X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সীতাকুণ্ডের ভয়াবহতার মধ্যেও দেখা যায় মানবিক বাংলাদেশ

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
১৯ জুন ২০২২, ১৮:২৪আপডেট : ১৯ জুন ২০২২, ১৮:২৪

‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/ সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।’ কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের এই গানটি আমাদের শিহরিত করে, শিরায় অনুরণন তোলে এবং  আবেগে জড়িয়ে পড়ে অধিরতা। গত ৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের বি এম কন্টেইনার ডিপোতে  আগুন লাগা ও বিস্ফোরণ পরবর্তী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এমনই এক মানবিক বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষ করেছে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব।

সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় দুর্যোগ এবং অগ্নিকাণ্ড ছিল সীতাকুণ্ড অগ্নিকাণ্ড। সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর এত বড় দুর্যোগ বাংলাদেশে ঘটেনি। আমরা দেখেছি কীভাবে সাধারণ মানুষ ডিপোতে আটকে পড়া কর্মীদের বাঁচানোর জন্য নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। কীভাবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নিজেদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছেন। আগুন নেভানোর প্রচেষ্টায় বেশ কয়েকজন ফায়ার সার্ভিস কর্মীর মৃত্যু হয়েছে, যা সচরাচর দেখা যায় না। এই কর্মীদের আত্মত্যাগের ঘটনা জাতি সারা জীবন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

প্রথম দিকে ডিপোতে আগুন লাগার পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করার সময় কেমিক্যাল ভর্তি একটি কন্টেইনার বিস্ফোরিত হওয়ার ফলে সেখানে অবস্থানরত  অনেকেই মারা যান। এ পর্যন্ত সেই ঘটনায় প্রায় ৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। কন্টেইনার ডিপোতে যখন আগুন লাগে, ঠিক সেই সময় গেটে তালা দিয়ে ডিপোর কর্মচারীরা পালিয়ে গেলে অনেক কর্মী ভেতরে আটকে পড়ে। তখন সাধারণ মানুষ গেট ভেঙে তাদের উদ্ধারের চেষ্টা করে। ইতোমধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সেখানে উপস্থিত হয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করার সময় একটি কন্টেইনার বিস্ফোরিত হয় এবং সেখানে অনেকেই নিহত হন।

কন্টেইনার বিস্ফোরণের পরপরই নিহতের সাথে সাথে এত মানুষ আহত হয়েছিল যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের পক্ষে চিকিৎসা দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। আহতদের মধ্যে কারও হাত নেই, কারও পা নেই, কারও চোখ অন্ধ হয়ে গেছে এবং কারও মাথা দিয়ে রক্ত ঝরছে। সেই অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে কর্মরত চিকিৎসক এবং নার্সরা প্রায় অসহায় হয়ে পড়ে।  সেই সময় চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন চট্টগ্রামের এবং আশপাশের সব ডাক্তার এবং নার্সদের প্রতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এসে রোগীদের সেবা করবার জন্য। তার সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে চট্টগ্রামের এবং আশপাশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ এবং ক্লিনিক থেকে ডাক্তাররা চট্টগ্রাম মেডিকেলে গিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে রোগীদের সেবা দিয়েছেন। একই সাথে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে সেবা করেছেন আহতদের।

একসময় আহতদের নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের চাহিদা বাড়তে থাকে। টেলিভিশন এবং বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে রক্তের প্রয়োজনের কথা জানিয়ে আহ্বান করা হয় রক্ত দেবার জন্য। আমরা সকলেই জানি যে নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের অপ্রতুলতা রয়েছে সব খানে। সেই সময় আমরা দেখেছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাস ভরে নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত প্রদানের জন্য মেডিকেল কলেজে পৌঁছেছে। সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁদের এই ভালোবাসা সেই মানবিক বাংলাদেশেরই পরিচয় বহন করে, যেখানে মানুষের বিপদে মানুষ এগিয়ে আসে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই সকলের বিপদে আগিয়ে এসেছে। সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার সময় এক অন্য রকম বাংলাদেশ উপলব্ধি করেছি আমরা। সেই সময় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষসহ ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নিজেদের শেষটুকু দিয়ে আহতদের সহায়তা করার চেষ্টা করেছে, যেটিও সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

এমনকি বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা অনেক সিএনজি ও রিকশাচালককে দেখেছি যারা সারা দিন রোগী এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিনামূল্যে পরিবহন করেছেন। যারা রক্ত দেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এবং চট্টগ্রামের অন্যান্য নার্সিংহোমে যেতে চেয়েছেন তারা তাদের বিনামূল্যে পৌঁছে দিয়েছেন সেই সমস্ত জায়গায়। মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ এবং ভালোবাসার মাধ্যমে সত্যিই অন্য রকম এক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছিল সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডের সময়।

আমরা ইতোমধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি সরকারের তরফ থেকে এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মৃতদের পরিবারের জন্য বিভিন্ন ধরনের সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটা ঠিক যে  সেই সহায়তা দিয়ে স্বজন হারানো পরিবারের শূন্যতা পূরণ করা যাবে না। তবে তাদের এই দুর্ভোগের সময়ে যদি তাদের পাশে দাঁড়ানো যায়, তাহলে তারা মানসিকভাবে অনেকটা আশ্বস্ত হবে। তাছাড়া আহতদের মধ্যে গুরুতর অনেককেই ঢাকাতে এনে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে। তাৎক্ষণিকভাবে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করার  প্রয়োজন ছিল সেগুলো ইতোমধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে, যা ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্বস্ত করেছে।

ডিপোতে কীভাবে আগুন লাগলো, কিংবা কেউ আগুন লাগালো কিনা, সে বিষয়টি অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষ। যারা এই অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হবার পরে সেই অগ্নিকাণ্ডে মৃতদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা এবং আহতদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেই অবস্থায় সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে যেভাবে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে আহত মানুষদের সহায়তা করেছে সেটি সত্যিই একটি বিরল ঘটনা।

তবে পাশাপাশি ডিপোর মালিকের বিভিন্ন ধরনের অব্যবস্থাপনার কথাও বিভিন্ন পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উঠে এসেছে। এত বড় একটি ডিপো পরিচালনার জন্য যে ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল সেটি আদৌ করা হয়েছিল কিনা সে বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাছাড়া কেমিক্যাল বহনকারী কন্টেইনারগুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা গেলে হয়তো এতটা ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটতো না- যেটা সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। যে কন্টেইনার বিস্ফোরিত হয়ে এতগুলো মানুষের প্রাণ গেলো, সেই কন্টেইনারে  আসলে কি ছিল সেটা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানতো না। ফলে তারা কন্টেইনারের খুব কাছাকাছি গিয়ে যখন আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছিল তখন হঠাৎ করেই কন্টেইনার বিস্ফোরিত হয়ে যায়। এবং সেই বিস্ফোরণে অনেক প্রাণ অকালে ঝরে গেছে।

পাশাপাশি আমরা অনেক উৎসুক জনতাকে দেখেছি, যারা অগ্নিকাণ্ডের ভিডিও ধারণ করার জন্য আগুনের খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। এমনকি অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভে অগ্নিকাণ্ডে ঘটনা সম্প্রচার করছিল। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং পত্রিকার মাধ্যমে জানা গেছে, বেশ কয়েকজন সেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা লাইভ সম্প্রচার করতে গিয়ে মারা গেছেন। তারা সরাসরি লাইভ দেখানোর সময় হঠাৎ  কন্টেইনার বিস্ফোরিত হওয়ায় তারা মারা যান। এ ধরনের দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় সাধারণ মানুষের এই ধরনের উৎসাহ মোটেও কাম্য নয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার এতটাই বেড়ে গেছে যে কোনও জায়গায় কোনও দুর্ঘটনা ঘটলেই অনেক উৎসুক জনতা সেই ঘটনার ভিডিও ধারণ করতে শুরু করে। আবার অনেকে সেই ঘটনার লাইভ সম্প্রচার করতে শুরু করে। অনেক ক্ষেত্রেই ভিডিও ধারণ এবং লাইভ সম্প্রচার করার ফলে হয়তো অপরাধীকে শনাক্ত করা সহজ হয়। কিন্তু এই ধরনের বিপজ্জনক অগ্নিকাণ্ডের সময় আগুনের খুব কাছে গিয়ে সরাসরি লাইভ সম্প্রচার করার মধ্যে যে পরিমাণ ঝুঁকি রয়েছে, সেই ঝুঁকি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সচেতন থাকা উচিত। যারা এই অগ্নিকাণ্ডের ভিডিও ধারণ করার সময় মারা গেছেন, তাদের পরিবারের যে ক্ষতি হলো সেটি কখনোই পূরণ করা সম্ভব নয়। এই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে জনগণকে ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।

সীতাকুণ্ডের মতো হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা কখনোই কাম্য হতে পারে না। তবে সরকারের এখন মূল কাজ হচ্ছে আহতদের সুস্থ করে তোলা এবং সেই জন্য যা যা করণীয় তা করা।  একই সাথে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এই ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করা। যদি এই ধরনের ঘটনা মালিক পক্ষের ভুলের কারণে হয়ে থাকে অথবা অন্য কোনও কারণে হয়ে থাকে তবে দোষীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যেন ভবিষ্যতে মানুষ এ ধরনের ভুল না করে।

আমরা চাই না একটি প্রাণও অকালে ঝরে যাক। যারা এই অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের পরিবারের প্রতি দেশবাসীর সহমর্মিতা রয়েছে। পাশাপাশি আহতদের চিকিৎসা এবং সহায়তার এগিয়ে আসা যে মানবিক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি সেই মানুষদের হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে সাধুবাদ জানাই। এটিই হচ্ছে প্রকৃত বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জনগণ একসময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। বাংলাদেশের যেকোনও দুর্যোগে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া সীতাকুণ্ডের ঘটনাতেও একইভাবে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং প্রমাণ করেছে মানুষ মানুষের জন্য।

লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তীব্র গরমে পানি চাইতে চাইতেই ট্রাফিক পুলিশের মৃত্যু
তীব্র গরমে পানি চাইতে চাইতেই ট্রাফিক পুলিশের মৃত্যু
বাংলাদেশের উন্নয়ন-সহযোগী হিসেবে দ্রুত জায়গা করে নিচ্ছে ফ্রান্স
বাংলাদেশের উন্নয়ন-সহযোগী হিসেবে দ্রুত জায়গা করে নিচ্ছে ফ্রান্স
পুরান ঢাকার কেমিক্যাল কারখানা সরাতে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ
পুরান ঢাকার কেমিক্যাল কারখানা সরাতে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ
ওরসে ঝগড়া, সেই শত্রুতায় ছুরিকাঘাতে যুবককে হত্যা
ওরসে ঝগড়া, সেই শত্রুতায় ছুরিকাঘাতে যুবককে হত্যা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ