X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পিটিয়ে মানুষ মারার আহ্বানে আমাদের কি আপত্তি আছে?

ডা. জাহেদ উর রহমান
১২ মে ২০২২, ১৮:০৯আপডেট : ১৩ মে ২০২২, ১৭:৫৮
তাসলিমা বেগম রেনুর কথা মনে আছে আমাদের? কয়েক বছর আগে উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছেলেধরা সন্দেহে একদল লোক স্রেফ পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল তাকে। বিষণ্নতাসহ আরও কিছু মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত তাসলিমাকে যখন মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলছিল, তখন মৃত্যুর আগে তিনি বারবার বলছিলেন– ‘আমি ছেলেধরা না’।

যারা সেই সময় খবরটি পড়েছিলাম, একদফা মার খাওয়া রেনুর রক্তাক্ত মর্মান্তিক মুখটি দেখেছিলাম, তাদের তীব্র কষ্ট হয়েছিল সেটা দেখে। ‘ছেলেধরা নয়’ এমন একজন নারীকে পিটিয়ে মেরে ফেলা আমাদের বিবেককে জাগিয়ে তুলেছিল। ঘটনাটির বিচার চলছে আদালতে। প্রশ্ন হচ্ছে রেনু যদি সত্যিই ছেলেধরা হতেন?

কিছু দিন আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনও গণপিটুনিতে মানুষ হত্যার রায় হলো। ১০ বছর আগে সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে একটি গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা দেশব্যাপী ভীষণ আলোড়ন তোলে। সাত বন্ধু শবে বরাতের রাতে ঘুরতে গিয়েছিলেন আমিনবাজারের সেই গ্রামে। গভীর রাতে স্থানীয় কিছু দুর্বৃত্ত তাদের ডাকাত বলে পিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করে। এতে ছয় জন মারা যান, একজন প্রাণে বাঁচেন। দীর্ঘ ১০ বছরের বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২ ডিসেম্বর সেই মামলায় ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আর খালাস দেওয়া হয় ২৫ জনকে। আচ্ছা, তখন গণপিটুনিতে হত্যাকাণ্ডের শিকাররা যদি সত্যিই ডাকাত হতো?

ঘটনা দুটির কথা মনে পড়লো সম্প্রতি একজন সংসদ সদস্যের মানুষকে পিটিয়ে মারার আহ্বান জানানোর পর। সংসদ হচ্ছে দেশের আইন বিভাগ অর্থাৎ আইন প্রণয়ন করাই সংসদ সদস্যের প্রধান কাজ, তারা আর যত কিছু করে থাকুন না কেন। অর্থাৎ আমাদের এটা ধরে নিতে হবে একটা রাষ্ট্র মানে কী, সেটি কীভাবে গঠিত হয়, কীভাবে পরিচালিত হয় এই সবকিছু সবচেয়ে ভালোভাবে জানবেন সংসদ সদস্যরা। কিন্তু এমন একজন মানুষ, নোয়াখালী-১ (চাটখিল ও সোনাইমুড়ী আংশিক) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি এইচএম ইব্রাহিমের একটি ভিডিও এবং সেটার সূত্রে সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে।

একটি সভায় জনাব ইব্রাহিম বলেন, ‘আমি হুকুম দিয়া দিচ্ছি, এই দুষ্কৃতকারীদের গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেললে কিছু হবে না। আপনারা যদি পারেন, গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলেন। যদি কেউ আসামি করে, আমি মামলার এক নম্বর আসামি হবো যে আমি হুকুম দিয়ে গেছি। এটা আমি আপনাদের কথা দিয়ে গেলাম।’

এই সংসদ সদস্য মানুষকে বলেছেন দুষ্কৃতকারীদের পিটিয়ে মেরে ফেলার জন্য। বলেছেন এলাকার একটি জনসভায়। আমাদের মনে থাকার কথা সংসদে বসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের আহ্বান জানানোর পরও তখন সেটা নিয়ে শোরগোল দূরেই থাকুক, তেমন কোনও আলাপ-আলোচনাই হয়নি।

ইদানীং কোনও ঘটনা মানুষের মধ্যে কতটুকু সাড়া ফেলেছে, সেটার মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায় সেই ঘটনাটির সংবাদ পাবার পর ফেসবুকে আমরা কী করি সেটা দেখে। ফেসবুক দেখেই বুঝলাম জনাব ইব্রাহিমের গণপিটুনি দিয়ে মানুষ হত্যার আহ্বানের পর সেই সংক্রান্ত সংবাদে কিংবা আমরা নিজেরাও বিষয়টি নিয়ে তেমন মাথা ঘামাইনি।

কেউ যদি সত্যিকার অর্থেই মাদক ব্যবসায়ী, চোর, ডাকাত এমনকি পকেটমার হয় তাহলে তাকে ‘হত্যা’ করে ফেলা যেতে পারে, এমন একটা ধারণা আমাদের সমাজে অনেকের মধ্যেই আছে। আমরা অনেকেই খুশি হই এমন মানুষদের যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে গিয়ে ক্রসফায়ার কিংবা বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করে ফেলে। শুরুর দিককার মতো ক্রসফায়ারের পর মিষ্টি বিতরণের ঘটনা এখন অত বেশি না ঘটলেও এসব ঘটনায় তৃপ্তি পায় এমন মানুষ এখনও আছে অসংখ্য। আর এসব অপরাধীকে আমরা যদি আমাদের সুবিধা মতো ‘বাগে পেয়ে যাই’ তাহলে নিজেরাই পিটিয়ে মেরে ফেলতে চাই, মেরে ফেলি।

শুরুতে বলা দু’টি ঘটনায় আমরা আঘাত পেয়েছিলাম। কারণ, ওই ঘটনাগুলোয় পিটিয়ে মারা হয়েছিল নিরপরাধ মানুষদের। ঘটনাচক্রে বিচার হয়েছে এবং হচ্ছে এই দু’টি ঘটনারই, যেখানে প্রকৃত অর্থে কোনও অপরাধে অভিযুক্ত মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়নি। এই দেশে আবহমানকাল থেকে আমরা পিটিয়ে চোর ডাকাত এমনকি পকেটমার মেরে ফেলি। কোনও একটি ঘটনার ন্যূনতম বিচার এই দেশে হয়নি। বিচার হওয়া যে অত্যাবশ্যক সেটাই বুঝি না আমরা।
সাম্য, মানবিক মর্যাদা, আর সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হয়েছে- এটাই আমাদের স্বাধীনতার চেতনা। কথাটি আমরা লিখে রেখেছি আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে। আমরা আসলে অনেকেই জানি না এই শব্দগুলোর মানে।

মানবিক মর্যাদা ধারণাটি নেওয়া হয়েছে সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রের ‘হিউম্যান ডিগনিটি’ থেকে। এর মানে হচ্ছে একজন মানুষ স্রেফ মানুষ হওয়ার কারণে কতগুলো অধিকারের অধিকারী হবেন। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ, শ্রেণি-পেশা, আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান কিছুর ভিত্তিতেই এই অধিকারগুলো হরণ করা যাবে না। একজন চোর অভিযুক্ত মানুষেরও রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার কাছে বিচার পাওয়ার সমান অধিকার আছে।  

সমস্যা হচ্ছে, এই দেশের বিচার ব্যবস্থায় অপরাধীদের শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম থাকে। এই রাষ্ট্র, এই সমাজ আমাদের এই বার্তা দেয়, বিচার পাওয়া প্রায় সব ক্ষেত্রে অসম্ভবের মতো। নোয়াখালীর সংসদ সদস্যের বক্তব্যেও আছে সেটা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে দেশের আইন এবং বিচার ব্যবস্থার সমস্যার কথা অনেকেই সামনে আনেন। কিন্তু নাগরিক হিসেবে আমাদের এটা বুঝতে হবে অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হওয়া এই সমাজ, এই রাষ্ট্র আরও খারাপ পরিস্থিতিতে গেলেও বিচারবহির্ভূতভাবে কোনও মানুষকে হত্যা করতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী পারে না, পারি না আমরাও।

আমরা নাগরিকরা যেকোনও ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার নই। নাগরিকদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ এটা পছন্দ করেন, এটা তাৎক্ষণিক সমাধান হিসাবে মেনে নেন। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, নাগরিকদের এই মানসিকতার সুযোগটি নিচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষমতাশালী মানুষরা।

যেকোনও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে, মেনে নিয়ে, কিংবা প্রতিবাদ না করে আদতে এই চর্চার অংশ হয়ে যাই। এর মাধ্যমে আমরা আসলে প্রমাণ করি ‘রাষ্ট্র’ ধারণাটিই আমরা বুঝি না। এই বোঝাটা নাগরিক হিসেবে আমাদের জন্য জরুরি।
 
 
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ