X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

অসাম্প্রদায়িকতা কি আজ তবে প্রশ্নবিদ্ধ?

লীনা পারভীন
০৬ এপ্রিল ২০২২, ১৯:৩৭আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২২, ১৯:৩৭

লীনা পারভীন জন্ম থেকেই দ্বিধা বিভক্ত এক জাতি আমরা। ১৯৭১ সালেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত ছিল। সেই বিভক্তি রেখা মুছে দিতে পারেনি কেউ। সেই রেখার এপারে আছে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা মানুষেরা আর অপর পারে আছে অন্ধকার যুগের বংশধরেরা, যারা প্রগতিকে আটকাতে চায়, আলোর রেখাকে মুছে দিতে চায়।

প্রশ্ন হচ্ছে বর্তমান বাংলাদেশে কোন পাড়ের মানুষের সংখ্যা বাড়তি? এই প্রশ্নের উত্তর সাদা চোখে দিতে গেলে কিন্তু বোবা হয়ে যেতে হবে। কেন? কারণ হচ্ছে দিনে দিনে মৌলবাদী গোষ্ঠী এমন সব কর্মকাণ্ডের অবতারণা করছে, যার কাছে বারবার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জোয়ার চলছে এবং এটা আক্ষরিক অর্থেই প্রমাণিত সত্য। বিদ্যুতের আলো প্রতিটি গ্রামে পৌঁছে গেছে। বলা হচ্ছে ১০০ ভাগ বিদ্যুতায়নে সফল এই সরকার। নিঃসন্দেহে এটা বিশাল অর্জন। আধুনিককালে এগিয়ে যাওয়ার পথে বিদ্যুতের অবদান অনস্বীকার্য। দেশ আলোকিত হচ্ছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো জ্বলছে। এই দৃশ্য দেখতে সত্যি চমৎকার লাগে।

কিন্তু ঘরের এই বিদ্যুৎ কি আমাদের ঘরে থাকা মানুষগুলোর মনের আলো জ্বালাতে পারছে? সময় এসেছে এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে সমাধানের পথে কৌশল নির্ধারণ করা। মানুষের মন ও মগজে যে অন্ধকারের বসবাস সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারছি কি আমরা? রাজনৈতিকভাবে বিশ্লেষণ করলে আমাদের হতাশা ঘিরে ধরে। একটা সময়ে আমাদের দৃশ্যমান শত্রু ছিল জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি। তারা প্রকাশ্যে ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। গণপ্রজাতন্ত্রী চায়নি, চেয়েছিল ইসলামি প্রজাতন্ত্র। সফল হয়নি। এই অসফলতার ঝাল তারা তুলেছিল আমাদের জাতির পিতাকে হত্যা করে। থেমে গিয়েছিল কি? না। প্রচণ্ডভাবেই ফিরে এসেছিল। ক্ষমতার ভাগিদারও ছিল তারা। আমরা ভুলে গেছি যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মুজাহিদ ও নিজামীর মতো চিহ্নিত দুই জন যুদ্ধাপরাধী কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি দায়িত্বে ছিল অনেক বছর। সেই সাথে তারা সংস্কৃতি বিষয়ক বিভিন্ন কমিটিতেও দায়িত্ব পেয়েছিল। বিএনপি ক্ষমতায় ছিল তিনবার। বিএনপি’র রাজনৈতিক আদর্শ এবং জামায়াতের আদর্শ সবসময়েই পরিপূরক। তাই আজকের বাংলাদেশকে বিশ্লেষণ করতে গেলে অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর থেকে ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা সকল সময়কালকে বিশ্লেষণে আনতে হবে এককভাবে। সেই যে একটা লম্বা সময় সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসীরা ক্ষমতায় ছিল, তারা প্রশাসন থেকে তৃণমূল প্রতিটি স্তরে গেঁথে দিয়ে গেছে নিজেদের মতবাদকে। এখন আমাদেরকে কথা বলতে হবে সেই লম্বা সময়ের রাজনীতিকে মোকাবিলার জন্য বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দলটি কতটা কী করলো সেটি নিয়েও। কারণ এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে একমাত্র আওয়ামী লীগই হচ্ছে সেই রাজনৈতিক দল যারা এখনও মুক্তিযুদ্ধের মূল মন্ত্রকে ধারণ করে এবং সেটির আলোকেই রাষ্ট্র চালানোয় বিশ্বাস করে। আর এই একটা কারণেই আমাদের সকল প্রত্যাশা এই দলটির কাছে।

অতীতকে যেমন আমাদের মনে রাখতে হবে ঠিক তেমনি টানা গত ১৩ বছরের ক্ষমতায় থাকা দলটি এই পরিষ্কারের কাজটি কতটা করতে পারলো সেই হিসাবও করতেই হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও শিক্ষা যদি বলি তাহলে আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে তিনি জানতেন যে দ্বিধাবিভক্ত এই জাতিকে যদি শিক্ষিত ও সঠিক আদর্শের পথে আনতে হয় তাহলে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কোনও বিকল্প নেই। তিনি চেয়েছিলেন একটি  অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ যেখানে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠী বা লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাই সমান সুযোগ পাবে এবং একজন নাগরিকও তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না। তিনি জানতেন রাষ্ট্র চলবে তার নিজস্ব নীতিতে আর নাগরিকের রক্ষাকবচই হচ্ছে রাষ্ট্রনীতি। সেই লক্ষ্যেই তিনি সংবিধানকে সাজিয়েছিলেন আদর্শকে সামনে রেখে। দেশে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে তিনি প্রাধান্য দিতেন। একদিকে ধর্মীয় রীতি আর অন্যদিকে বাঙালি সংস্কৃতি দুটি ধারার মাঝে রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি প্রাধান্য দিতেন বাঙালি সংস্কৃতিকে। কারণ, ধর্ম হচ্ছে ব্যক্তিগত বিশ্বাস, আচার ও পালনের বিষয় কিন্তু জাতি হিসেবে তিনি বিশ্বাস করতেন বাঙালিয়ানায়। অথচ আজ সেই বাঙালিয়ানাই প্রশ্নবিদ্ধ। একজন নারীকে কপালে টিপ পরা নিয়ে হেনস্তা হতে হয়। প্যান্ট শার্ট পরে চলার অপরাধে একজন ছাত্রীকে রাস্তাঘাটে অপমান করা হয় প্রকাশ্যে। কোথায় আইন, কোথায় আমাদের বাঙালির শিক্ষা? সব আজকে প্রশ্নবিদ্ধ।

দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন দরকার আছে। কিন্তু মানুষের মগজের উন্নতিকে অবহেলা করে কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন মানুষকে বিপথে ঠেলে দেয়। জাতিগত পরিচয়কে সংকটে ফেলে দিয়ে একটি রাষ্ট্র শান্তিতে থাকতে পারে না। প্রশাসন থেকে ব্যক্তি সকল পর্যায়ে আমাদের তরুণ সমাজ থেকে সিনিয়র সিটিজেন সবাই দিশেহারা। সামনে কোনও নির্দিষ্ট গাইডলাইন নেই, যা অনুসরণ করবে আগামীর প্রজন্ম। ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে সমাজের ঘাড়ে। যিনি ধর্ম পালন করবেন সেটি যেমন বাধা দেওয়া অপরাধ ঠিক তেমনি ধর্মের নামে আরেকজনের সাংস্কৃতিক চর্চাকে ধর্মীয় লেবাসে অপবাদ দেওয়াকেও অপরাধ হিসেবে নির্দিষ্ট করতে হবে শক্ত হাতে। রাষ্ট্রের কোনও ধর্ম হতে পারে না। রাষ্ট্র হবে সবার। সেই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নাগরিকেরা ভোট দিয়ে বসায় সরকারকে। আর তাই, সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিটা পরিষ্কার থাকাও জরুরি।

চারদিকে যেভাবে মৌলবাদী কর্মকাণ্ডের চাষাবাস হচ্ছে রাষ্ট্র যদি এখনি শক্ত হাতে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না নেয় তাহলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অস্তিত্ব দুর্বল হতে বেশি সময় লাগবে না। এটা হবে দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আত্মহত্যার শামিল।

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জনগণ এনডিএ জোটকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে: মোদি
জনগণ এনডিএ জোটকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে: মোদি
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ