X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

‘শনিবার বিকেল’ এবং ভাবমূর্তির জুজু

জসীম আহমেদ
১০ আগস্ট ২০২২, ১৩:২০আপডেট : ১০ আগস্ট ২০২২, ১৮:০২

বাংলাদেশে সিনেমা দেখভালের দায়িত্ব যাদের দেওয়া হয়েছে, তাদের সিনেমা জ্ঞান কতটা? ফর্মুলার বাইরে গিয়ে নির্মাতার নিজের মতো করে গল্প বলার সঙ্গে তাদের বিমাতাসুলভ আচরণ বিষয়ক একটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেই বোঝা যাবে। নির্মাতা বা শিল্পীদের জন্য এমন অভিজ্ঞতা খুবই অস্বস্তিকর।

অনেকেরই জানা, যৌথ প্রযোজনার ক্ষেত্রে নির্মাণ শেষে সিনেমা হলে প্রদর্শনের সার্টিফিকেট পেতে যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র সংক্রান্ত একটি বাছাই কমিটিকে ছবি দেখাতে হয়। তারা ছাড়পত্র দিলেই সেন্সর বোর্ডে ছবিটি জমা দেওয়া যায়। যদিও এই কমিটি নির্মাণ শুরুর আগেই চিত্রনাট্যের অনুমোদন দেয়। তাদের অনুমোদন ছাড়া তথ্য মন্ত্রণালয় যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মাণের অনুমতি দেয় না। যৌথ প্রযোজনার একটি সিনেমা নির্মাণের পরিভ্রমণটা তাই অন্য দশটা সিনেমার মতো সহজ নয়। সময়সাপেক্ষ তো বটেই।

বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘মায়ার জঞ্জাল’-এর (ডেব্রি অব ডিজায়ার) প্রযোজক আমি। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন যৌনকর্মী। স্বাভাবিকভাবে এমন পেশার মানুষের মুখের ভাষা সুশীল শ্রেণির মতো হওয়ার কথা নয়। যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র সংক্রান্ত বাছাই কমিটির সভাপতি এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। তিনি সরকারি কর্মকর্তা, আমলা। প্রিভিউ শেষে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘মেয়েটার ভাষা এত অশ্লীল কেন? এগুলো ফেলতে হবে।’ জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করতে হয় না বলে তার কাছে অশ্লীলতার সংজ্ঞা জানতে চাইনি। শুধু বোঝানোর চেষ্টা করলাম, পেশার বিচারে এই চরিত্রের এভাবে কথা বলাই বিশ্বাসযোগ্য। একজন যৌনকর্মী কি বিসিএস ক্যাডার বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ভাষায় কথা বলবে?

বাছাই কমিটিতে একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, একজন শিল্পী এবং একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বাকি সবাই সরকারি কর্মকর্তা। শিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক দুই জনই আমার কথায় সমর্থন জানিয়ে বলেন, ‘এগুলো গল্প এবং চরিত্র অনুযায়ী খুবই স্বাভাবিক, মানানসই ও প্রয়োজনীয়।’ এফডিসির এমডি কিছুটা নমনীয় হলেন, বোঝা গেলো তার অভিব্যক্তিতে।

উল্লেখিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব একসময় জাসদের রাজনীতি করতেন। তবে সিনেমা বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গিতে মনে হলো তিনি প্রচণ্ড রক্ষণশীল, মৌলবাদীর মতো। ‘ফালতু’, ‘সিনেমা হয়নি’, ‘অশ্লীল’, ‘পরিবার নিয়ে দেখার মতো না’– এরকম নানান কথা একটানা উচ্চারণ করে ছবিটির শুটিং আবারও করতে বলেন তিনি। রাজনৈতিক কোটায় বাছাই কমিটিতে এসেছেন তিনি। অন্যরা ভয় পায়, বুঝতে অসুবিধা হলো না সবার চুপসে যাওয়া দেখে।

’৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রিপোর্টার হিসেবে আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী বিট কাভার করার সুবাদে সাংস্কৃতিক জোটের এই নেতাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং বিটিভিসহ বিভিন্ন জায়গায় দেখেছি। তিনিও আমাকে চেনেন, বিশ্বাস ছিল। তার এই অদ্ভুত আচরণে কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও নিজেকে সামলে নিলাম। আমি জানালাম, আর্টহাউস সিনেমার বিশ্বসেরা প্ল্যাটফর্ম ‘মুবি ডটকম’ (mubi.com) ‘মায়ার জঞ্জাল’কে জ্যঁ লুক-গদার, ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা, কোয়েন্টিন টারান্টিনো, রোমান পোলানস্কির মতো খ্যাতিমান নির্মাতাদের সিনেমার পাশাপাশি রেখেছে। মস্কো, সাংহাইয়ের মতো প্রথম শ্রেণির চলচ্চিত্র উৎসবের অফিসিয়াল সিলেকশনে ছিল এটি। এছাড়া অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছে।

মাঝে মধ্যে নিজের ঢোল নিজেকে পেটাতে হয় ভেবে কথাগুলো বলা। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির তৎকালীন সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার জোর দিয়ে বলেন, ‘এত চমৎকার একটা সিনেমা আমাদের আটকানো উচিত হবে না।’ তার কথায় সায় দিলেন এফডিসির এমডি। এবার সেই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জানান, তিনি সবাইকে নিয়ে আবারও ছবিটি দেখবেন। তবে অন্য কেউ তাতে রাজি হলেন না। একাই পরপর দুই দিন ‘মায়ার জঞ্জাল’ দেখলেন তিনি। আমরা থিয়েটার ও প্রজেকশনের ভাড়া পরিশোধ করলাম। তাকেও দুইবারের জন্য প্রিভিউ ফি দিতে হলো। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে দুটি ছোটগল্পের ছায়া অবলম্বনে ‘মায়ার জঞ্জাল’-এর চিত্রনাট্য করেছিলাম আমরা, ভাগ্য ভালো সেই গল্পে জঙ্গি, উগ্রবাদ, ধর্মীয় সেনসেশন, কারও অনুভূতি বা দেশের ভাবমূর্তির মতো জুজুর ভয় দেখানোর কোনও উপাদান ছিল না। তা না হলে সংস্কৃতির অভিভাবকের ঢোলের বাড়ির শব্দটা নাচুনি বুড়ি আমলাদের কানের পাশ কাটিয়ে যেত না। ফলে অল্পতেই রক্ষা পায় আমাদের ছবিটি। ‘মায়ার জঞ্জাল’ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মতো রক্ষণশীল উৎসবের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে ছিল। দর্শকদের অভিযোগের আঙুল তো ওঠেইনি, উল্টো সবার কাছ থেকে প্রশংসা পেয়েছে। তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের হাত থেকে নিয়েছি সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার।

আমাদের মতো ভাগ্যের সহায়তা কি সব নির্মাতা-প্রযোজক পান? আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালক-প্রযোজক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পাননি। জার্মান-ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় তার পরিচালিত ‘শনিবার বিকেল’ (স্যাটারডে আফটারনুন) কোনও এক অদৃশ্য ইশারায় আটকে আছে। ২০১৯ সালে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সমালোচক পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছে ছবিটি। এছাড়া মিউনিখ, সিডনিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে। প্রথম প্রদর্শনী শেষে সেন্সর বোর্ডে থাকা চলচ্চিত্রের মানুষজন ছবিটির ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেন্সর বোর্ড আবারও প্রদর্শনী করে ছবিটির সার্টিফিকেট দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

আইন অনুযায়ী বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে আপিল বোর্ডের দ্বারস্থ হয় ‘শনিবার বিকেল’ ছবির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। আপিলের শুনানিতে নির্মাতার পক্ষ থেকে অংশ নেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ। শুনানিতে আপিল কমিটি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। তবুও দিন যায়, বছর যায়। নির্মাতা-প্রযোজকদের আজও জানানো হয়নি তাদের ছবির কপালে কী আছে। হতাশা থেকে অতীত ইতিহাস তুলে ধরে নির্মাতা ফারুকী রাষ্ট্রের কাছে জানতে চেয়েছেন, তার কণ্ঠ আর কত চেপে ধরার চেষ্টা করবে প্রিয় রাষ্ট্র। বন্ধু-সহকর্মী প্রিয় নির্মাতার এমন অসহায় প্রশ্ন আমাদের ব্যথিত করে, আপ্লুত করে গাঢ় বেদনায়।

সেন্সর আইনে একটা ফাঁক আছে। সেন্সরের জন্য চলচ্চিত্র জমা দিলে ১৫ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্তের বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু আপিল বোর্ডকে কোনও সময় বেঁধে দেয়নি আইন। ত্রুটিপূর্ণ এই আইনের সুযোগ নিয়ে আপিল বোর্ড ‘শনিবার বিকেল’কে অনন্তকাল আটকে রাখতে চায় কিনা আমাদের জানা নেই। তবে এই আটকে রাখার উদ্দেশ্য যে সৎ নয়, তা স্পষ্ট। আপিল খারিজ করলে গেজেট নোটিফিকেশন করে কোনও একটি চলচ্চিত্রকে নিষিদ্ধ করতে হয়। এক্ষেত্রে নির্মাতার জন্য আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। আইনের আশ্রয় নেওয়ার সাংবিধানিক অধিকার থেকে পরিচালক-প্রযোজকদের বঞ্চিত করতেই আপিল বোর্ড বছরের পর বছর ধরে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে– এমন অভিযোগ উঠতেই পারে। তাই যদি হয় এটা অন্যায়-অবিচার ছাড়া আমরা আর কীইবা বলতে পারি। ইরানের আদলে বাংলাদেশের মতো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকের সঙ্গে এমন আচরণ কাম্য নয়। অথচ প্রায়ই এমন ঘটনার মুখামুখি হচ্ছেন চলচ্চিত্র নির্মাতারা। একটা অস্বস্তিকর থমথমে সময়ে ভয়ের সমাজে সবাই সয়ে যাচ্ছেন ঠিকই, তবে চোখের জল ফেলছেন নীরবে।

গত বছর বিএফআই লন্ডন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকার সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তোমাদের দেশে সিনেমা বানানো রীতিমতো যুদ্ধ। কোনোভাবে বানাতে পারলেও তোমরা নাকি দেখাতে পারো না সেন্সরশিপের কারণে।’ অনুমান করছিলাম, তিনি কোনদিকে আলাপ ঘুরাতে চান। আমি এড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশে বলি, ‘এমন কিছু না আসলে।’ এবার তার প্রশ্ন, ‘তাহলে ফারুকীর ছবি আটকে আছে কেন?’ তিনি এটাও জানালেন– ছবিটা তিনি মিউনিখে দেখেছেন এবং এতে দেশের ভাবমূর্তি ধ্বংসের কোনও উপাদান তিনি পাননি। আমি যেহেতু ‘শনিবার বিকেল’ দেখিনি, তাই চুপচাপ ভাবছিলাম বিখ্যাত সংবাদপত্র দি হলিউড রিপোর্টারের রিভিউতে লেখা দুটি লাইন– ‘সিনেমাটি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ইমেজ ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কায়। ছবিটি দেখে মনে হয়েছে সিনেমাটি বাংলাদেশের ইমেজ বাড়াবে, কমাবে না।’ আমি ওই সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। এভাবে আমাদের দেশে সিনেমা নিষিদ্ধ হয় বলেই তো প্রকৃত অর্থে দেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এ ধরনের ঘটনা বিশ্ববাসীকে আমাদের গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে ভিন্ন বার্তা দেয়– এই সহজ কথাটি আমাদের নীতিনির্ধারকরা কবে অনুধাবন করবেন?

আগেও লিখেছি, ‘শনিবার বিকেল’ অনেক দেশে প্রদর্শিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের দর্শকরা ছবিটিকে শুধু একটি ফিকশন হিসেবে উপভোগ করেছে, ডকুমেন্টারি নয়। গুলশানের হলি আর্টিজানের ঘটনার সঙ্গে ছবির মিল থাকলেও পৃথিবী জানে– এই মর্মান্তিক ঘটনায় বাংলাদেশ কেবলই ভুক্তভোগী। বিগত বছরগুলোতে উন্নত অনেক দেশ অসংখ্য সন্ত্রাসী হামলায় আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্তের প্রতি সভ্য সমাজ ও দেশের সহানুভূতি আছে। আক্রান্তের ভাবমূর্তি নষ্টের কী কারণ থাকতে পারে, বুঝি না। প্রকৃত অর্থে সিনেমা কি সত্যিই আটকে রাখা যায় এই যুগে, যখন সিনেমা হল কার্যত আকাশে?

তাই তো ফারুকী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘একটা ছবি ভাবা হয়ে গেলে তো সেটা দুনিয়াতে এগজিস্ট করে গেলো। বানানো হলে তো আরও শক্তভাবে এগজিস্ট করলো। আজ হোক কাল হোক সেটা তো দেখে ফেলবে মানুষ। তাই বলি কী– এমন কিছু একটা করো যাতে ভাবনাটাও বন্ধ করে দেওয়া যায়! এমন ওষুধ আবিষ্কার করো হে রাষ্ট্র, যাতে কারও মনে ক্ষোভ জন্ম না নেয়! কারণ সম্মিলিত ক্ষোভের চেয়ে বিধ্বংসী কোনও অস্ত্র নাই! আরও খেয়াল রাখতে হবে ক্রমাগত চাপে এই ক্ষোভ যেন ঘৃণায় রূপ না নেয়। কারণ কে না জানে ঘৃণার চেয়ে বড় কোনও মারণাস্ত্র নাই।’ আমিও তার এই বক্তব্য হৃদয়ে ধারণ করি।

লেখক: চলচ্চিত্র প্রযোজক-নির্মাতা


/এসএএস/জেএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অননুমোদিত স্টিকারে ৩৬৩ গাড়িতে মামলা
অননুমোদিত স্টিকারে ৩৬৩ গাড়িতে মামলা
অজানা তথ্য সামনে আনলেন পরিণীতি
অজানা তথ্য সামনে আনলেন পরিণীতি
আ. লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সভা সোমবার
আ. লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সভা সোমবার
লেবু খেলে মিলবে এই ৫ উপকারিতা
লেবু খেলে মিলবে এই ৫ উপকারিতা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ