X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নজরুলের চেতনা ও বর্তমান সময়

স্বদেশ রায়
২৫ মে ২০২২, ০০:৪৪আপডেট : ২৫ মে ২০২২, ০০:৪৬

এ মুহূর্তে মনে হয় সব থেকে কঠিন কাজ নজরুলকে নিয়ে লেখা। নজরুলের সময় বসে, নজরুল অকপটে যে কথা বলেছিলেন, আমাদের বর্তমান সময়ে সমাজের সেটুকু সহ্য করার সহনশীলতা যেমন নেই; তেমনি তাকে উপলব্ধি করার ক্ষমতাও নেই। এমনকি উপলব্ধি করার সময়টুকু সমাজ থেকে, মনন থেকে হারিয়ে গেছে। সেখানে অন্ধত্ব, অর্থ লিপ্সা এই দুটো এসে অনেক শক্ত বাসা বেঁধেছে।

অন্যদিকে সমাজে আরও একটি শ্রেণি দাঁড়িয়ে গেছে, যারা নজরুলের কথার অপব্যাখ্যা করে, বা নজরুলের কোনও কথা উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করলে– ওই ব্যাখ্যার অপব্যাখ্যা করে- অনেক অপকর্ম তারা করতে পারে। যাতে যে কোনও মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। আরও বড় হলো, নজরুলকে সব থেকে বেশি গ্রহণ করার কথা ছিল যে তরুণদের– তাদের মধ্যেও নজরুলের চিহ্নিত সেই তারুণ্য বেশিক্ষেত্রে মারা গেছে। তারাও অর্থ লিপ্সা থেকে নানান রকম লোভের কাছে পরাজিত। পরাজিতরা আর যাই হোক কখনও তরুণ হয় না, যৌবনের অধিকারী হয় না।

নজরুল যৌবনকে চিহ্নিত করেছেন তার ভাষায়, ‘যৌবন দেখিয়াছি সেই দূরন্তদের মাঝে। যৌবনের মাতৃরূপ দেখিয়াছি- শব বহন করিয়া যখন সে যায় শ্মশান ঘাটে, গোরস্থানে, অনাহারে থাকিয়া যখন সে অন্ন পরিবেশন করে দুর্ভিক্ষ– বন্যা পীড়িতদের মুখে, বন্ধুহীন রোগ শয্যার পার্শ্বে যখন সে রাত্রির পর রাত্রি জাগিয়া পরিচর্যা করে, যখন সে পথে পথে গান গাহিয়া ভিখারি সাজিয়া দুর্দশা-গ্রস্থদের জন্যে ভিক্ষা করে, যখন সে দুর্বলের পাশে বল হইয়া দাঁড়ায়, হতাশার বুকে আশা জাগায়। ইহাই যৌবন, এই ধর্ম যাহাদের তাহারাই তরুণ। তাদের দেশ নাই, জাতি নাই, অন্য ধর্ম নাই। দেশ কাল জাতির ঊর্ধ্বে ইহাদের সেনা- নিবাস।”

এই যে যৌবনের কথা, এই যে তারুণ্যের কথা নজরুল উল্লেখ করেছেন। এরাই প্রকৃত তরুণ, এদেরই প্রাণ তারুণ্যে ভরপুর। এরা কখনও কাহারও অন্ধ অনুসারী হতে পারে না। এদেরকে কখনও কোনও লোভ ও স্বার্থ– এমনকি ক্ষমতার জৌলুস দিয়েও আটকানো যায় না। এই তরুণের ভেতর তাকে অপরিসীম এক অহংকার বা জেদ। যে জেদ তাকে শেখায়, নজরুলের ভাষায়- “আমাদের পৃথিবী আমরা গড়িয়া লইব।” বাস্তবে তরুণ যতক্ষণ না তার নিজের পৃথিবী নিজ হাতে গড়ে নিচ্ছে ততক্ষণ সে তারুণ্য বা যৌবনের দূত নয়। যেমনটি ছিলেন নজরুল। যে যৌবনের কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, তা মেলে সত্যি অর্থে নজরুলের মধ্যে– কখনও মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ যেন অনাগত নজরুলকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন, আবার কখনও মনে হয় নজরুল নিজের যৌবনকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাই নজরুলই রবীন্দ্রনাথের সেই যৌবনের প্রতীক, “চিরযুবা তুই যে চিরজীবী।/ জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে প্রাণ অফুরাণ ছড়িয়ে দেদার দিবি।/

আসলে যৌবনের দায়ই তো হলো সমাজের সব জীর্ণ চিন্তা চেতনা- পশ্চাৎপদ চিন্তা চেতনা ভেঙে ফেলার। দুই হাতে দূর করে দেবার। যখনই সমাজের কোনও প্রান্ত থেকে কোনও বদ্ধ জলাশয়ের মতো কোনও গোষ্ঠীবদ্ধ পচা পানি নিয়ে সমাজের মধ্যখানে উপস্থিত হতে চায়– তাকে সেই পচা পানি সহ সমাজের চলার পথ থেকে অনেক দূরে রেখে আসার দায়িত্ব শুধু তরুণের নয়– ওই জীর্ণ চিন্তা চেতনাকে শেষ করে দেওয়ার দায়িত্বও তার। আর এ কাজে তার কোনও অন্যায় নেই। বরং সমাজ, সমাজের মানুষ ও রাষ্ট্রকে বাঁচাতে, সামনের দিকে এগিয়ে নিতে তাকে এ কাজ করতেই হবে। কারণ সে যে কাজ করছে তা-তো অনেক প্রাণ বাঁচানোর জন্যে। অনেক প্রাণকে মুক্ত বায়ু দেওয়ার জন্যে- জীর্ণ অন্ধকার কুঠির থেকে বের করে এনে। নজরুল যা আরও পরিষ্কার করে বলেছেন, “পড় পড় বাড়িটাকে কর্পোরেশনের যে কর্মী এসে ভেঙ্গে দেয়, অন্যায় তার নয়, অন্যায় তার যে এই পড় পড় বাড়িটাকে পুষে রেখে আরো দশজনের প্রাণ নাশের ব্যবস্থা করে। ”

বাস্তবে ওই জীর্ণ বাড়ির মতো যে চিন্তা চেতনা প্রতি মুহূর্তে সমাজের দশজনকে সামনে এগুণে থেকে পিছিয়ে দিচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে দশজন নারীকে মিথ্যে বিধি-নিষেধের আড়ালে বেধে ফেলছে। আতঙ্কিত করছে আরও দশজন থেকে আরও দশজনকে। সমাজকে একটি নিশ্চিত মৃত্যুর জন্যে যে জীর্ণ ঘরে নিয়ে যাচ্ছে– তাকে ভেঙে ফেলা, তাকে সমাজ থেকে নির্মূল করার দায় তরুণদের। তারা যদি সাহস করে এগিয়ে না আসে, তারা যদি সিটি করপোরেশনের কর্মীর মতো শাবল, গাইতি না চালিয়ে এই চিন্তার জীর্ণ দালান ভেঙে না ফেলে তাহলে তো সমাজ ও রাষ্ট্র ক্রমেই ওই জীর্ণ দালানে ঢুকে যাবে। আজ আমাদের সমাজে ও রাষ্ট্রে প্রকৃত তারুণ্যের অভাবে এই জীর্ণ বাড়ির সংখ্যাই বাড়ছে। অথচ ভ্যানগার্ডের মতো কোনও তারুণ্য নেই সমাজে। নজরুলের সেই সুন্দরকে অপরূপ করে সৃষ্টি করার তারুণ্য’র অভাব আজ সমাজে বড় বেশি।

আর এই সুন্দরের পথের তারুণ্য না থাকায় আজ সমাজে তথাকথিত ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির সংঘাত হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। বাঙালি মুসলিম সমাজে ধর্ম ও সংস্কৃতির মিলন নিয়ে একটা দ্বিধা দীর্ঘ সময় থেকে কাজ করে আসছে। যার ফলে একটা সংঘাতের ধারাবাহিকতা এখানে সব সময়ই আছে। এখনও আছে বলে আজ তথাকথিত ধর্মের সঙ্গে সংঘাতের ফলে পহেলা বৈশাখ পালন সীমিত হয়ে আসছে। এ খুবই অশুভ লক্ষণ।

যে কোনও মানবগোষ্ঠীকে যদি তার পালিত ধর্মকে কোনও গোষ্ঠী তার ভূখণ্ড ভিত্তিক, ঐতিহ্য ভিত্তিক সংস্কৃতির সঙ্গে সংঘাতে দাঁড় করিয়ে দেয়– তার ফল ভয়াবহ। কারণ, এই নরগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সব সময়ই তার ধর্মের অনেক আগে এসেছে। তাই তার শিকড় অনেক গভীরে। যে গাছটির শিকড় অনেক গভীরে তার বিপরীতে নতুন গাছ এনে যদি সংঘাত সৃষ্টি করা হয় তাহলে তার ফল কখনও শুভ হয় না। বরং এ ধরনের সংঘাতে দাঁড় করিয়ে দিলে তা ওই জাতির জন্যে, ওই নরগোষ্ঠীর জন্যে ভয়াবহ হয়। আমাদের সমাজে কেন এ অবস্থার সৃষ্টি  হয়েছে তার মূল কারণটি নজরুল অনেক আগেই চিহ্নিত করে গেছেন। তিনি বলেছেন, “আমাদের সমাজের কল্যাণকামী যে সব মৌলানা সাহেবান খাল কাটিয়া বেনো জল আনিয়াছিলেন, তাহারা যদি ভবিষ্যতদর্শী হইতেন, তাহা হইলে দেখিতে পাইতেন- বেনো জলের সাথে সাথে ঘরের পুকুরের সব জল বাহির হইয়া গিয়াছে। উপরন্তু সেই খাল বাহিয়া কুসংস্কারের অজস্র কুমির আসিয়া ভিড় করিয়াছে।”

এখানে নজরুল যেখানে দৃষ্টি দিয়েছেন তা ‘ঘরের পুকুরের জল’। অর্থাৎ কোনও সমাজে যে ধর্ম, যে আধুনিকতা আসুক না কেন- সেই ধর্ম বা আধুনিকতার স্রোতের পানিকে নিজের ঘরের পুকুরের পানি অর্থাৎ নিজস্ব ঐতিহ্যের সংস্কৃতির সঙ্গে মেলাতে হয়। যে কোনও নরগোষ্ঠীর ভেতর যখনই কোনও নতুন আদর্শ ও সংস্কারের বিষয় প্রবেশ করে বা আসে তখন তাকে সবটুকু জায়গা ছেড়ে দিয়ে, নিজের ঘরের সংস্কৃতিকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিতে নেই। বরং এখানে একটি মহামিলন ঘটাতে হয়- সংযোজন ও বিয়োজনের মাধ্যমে। নিজের সম্পূর্ণটুকু কখনই বাদ দিতে নেই। যে কারণে আজ অনেকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ইরান হলেও সেখানে দেখা যায়, তারা তাদের বীর সোলেমানির মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে, তার উদ্দেশ্যে নানান শিল্পীর আঁকা ছবির প্রর্দশনী করে, থিয়েটার গোষ্ঠী তাকে নিবেদিত নাটক অনুষ্ঠান করে আর কবিরা কবিতা আবৃত্তি করে। ইরানের কবিতা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই, ছবি নিয়েও নয়। তারা হাজার হাজার বছরের ধারাতেই পুষ্ট। অর্থাৎ সবই ‘নিজের পুকুরের জলে’ পুষ্ঠ। আর এর পাশাপাশি ইরানে এখনও নওরোজ তাদের প্রধান উৎসব। যে উৎসবকে তারা ধর্মের সঙ্গে সংঘাত বাধিয়ে সংক্ষিপ্ত করে না। আফ্রিকার খ্রিষ্টানরাও তাদের প্রাচীন বাদ্যের তালে তালে এখানও নাঁচে। হাজার হাজার বছরের বাদ্যযন্ত্র আর তার সুর এখনও তাদের শরীরের, রক্তের স্রোতের সঙ্গে মেলানো। রামমোহন রায়ও ভারতীয় সংস্কৃতি ও প্রজ্ঞা থেকে সরে গিয়ে পুরোপুরি পশ্চিমাদের আধুনিকতায় ভেসে যাননি। তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পশ্চিমা শুধু নয়, সেমেটিক দর্শন মিলিয়েই তারা ব্রাহ্মসমাজ গড়েছিলেন। যার ফলে ভারতীয় সমাজে আধুনিকতা এসেছিলো- কিন্তু ধুয়ে মুছে যায়নি তার দীর্ঘ দিনের অর্জিত সংস্কৃতি ও প্রজ্ঞা।

বাংলাদেশের চিন্তা নায়কদের ও তরুণদের তাই এ বিষয়টি ভাবতে হবে। নজরুল যে ‘নিজ পুকুরের জল’– এর কথা বলেছেন, ওই জলটুকু যাতে পুকুরকে আবার ভরিয়ে তুলতে পারে, কোনও মতেই শুকিয়ে না যায়– সে কাজই এখন করতে হবে। সেটাই এখন বাংলাদেশকে তার আপন সংস্কৃতি নির্ভর করে আধুনিক পথে নিয়ে যাবার প্রকৃত পথ। এ কাজ যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ নজরুলের কথাই সত্য যা তার ভাষায়, “তাই আমাদের সকল শুভ- কাজ, কল্যাণ- উৎসব আজ শ্রীহীন, রূপহীনও প্রাণহীন।”

এই সকল শুভকাজে যতক্ষণ না অবধি রূপ, শ্রী ও প্রাণ ফিরে  আসছে ততক্ষণ আমরা যৌবনহীন, অর্ধমৃত জাতি হিসেবেই জীর্ণবাড়ির ইটের ভয়ে ভীতু হয়েই বেঁচে থাকবো কোনোমতে। তাই এখন সব থেকে বড় প্রশ্ন কোন পথে সেই ভয়হীন সমাজ ফিরে আসবে যেখানে সকল শুভকাজ, ফিরে পাবে শ্রী, রূপ ও প্রাণ।

কোন সে পথ? সে তো নজরুলই বলে গেছেন, গেয়েছেন এই বাংলার প্রান্তরে বার বার উচ্চকণ্ঠে- “মোরা  আপনি ম’রে মরার দেশে- আনব বরাভয়।” অর্থাৎ আমাদের এই জীর্ণতা যতই আমাদেরকে জড়িয়ে ধরছে- ততই নজরুল ডাক দিয়ে যাচ্ছে, তার চেতনা দুয়ারে এসে আঘাত করছে, নিজে মারা গিয়েও দেশের জন্যে, মানুষের জন্যে এই পুরাতন জীর্ণদের কবল থেকে বের হবার ভয়হীন চিহ্ন হতে হবে। কারণ, এটা সত্য আজ শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর দেশে দেশে ধর্মীয় চিন্তার নামে পশ্চাৎপদ এক চিন্তা মানুষের মনোজগতকে ভীত করে তুলেছে। আর এর বিপরীতে ভয়হীন সমাজ গড়তে হলে, অনেককেই আপনি ম’রে দেশে দেশে বরাভয় আনতে হবে। 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্যে রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত।

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘আমার স্ত্রী শুধু অন্যের পরামর্শ শোনে’
‘আমার স্ত্রী শুধু অন্যের পরামর্শ শোনে’
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ