন যুবকের হঠকারিতা নয়।’ চার অক্ষরের শব্দ ‘স্বাধীনতা’র মাঝে যে প্রগাঢ় ব্যাপ্তি আছে, গভীর দ্যোতনা আছে তা আমাদের বোঝবার সুযোগই দেয়নি বরং হয়তো আজন্ম স্বাধীনতার নামে আমরা স্বেচ্ছাচারী হতেই দেখেছি, শিখেছি। আমরা আমাদের সামষ্টিক আত্মপরিচয় জানবার বা শেখবার সুযোগই হয়তো পাইনি। আমরা  ঐক্যের অনুশীলন না দেখে জন্মাবধি তো কেবল বিভেদ আর বিভাজনের কুটিল রাজনীতি আর সমাজনীতির উদযাপনই যে দেখেছি আর তাতেই সামিল হতে শিখেছি সহজাত ভাবেই।   

রবিঠাকুর যেই ঐক্যের কথা বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যেই ঐক্য বাঙালি গড়ে তুলেছিল সব বিভেদ ভুলে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে সেই ঐক্য কি আমরা ধরে রাখতে পেরেছি? পারবোই বা কী করে?

পঁচাত্তর পরবর্তী প্রজন্মের আমরা তো তেমন ঐক্য গড়তে দেখিওনি, শিখিওনি। সেই ঐক্যের চেতনাতেই যে স্বাধীন দেশে আমরা জন্মেছি, তাই বা স্পষ্ট করে কে কবে আমাদের বলেছেন আমাদের শৈশবে বা কৈশোরে? তাই বারবার করেই হয়তো আজ বলবার সময় এসেছে, মনে করাবার প্রয়োজন আছে যে বাঙালিয়ানা বা বাঙালির বাঙালিত্বের বোধ কিন্তু একদেশদর্শী নয়, বরং বহুত্বের সম্মিলনে আর উদযাপনে বৃহত্তর সমষ্টিগত এক গভীর চেতনাবোধ। কিন্তু সেই বৃহত্তর সামষ্টিকতার বোধকে উপেক্ষা করে আমরা হয়তো আমাদের ব্যক্তিগত বহুত্বকে প্রাধান্য দিচ্ছি, আর তাতে আমাদের জাতিগত আত্মপরিচয়ে বিভেদ আসছে, ক্রমাগত তৈরি হচ্ছে আত্মপরিচয়ের সংকট।

‘আমরা হিন্দু মুসলমান, ধনীদরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, স্ত্রীলোক ও পুরুষ সকলেই বাঙালি বলিয়া যে এক বাংলার বেদনা অনুভব করিতে পারিয়াছি – আঘাতের কারণ দূর হইলেই … সেই ঐক্যের চেতনা যদি দূর হইয়া যায় তবে আমাদের মতো দুর্ভাগা আর কেহ নাই।’ যদিও একাত্তরের বেশ কয়েক দশক আগেই বলা, তবুও রবিঠাকুরের এই কথাগুলি একাত্তরের প্রেক্ষিতে যেমন প্রাসঙ্গিক ছিল,  আজ একাত্তরের পর আরও পঞ্চাশ বছর পেরিয়েও তেমনি প্রাসঙ্গিক আর তাৎপর্যপূর্ণ।

বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের ইতিহাসের ভিত্তিমূলে তথা বাঙালির নিজস্ব মানচিত্রের চিন্ময়ীরূপের মর্মমূলে আছে আমাদের বাঙালি জাতিসত্তা। আমাদের ঐক্যের চেতনাকে ভুলে গেলে, বা ভুলিয়ে দেবার প্রয়াসে আমাদের বাঙালি সত্তাকে উপেক্ষা করা হয়, অস্বীকার করা হয়। ওই যে শুরুতেই বলছিলাম বাংলাদেশের ভৌগোলিক মানচিত্র যদি হয় এক হৃদপিঞ্জর, তবে আমাদের বাঙালি জাতিসত্তা সেই হৃদয়ের স্পন্দন রচনা করে। মানবদেহের নানান ধমনী, শিরা-উপশিরার মতো আমরা প্রতিজন বাঙালি নিজের মতো করে বয়ে চলবো ঠিকই কিন্তু সেই বহুত্বে থাকতে নেই কোনও বিভক্তি বরং থাকবে সমন্বয়। আর তবেই না বাংলাদেশের হৃদস্পন্দন থাকবে চিরচলমান, চির অক্ষয় হবে বাংলাদেশের চিন্ময়ীরূপ।

‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটা কোনও আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা-প্রকৃতি আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে তা ঢাকবার জো টি নেই।’

তাই স্বাধীনতার অর্ধশতক পূর্তির এই সময়ে দাঁড়িয়ে খুব গভীরভাবে বাঙালির জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এই আমোঘবাণীকে আমাদের চিন্তায়, আমাদের মননে, মানসে যদি না ধারণ করি তবে আমাদের আত্মপরিচয়ের সংকট কালে কালে আরও গভীরতর হবে, কালক্রমে আমরাই আমাদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াবো। সেই কোন ১৯৩৩ সালে রবিঠাকুর লিখেছিলেন ‘মানুষকে মানুষ বলে দেখতে না পারার মতো সর্বনেশে অন্ধতা আর নেই। এই বন্ধন এই অন্ধতা নিয়ে কোনো মুক্তিই আমরা পাব না’। বাঙালিকে আবার করে ভাবতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে যে আমাদের বাঙালিয়ানা , আমাদের বাঙালিত্ব যা কী না বহুত্বের সম্মিলনে গভীরতর সামষ্টিক এক ঐক্যের বোধ, তাতেই  লুকিয়ে আছে আমাদের মুক্তির মন্ত্র।

জন্মদাত্রী মাকে কে না ভালোবাসে। নিজের জন্মভূমিকেও আমরা যে যার মতো করেই ভালোবাসি, সে বিষয়ে আমার কোনই সন্দেহ নেই। আমাদের সকলের ক্ষেত্রেই ‘চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি’। কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এসে আজ হয়তো দেশপ্রেমের সংজ্ঞাকে একটু অন্যভাবে, গভীরতরভাবে ভাববার সময় এসেছে। আমাদের মননে – মানসে এই চিন্তা – চেতনা আনতেই হবে যে ভৌগোলিক মানচিত্রের সীমারেখা ছাপিয়ে আমাদের দেশ আসলে আমাদের মতো একেকজন সপ্রাণ মানুষদের দিয়ে গড়া দেশ,  এর প্রতিটি মানুষ আমাদেরই কারো না কারো আপনজন। বহু শতক ধরে বাঙালির হৃদয়ের গভীরে লালিত স্বপ্নের রাষ্ট্রচিন্তারই সামষ্টিক রূপ, সফল পরিণতি আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। আমাদের মনে রাখতেই হবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একাত্তরে আমাদের অনৈক্য ও বহুত্বের সংশয়কে দূরীভূত করে, সমষ্টিগত আবগের অভূতপূর্ব ঐক্যসূত্র গাঁথা হয়েছিলো বলেই না বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছিলো। তাই বহুত্বের বিভেদ ভুলে গিয়ে বরং বহুত্বের সম্মিলনে ঐক্যের ঐকতান রচনার মাধ্যমেই আমার কল্পনাতে, আমার ভাবনাতে হয় আমার বাংলামায়ের সুবর্ণজয়ন্তীর উদযাপন।

নিজে মা হিসেবে জানি, নিজের মাকে দেখে জানি প্রতিটি সন্তানের জন্য মায়ের সমান ভাবনা, সমান ভালোবাসা। সন্তানদের মাঝে অনৈক্য – অসম্মানের তিলমাত্র প্রকাশেও যেমন মা অনাদৃত হন, অপমানিত হন, দুঃখিত হন, তেমনি স্বদেশের মাটিতেই কেউ যখন অত্যাচারিত হন, অসম্মানিত হন, অবহেলিত হন তারই স্বদেশবাসী কর্তৃক, সেই দুঃসহ অপমানে, অনাদরে দেশ মায়ের মুখে উৎকণ্ঠা জমে, তাঁর পিঞ্জরে রাখা হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। ঠিক এখানেই আবার আমার কাছে বাংলাদেশ তার মৃন্ময়ী রূপ ছাপিয়ে চিন্ময়ী হয়ে ওঠে।

পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া এই আমি বোধ হওয়া ইস্তক দেশমায়ের এমন মলিন, যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ আমি বহুবার দেখেছি, আমার জন্মদাত্রী মায়ের মুখেও সেই মুখের প্রতিফলন দেখেছি বারম্বার।  আজ  পরিণত বয়সে এসে দেশ মায়ের সেই মুখ আমি যখন দেখতে পাই, তখন সইতে বড় কষ্ট হয়। অসহ্য মনোযন্ত্রণায় মাকে কেবল অসহায়ের মতো বলে যাই ‘মা, তোর   বদনখানি মলিন হলে,   ও মা,   আমি নয়নজলে ভাসি ।।    

লেখক: শিক্ষক, কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া; শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
১৯ বছর পর হত্যা মামলায় স্বামী-স্ত্রীসহ ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
১৯ বছর পর হত্যা মামলায় স্বামী-স্ত্রীসহ ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের: মঈন খান
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের: মঈন খান
মোমবাতি জ্বালিয়ে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা, ‘বিদ্যুৎবিভ্রাট’ বলছে কর্তৃপক্ষ
মোমবাতি জ্বালিয়ে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা, ‘বিদ্যুৎবিভ্রাট’ বলছে কর্তৃপক্ষ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ