X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা সেতুতে এত টোল কেন?

আমীন আল রশীদ
০১ মে ২০২২, ১৮:২৪আপডেট : ০১ মে ২০২২, ১৮:২৪

আমীন আল রশীদ বাংলাদেশের মানুষের গর্বের স্থাপনা পদ্মা সেতু, সন্দেহ নেই। বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে নিজস্ব অর্থায়নে, অর্থাৎ নিজ দেশের জনগণের পয়সায় এরকম একটি বিশাল অবকাঠামো গড়ে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। এর জন্য যে দূরদৃষ্টি এবং শক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সাহস দরকার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেটি ছিল বলেই পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত চরিত্রের নদী বলে খ্যাত পদ্মার বুকে এরকম একটি সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। দ্রুতই এটি যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা জানিয়েছে সরকার। কিন্তু এই সেতু পার হওয়ার জন্য যানবাহনের যে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি এতদিনকার ফেরি সার্ভিসের দেড়গুণ এবং যমুনা নদীর ওপরে নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর টোলের প্রায় দ্বিগুণ।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, সেতু বিভাগ পদ্মা সেতুর যে টোল নির্ধারণ করেছে সেটি কার্যকর হলে যাত্রীবাহী বড় বাসে ২ হাজার ৪০০ টাকা এবং মাঝারি ট্রাককে টোল দিতে হবে ২ হাজার ৮০০ টাকা। বর্তমানে পদ্মা নদী পার হতে ফেরিতে যানবাহন ভেদে ভাড়া দিতে হয় ৭০ থেকে ৩ হাজার ৯৪০ টাকা। কিন্তু পদ্মা সেতুতে যানবাহন ভেদে টোল দিতে হবে ১০০ থেকে ৬ হাজার টাকার বেশি। এরমধ্যে কার ও জিপের টোল ৭৫০ টাকা, যা ফেরিতে ৫০০ টাকা; বড় বাসে ২ হাজার ৪০০ টাকা, যা ফেরিতে ১ হাজার ৫৮০ টাকা; মাঝারি ট্রাকে ২ হাজার ৮০০ টাকা, যা ফেরিতে ১ হাজার ৮৫০ টাকা। এছাড়া পদ্মা সেতু পার হতে বড় ট্রাক ৫ হাজার ৫০০, মাঝারি বাস ২ হাজার, ছোট বাস ১ হাজার ৪০০, পিকআপ ১ হাজার ২০০, মাইক্রোবাস ১ হাজার ৩০০ টাকা এবং মোটরসাইকেলকে ১০০ টাকা টোল দিতে হবে। সেতু বিভাগের প্রস্তাবিত এই টোল প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলেই প্রজ্ঞাপন জারি হবে। তবে টোলের জন্য যে হার নির্ধারণ করা হয়েছে, তা কমানোর সম্ভাবনা কম বলে মনে করে সেতু বিভাগ।

এই টোল ১৫ বছরের জন্য প্রযোজ্য হবে। প্রতি ১৫ বছর পরপর টোলের হার ১০ শতাংশ করে বাড়ানো হবে। প্রশ্ন হলো, একটি সেতু নির্মাণের পর সরকার কি সেটি থেকে অনাদিকাল টোল আদায় করতে থাকবে? পৃথিবীর অন্যান্য দেশের প্র্যাকটিস কী?

এত টাকা টোল নির্ধারণ করা হলো কেন? সরকার বলছে, সেতু নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কোরিয়া এক্সপ্রেস করপোরেশন (কেইসি) এবং চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) আগামী পাঁচ বছরের জন্য টোল আদায়, সেতু ও সেতুর দুই প্রান্তের যানবাহন চলাচল ব্যবস্থাপনায় আধুনিক পদ্ধতি চালু এবং সেতু ও নদী শাসনের কাজ রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এর জন্য পাঁচ বছরে তাদের দিতে হবে ৬৯৩ কোটি টাকা।

শুধু তাই নয়, পদ্মা সেতু ব্যবহার করতে হলে ঢাকার পোস্তগোলা বা বাবুবাজার থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত  যে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানেও টোল দিতে হবে। আগামী জুলাই থেকে এই এক্সপ্রেসওয়েতে টোল চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই সড়কের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সড়ক ও জনপথ অধিদফতর।

ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার। এই পথে প্রতিটি বাসে ৪৯৫ এবং ট্রাকে সাড়ে ৫০০ টাকা টোল দিতে হবে। তবে এই টোলহার আরও বাড়ানোর চিন্তা রয়েছে সওজের। তার মানে ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের যেকোনও জেলায় পদ্মা সেতু পার হয়ে যদি কেউ যাতায়াত করতে চান, তাহলে তার যে খরচ হবে, তা নদীপথের চেয়ে অনেক বেশি এবং বর্তমানে চালু থাকা ফেরি সার্ভিসের চেয়েও বেশি। যুক্তি দেখানো হতে পারে যে সময় তো বাঁচবে। প্রশ্ন হলো, সময় বাঁচবে বলে এক্সপ্রেসওয়ে এবং সেতুতে এমন অঙ্কের টোল কেন বসানো হবে, যা পরিশোধ করতে গিয়ে পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে এবং গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত বাহনেও খরচ অনেক বাড়বে?  

যাত্রীবাহী বাসের ভাড়া যদি লঞ্চের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে মানুষ কেন লঞ্চ ছেড়ে পদ্মা সেতুর সুবিধা নিয়ে সড়কপথে বরিশালসহ দক্ষিণের অন্যান্য জেলায় যাবে? একইভাবে পণ্যবাহী ট্রাককেও যেহেতু মোটা অঙ্কের টোল দিতে হবে, সেক্ষেত্রে পণ্যের দামও বেড়ে যাবে। অথচ পদ্মা সেতু হলে পণ্য আদান-প্রদান সহজ হওয়ার কথা। তার মানে একদিকে যাতায়াত সহজ হবে, অন্যদিকে খরচ বেড়ে যাবে? সেই বাড়তি খরচ তো সাধারণ মানুষকেই শোধ করতে হবে। পদ্মা সেতু এবং এক্সপ্রেসওয়ের কারণে তাদের তো আয় বাড়বে না। তাহলে প্রশ্ন হলো, এই বিশাল অবকাঠামো গড়ে তোলা হলো কাদের জন্য? তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, যে সেতু নির্মাণে কোনও বিদেশি ঋণ নেই, যে সেতু হয়েছে দেশের জনগণের পয়সায়, সেই সেতু পার হওয়ার জন্য কেন উচ্চ হারে টোল গুনতে হবে? সোশাল মিডিয়ায় অনেকেই পদ্মা সেতুতে এই উচ্চ হারের টোল আরোপকে নিজের টাকায় তৈরি ঘরে ভাড়া দিয়ে বসবাসের সঙ্গে তুলনা করছেন। মানুষের এই রসিকতার ভেতরে লুকিয়ে থাকা ক্ষোভ রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে।  

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৭ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সেতুতে রেলপথ সংযুক্ত করে। ২০১১ সালে এই ব্যয় বেড়ে হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি। ২০১৮ সালের জুনে ব্যয় আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। সড়ক ও রেলসহ পুরো সেতু উন্মুক্ত হতে হবে খরচ আরও বাড়বে কিনা—তা এখনই বলা মুশকিল।

সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, নকশা পরিবর্তন হয়ে দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ব্যয়ও বেড়েছে। এর পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন এলাকায় জমির মূল্য ক্রমাগত বাড়তেও থাকে। খরচ বেড়ে যাওয়ার পেছনে এই কারণগুলো হয়তো অযৌক্তিক নয়। কিন্তু এটিও বাস্তবতা যে বাংলাদেশে জনগণের অর্থায়নে সরকারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত অবকাঠামো নির্মাণের খরচ প্রতিবেশী ভারত তো বটেই, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের চেয়েও বেশি।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে এখন পর্যন্ত দুর্নীতি বা অনিয়মের কোনও অভিযোগ ওঠেনি। কিন্তু বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অতিরিক্ত খরচ এখন একটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। প্রায় সব প্রকল্পই নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন হয় না এবং প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়— যার বোঝা বইতে হয় দেশের মানুষকে।

এ অভিযোগও বহু পুরনো যে প্রকল্পের ঠিকাদার এবং এর সঙ্গে জড়িত বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের একশ্রেণির কর্মকর্তার যোগসাজশেই কাজগুলো বিলম্বিত করা হয়— যাতে খরচ বাড়িয়ে সেখান থেকে আরও বেশি ‘চুরি’ করা যায়। দুর্নীতি ও লুটপাটের জন্য অনেক সময় নকশায়ও পরিবর্তন আনা হয়। আবার বড় প্রকল্পকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে ব্যয় কম দেখানো হয়। অর্থাৎ সরকারি প্রকল্পগুলো থেকে বিরাট অংকের টাকা চুরির জন্য একটি বিরাট গোষ্ঠী তৈরি হয়ে গেছে—যারা নিজেদের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ। যিনি চুরি ধরবেন, তিনিও চুরির সঙ্গে যুক্ত থাকেন। সুতরাং, চোর কখনোই ধরা পড়ে না।

বলা হয়, উন্নয়নের অন্যতম প্রধান বাধা ঠিকাদাররা। তারা কোয়ালিশন করে কাজের রেট বাড়িয়ে দেন। তখন সরকারেরও কিছু করার থাকে না। আবার কাজ ৩০-৪০ ভাগ সম্পন্ন হওয়ার পরে বন্ধ করে দেন। তখন খরচ বাড়ে। এভাবে দুর্নীতির একটি বিশাল চক্র যে গড়ে উঠেছে, তা বিভিন্ন সময়ে বিশেষজ্ঞ তো বটেই, সরকারের মন্ত্রীদেরও কেউ কেউ এসব নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এই মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যায়নি।

সুতরাং, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে যদি চুরি, লুটপাট ও দুর্নীতি বন্ধ করা না যায় তাহলে এক টাকার কাজ করতে দশ টাকা লাগবে। তখন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটায় একটি পর্দার দাম ৩৭ লাখ টাকা, বালিশের দাম ৬ হাজার টাকা, মোবাইল চার্জারের দাম ২৩ হাজার টাকা, ২০ টাকার হ্যান্ড গ্লাভসের দাম ৩৫ হাজার টাকা, ১৫ টাকার টেস্ট টিউবের দাম ৫৬ হাজার টাকা, মাল্টিপ্লাগের দাম ৬ হাজার টাকা, ৫০০ টাকার রেক্সিনের দাম ৮৪ হাজার টাকা, রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানায় লোহা বা স্টিলের এক কেজি নাটের দাম ১ কোটি টাকা, আধা কেজি ওজনের একটি লোহার স্প্রিংয়ের দাম ১৬ লাখ টাকা ধরা হবে। এভাবে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের শ্রাদ্ধ হবে এবং বলা হবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে—এটি হচ্ছে মুদ্রার এক পিঠ। অন্য পিঠ হচ্ছে এই এগিয়ে যাওয়ার সুবিধা নিয়ে একটি গোষ্ঠী লালে লাল হচ্ছে। যেকোনো প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে সেটি বাড়তি বোঝা তৈরি করছে জনগণের ওপরে। উন্নয়ন ব্যয়ে দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ করা গেলে যেকোনও প্রকল্পের খরচ সহনীয় পর্যায়ে থাকতো এবং ওই প্রকল্পের খরচ উঠানো বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অতিমাত্রায় টোল আদায়ের প্রশ্ন উঠতো না।  

সর্বোপরি রাষ্ট্রের সব বিষয়ে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীই যেহেতু ভরসা এবং সবশেষ রাজধানীর কলাবাগান এলাকার একটি ছোট্ট খেলার মাঠ যেখানে থানার জন্য ভবন নির্মাণ করা হচ্ছিলো, সেই মাঠটিও রক্ষা পেয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে, অতএব তারই দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। একজন মানবিক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন না তার দেশের জনগণ পদ্মা সেতুর মতো একটি অহংকারের অবকাঠামোয় উঠতে গিয়ে কিংবা এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে গিয়ে নিজের পকেটের দিকে তাকাবেন আর প্রশ্ন করবেন, নিজেদের অর্থায়নের নির্মিত সেতুতে এত কেন টোল!

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘হোম অব ক্রিকেটে’ বাংলাদেশের স্পিন কোচ মুশতাক
‘হোম অব ক্রিকেটে’ বাংলাদেশের স্পিন কোচ মুশতাক
গরমে রাস্তায় পানি ছিটানোর সুপারিশ সংসদীয় কমিটির
গরমে রাস্তায় পানি ছিটানোর সুপারিশ সংসদীয় কমিটির
মাটি কাটার সময় বেরিয়ে এলো রাইফেল, গ্রেনেড ও মর্টারশেল
মাটি কাটার সময় বেরিয়ে এলো রাইফেল, গ্রেনেড ও মর্টারশেল
২৩ মিনিটে জামালকে তিন গোল দিয়ে সেমিফাইনালে পুলিশ
২৩ মিনিটে জামালকে তিন গোল দিয়ে সেমিফাইনালে পুলিশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ