X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘আদিবাসী’ বললে কী সমস্যা?

জোবাইদা নাসরীন
০১ আগস্ট ২০২২, ১৫:৫৬আপডেট : ০১ আগস্ট ২০২২, ১৮:০০

আগামী ৯ আগস্ট ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এই দিবসটি পালিত হয়। এই ‘আদিবাসী দিবস’কে কেন্দ্র করে ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’সহ অন্যান্য ‘আদিবাসী সংগঠন’ যখন শেষ মুহূর্তের জরুরি কাজগুলো সারছিল, তখনই সরকারের তরফ থেকে আসা একটি প্রজ্ঞাপন সকলকে আহত করেছে। তবে এখানে একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন, প্রায়ই দেখা যায় ৯ আগস্টের আগেই এই ধরনের প্রজ্ঞাপন আসে এবং সেগুলোর যথাযথ প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনোটিই আমলে নেয়নি সরকার।

এবারের প্রজ্ঞাপনটি পাঠানো হয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে। জারি করা হয়েছে ১৯ জুলাই। প্রজ্ঞাপনটি সই করেছেন উক্ত মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব শামসুর রহমান। প্রজ্ঞাপনটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো সেই চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ছোট ছোট সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা নৃগোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

এ প্রজ্ঞাপনের দ্বিতীয় অংশ হিসেবে আরও বলা হয়েছে যে, ‘বর্ণিতাবস্থায় আগামী ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত টকশোতে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অন্য ব্যক্তিদের বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে প্রচারের জন্য অনুরোধ করা হলো।’

এখানে কয়েকটি বিষয় আসলে জোর আলোচনা এবং প্রতিবাদের দাবি রাখে। প্রথমত, একটি বিষয় নিয়ে কে কী বলবেন, কীভাবে বলবেন এবং সেটিকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন এটি মানুষের একেবারেই অধিকারভুক্ত। তাই অন্য দশটি আলোচনার মতো এই আলোচনাতেও বিশেষজ্ঞ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা নিজেদের মতামত ব্যক্ত করার কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে আপত্তি জানিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়।

এখন প্রশ্ন হলো, ‘আদিবাসী’ বললে আসলে সমস্যা কী? সমস্যা আসলে কার? এই সমস্যার পেছনের রাজনীতি কী? ২০০৮ সালে নির্বাচনি ইশতিহারে বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনি ইশতিহারে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করেছিল। তাহলে ক্ষমতায় এসেই কেন তাদের এই ভিন্ন রাজনৈতিক মোড়? সরকারের কেন ‘আদিবাসী’ শব্দটি নিয়ে এত মাথাব্যথা?

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সংজ্ঞা এবং জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ বসবাসরত ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠী ‘আদিবাসী’ সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে। কারণ, তারা ব্রিটিশ শাসনামলের আগে থেকেই এই অঞ্চলে বসবাস করছেন, তারা দেশের অধিপতি জনগোষ্ঠীর অংশ নয়, তারা তাদের নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতি অক্ষুণ্ন রেখেছে। তাহলে সরকার কেন তাদের এই স্বীকৃতি দিতে চায় না?

বাংলাদেশে বসবাসরত ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরেই তাদের ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন করছে। এই স্বীকৃতি লাভ তাদের অনেক অধিকারকে নিশ্চিত করবে। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো তাদের প্রথাগত আইনের স্বীকৃতি। ‘আদিবাসী’রা তাদের নিজস্ব আইনে চলে। তাদের আইন অনুযায়ী ভূমির মালিকানার কোনও লিখিত কাগজের রেওয়াজ নেই। এ কারণেই তাদের অনেক ভূমিই বাঙালিরা দখল করে নিয়েছে। ভূমি তাদের থেকে হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন তাদের প্রথাগত আইনের স্বীকৃতি দিলে সেই জমিগুলো ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা জোরদার হয় এবং যেটি সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের বিপক্ষে যাবে। এটিই হয়তো সরকারের প্রথম ভয়। এই স্বীকৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ভূমির অধিকারের বিষয়টি, সেটি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই।

আমরা জানি, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির শান্তিচুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ের ভূমির অধিকার নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তিতে গঠিত হয় ভূমি কমিশন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভূমি কমিশন কোনও কাজ করেনি। তাই স্পষ্টভাবেই বলা যায়, ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতির সাথে ভূমির অধিকারের বিষয়টিই সবচেয়ে জোরালো।

দ্বিতীয়ত– আত্মপরিচয়ের অধিকার। আত্মপরিচয়ের সঙ্গে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রসঙ্গটি জড়িত। তাই রাষ্ট্রও এটিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে। অনেকের ধারণা, ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি পেলেই বাংলাদেশে বসবাসরত ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠী নতুন করে আন্দোলন শুরু করবে। সেটিকেও রাষ্ট্র হুমকি হিসেবে পাঠ করছে।

আমরা এর আগেও দেখেছি সরকার এই বিষয়ে গণমাধ্যমে চিঠি দিয়েছে এবং তখন গণমাধ্যম ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ ব্যবহার করেছে। এটি স্পষ্টত মুদ্রিত পত্রিকা, অনলাইন মিডিয়ার বিষয়ে এই নির্দেশনায় কিছু লেখা নেই। সংবাদমাধ্যম কী প্রচার করবে, কী কথা বলবে, কী লিখবে সেটা চিঠি দিয়ে জানানোর বিষয়টি অপ্রত্যাশিত।

আমি বিশ্বাস করি এবং দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করি সরকার অচিরেই মত প্রকাশের অধিকার হরণের প্রচেষ্টা থেকে সরে আসবে এবং ‘আদিবাসী’দের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ‘আদিবাসী’ হিসেবে দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তরিক হবে।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ইমেইল: [email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ