X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

দ্বাদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ কারা?

রাজন ভট্টাচার্য
৩০ মে ২০২২, ১৮:২৭আপডেট : ৩০ মে ২০২২, ১৮:২৭
দেশীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৪ সালের শুরুতে নির্বাচন হতে পারে এমন বাতাস পাওয়া যাচ্ছে। অথচ দু’বছর আগে থেকেই এ নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। চলছে জোট গঠনের প্রস্তুতি। রাজনৈতিক ভাঙা-গড়াও চলছে প্রকাশ্যে, ভেতরে। আস্তে আস্তে উত্তপ্ত হচ্ছে রাজনীতির মাঠ। এটাই স্বাভাবিক।

ইতোমধ্যে বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে আমেরিকাসহ বিশ্বের শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক দেশগুলোকে নিজেদের পক্ষে নেওয়ার লবিং দৃশ্যমান। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষসহ আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ওপর বিভিন্ন দেশ চাপ সৃষ্টি করতে দেখা যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকেও বলতে দেখেছি, সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন চান তিনিও। সেই সঙ্গে শক্তিশালী বিরোধী দলও দেখার পক্ষে নিজের অবস্থান তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।

গত সাত মে আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে দল প্রধান যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। সব দলের অংশগ্রহণে শেখ হাসিনার নির্বাচন করার মনোভাব দেখানোর পর বিএনপি অনেকটাই উজ্জীবিত। তারা এখন নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে বেশি কথা বলছে।

অর্থাৎ বিএনপি আওয়ামী লীগের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির জায়গা থেকে অনেকটাই সফল। আর বৈশ্বিক বাস্তবতা বিবেচনায় প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো গোটা দুনিয়াজুড়ে গণতান্ত্রিক চর্চার দেশগুলোতে নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার মিশন নিয়ে নেমেছে এটিও কিন্তু স্পষ্ট। এরই ধারাবাহিকতায় সেসব দেশের বাংলাদেশকে বেছে নেওয়া অমূলক নয়। তাছাড়া এগিয়ে চলার বাংলাদেশ তো এখন গোটা দুনিয়ার মধ্যে আইডল, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছুতেই বাংলাদেশ এগিয়ে। ক্ষমতাধর বিশ্বনেতাদের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশকে যদি সঠিক পথে পরিচালিত করা সম্ভব হয়, তাহলে তো নিশ্চয়ই খারাপ হবে না? দেশে সঠিকভাবে গণতন্ত্র চর্চা, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ মানেই চলমান অস্থির বিশ্ব রাজনীতিতে ইতিবাচক বার্তা দেবে।

গণতন্ত্র শক্তিশালী হলে দেশে রাজনৈতিক শক্তির প্রভাব বাড়বে। বাংলাদেশে শ্রীলংকা, পাকিস্তান বা নেপালের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশও শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারবে। নিজেদের শক্তির জানান দিতে পারবে।  

আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির বৈঠকের পর দেশের রাজনীতিতে নির্বাচন কেন্দ্রিক কথাবার্তাই বেশি। বিশেষ করে বিরোধী দলের রাজনীতি একেবারেই নির্বাচন কেন্দ্রিক। বিএনপির পক্ষ থেকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ প্রতিদিন সরকারের নানা ব্যর্থতার কথা মানুষের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে। আওয়ামী লীগও হয়তো ভাবছে জাতীয় পার্টি পকেটে, তাই রাজনীতির মাঠে বরাবরের মতোই প্রধান প্রতিপক্ষ মনে হয় বিএনপি!

রাজনীতির মাঠে বিএনপিকে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে আওয়ামী লীগ। বিএনপিও ব্যর্থতার চাপে পিষ্ট হতে হতে আওয়ামী লীগকেই প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিবেচনায় হয়তো এগিয়ে যাচ্ছে।

আসলে কি তাই? আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির হিসাবটা একেবারেই ভিন্ন হওয়ার কথা। এর প্রধান কারণ হলো, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর গোটা দুনিয়া একেবারেই অস্থির। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিশ্বনেতারা যুদ্ধ থামাতে ব্যর্থ। যদিও শক্তিধর দেশগুলোর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে উভয় পক্ষকে নানাভাবে ইন্ধন ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।

ইতোমধ্যে যুদ্ধের বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশে দেশে। হু হু করে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। আমদানি নির্ভর পণ্যগুলোর অবস্থা আরও বেশি খারাপ। অনেক দেশ নিজেদের মজুত ধরে রাখতে বিভিন্ন খাদ্যপণ্য রফতানি বন্ধের ঘোষণা দিচ্ছে। এতে স্থানীয় বাজার আরও বেশি অস্থির হচ্ছে।

এমনিতেই তো দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে প্রধান খাদ্যশস্য চালের বাজার টালমাটাল গত কয়েক বছর ধরেই। এর বাইরে সয়াবিন তেল, জ্বালানি তেল, মাছ, সবজিসহ সবকিছুই বাড়তির দিকে।

ব্যয় সামলাতে সরকার আবারও বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর চিন্তা করছে। এতে আবারও নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির হবে। বাড়ছে পণ্য পরিবহন ও উৎপাদন ব্যয়। যা জীবনযাত্রায় সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বৈশ্বিক বাস্তবতাসহ নানা কারণে দেশে নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ায় সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। এমনিতেই তো কোভিডের কারণে আড়াই কোটির বেশি মানুষ বেকার হয়েছে। বেকারদের মধ্যে অনেকেই এখনও চাকরি পাননি। যারা পেয়েছেন তাদের একটা বড় অংশ কম বেতনে চাকরি করে কোনোরকম দিনাতিপাত করছেন। সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে সবার। বহু পরিবার খরচের হাত গুটিয়ে এনেছে। কাটছাঁট ব্যয়ে চলছে সংসার।

এই পরিস্থিতিতে সবাই কমবেশি ক্ষুব্ধ। কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক, শহর থেকে গ্রাম সবখানেই সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা আছে। রাজনীতির মাঠেও এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা বিস্তর। সরকারের নানা ব্যর্থতা থাকলেও গত ১৩ বছরের বেশি সময়েও মানুষকে কিন্তু মাঠে নামাতে পারেনি বিএনপি। অথচ নিত্যপণ্যের ইস্যুতে দল-মত নির্বিশেষে সবাই সরকারের বিরুদ্ধে। কারণ, মানুষকে আগে খেয়ে বাঁচতে হবে, তারপর রাজনীতি বা আন্দোলন।

নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের প্রতিবাদে মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে সে পরিস্থিতিও কিন্তু দেশে নেই। তবে ক্ষুব্ধ এই মানুষগুলো দল ও মতের ঊর্ধ্বে ওঠে ব্যালটের মাধ্যমে নিত্যপণ্যের দাম কমানোর ব্যর্থতার জবাব দিতে পারে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে! এই বিবেচনায় আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিন্তু নিত্যপণ্য!

নির্বাচন সামনে– তাই এই ইস্যু বিরোধী দল বিএনপি কাজে লাগাবে এটাই স্বাভাবিক। বিএনপির নির্বাচনকালীন সরকার, আসন সমঝোতাসহ রাজনৈতিক সব রকমের ইস্যু বাদ দিয়ে সরকারের ব্যর্থতা যদি মানুষের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরার পাশাপাশি ক্ষমতায় গেলে সবছিুর দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি যদি ভোটারদের বিশ্বাস করানো যায়, তাহলেই তো  পোয়াবারো।

তবে কি আওয়ামী লীগ বসে থাকবে? মোটেও না। গেলো ১৩ বছরের বেশি সময়ে দেশে সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়েছে। এ কথা মানুষের কাছে তুলে ধরেতে হবে। ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করে নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশ পদ্মা সেতু নির্মাণ করে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে, এটি কি কম সফলতা?

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট-ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইলসহ একের পর এক ফোর লেন প্রকল্প, ঢাকা-কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্প, ৬৪ জেলা রেল নেটওয়ার্কের মধ্যে আনা, মেট্রোরেল, বিআরটি, কর্ণফুলী টানেলসহ সব উন্নয়নের চিত্র ব্যাপকভাবে ১৪ দলকে সঙ্গে নিয়ে প্রচার করতে হবে।

চলমান অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও যদি ২০২৩ সালের শুরু থেকে নিত্যপণ্য আবারও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে মানুষ এতদিনের সব দুঃখ-কষ্টের কথা সহজেই ভুলে যাবে। এতে আওয়ামী লীগের প্রতি জনসমর্থন রাতারাতি বাড়বে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে আওয়ামী লীগ মূল হাতিয়ার হিসেবে এরকম চিন্তা কাজে লাগাতে পারে।

বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সামনে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে আরও দুটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর একটি হলো যেসব যুদ্ধাপরাধীর বিচার বা সাজা হয়েছে তাদের পরিবারের সদস্যরা কিন্তু বসে নেই, থাকার কথাও নয়। বিদেশি শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। নির্বাচনের সুযোগে তারা মরণ কামড় দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। এই অশুভ শক্তি সফল হলে রাজনৈতিক সমর্থন আদায়েও কিন্তু সময় লাগবে না। এ ব্যাপারে সজাগ থাকা জরুরি।

সেই সঙ্গে বিদেশি যেসব শক্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে কথা বলছে বা চাপ সৃষ্টি করছে, তাদের প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়ন করা, তাদের ব্যাপারেও আওয়ামী লীগকে আরও বেশি সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো জরুরি। বাড়াতে হবে আন্তর্জাতিক মিত্রের সংখ্যাও।

মনে রাখতে হবে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি, যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের লোকজনের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও আন্তর্জাতিক নগ্ন হস্তক্ষেপ। এই তিন সমস্যা মোকাবিলা সম্ভব হলে, ২০৪১ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ উন্নত ও প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ উপহার দেওয়া সম্ভব হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ