X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিনেমায় কাঁটাতারের বেড়া এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

রেজানুর রহমান
২৯ আগস্ট ২০২২, ২৩:০৪আপডেট : ২৯ আগস্ট ২০২২, ২৩:০৮

সিনেমায় গল্পের স্বাধীনতা চাই– এই দাবিতে ঢাকায় অতি সম্প্রতি একটি সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমার দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে এমন প্রতিবাদী সাংবাদিক সম্মেলন আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। শৈল্পিক উপায়ে কী দুর্দান্ত প্রতিবাদ। কাঁটাতারের বেড়ার ভেতর বসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন দেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা। দাবি একটাই– গল্পের স্বাধীনতা চাই। একটা কথা প্রচলিত আছে– সহজ কথা যায় না বলা সহজে। আবার এটাও সত্য কঠিন কথাও সহজভাবে বলা যায়। হৈচৈ স্লোগান না তুলেও কঠিন কথা সহজ ভাবেও বলার পথ আছে। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে নির্মাতা, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ব্যানারে অনুষ্ঠিত এই সাংবাদিক সম্মেলন।

‘গল্প বলার স্বাধীনতা চাই’– অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত দাবি। একথা সত্য, যুগ পাল্টে গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে তথ্য নিজেই সাহসী হয়ে উঠেছে। আপনি কোনও তথ্য গোপন করতে চাইলেও পারবেন না। তথ্য নিজেই নিজেকে প্রকাশ করবে। এমন বাস্তবতায় সিনেমায় গল্প বলার স্বাধীনতা না থাকলে যুগের চাহিদা অনুযায়ী আমাদের সিনেমা সামনের দিকে এগুবে না। অবশ্য একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার, আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের সিনেমার আধুনিক উন্নয়ন চাই কিনা। আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলচ্চিত্রের উন্নয়নে অত্যন্ত আন্তরিক। তবুও কেন আমাদের চলচ্চিত্র প্রকৃত অর্থে বিকাশের পথ খুঁজে পাচ্ছে না– এই প্রশ্নের উত্তর করে কাছে খুঁজবো? 

বর্তমান সময়ে সিনেমা নির্মাণে কারিগরী দক্ষতার পাশাপাশি ‘কনটেন্ট’ বেশ জরুরি হয়ে পড়েছে। এই কনটেন্টই হলো মূলত গল্প বলার স্বাধীনতা। ২০/২৫ বছর আগের প্রেম আর পারিবারিক জীবনের গল্প এখন আর সামাজিক বাস্তবতার অংশ নয়। প্রেমের ধরন বদলেছে, পারিবারিক জীবনধারা বদলেছে। জীবনের গল্পে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জীবনের এমন কোনও গোপন কথা নাই যা আলোচিত হয় না। সেই সময়ে সিনেমায় গল্প বলার স্বাধীনতা খুঁজছি আমরা। আন্দোলন করতে হচ্ছে নির্মাতা ও অভিনয় শিল্পীদের। ঢাকায় রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ভিন্নধারার ওই সাংবাদিক সম্মেলন দৃষ্টি কেড়েছে সবার। যদিও এই সাংবাদিক সম্মেলনে এফডিসি কেন্দ্রীক সিনেমা পরিচালক, অভিনয় শিল্পীদের উপস্থিতি ছিল না। এ ব্যাপারে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি সোহানুর রহমান সোহানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেছেন, ‘এমন একটা সাংবাদিক সম্মেলনে হবে এব্যাপারে আমাদেরকে তো কেউ কোনও কিছু বলেননি। সত্যি কথা বলতে কী যারা ওই সাংবাদিক সম্মেলন আহবান করেছিলেন তারা তো মূল ধারার পরিচালক, শিল্পীদেরকে পরিচালক অথবা শিল্পীই মনে করেন না। ওদের কাছে আমরা যেন কিছুই না’। তবে এ ব্যাপারে বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেছেন, ‘আমরা যারা ইনডিপেডেন্ট ফিল্ম নিয়ে কাজ করছি মূলত তারাই এই সাংবাদিক সম্মেলনে আহবান করেছিলাম। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে আমরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এফডিসি কেন্দ্রীয় নির্মাতা, কলাকুশলীদের ব্যাপারে আমাদের কোনও বিদ্বেষ নাই। আগামীতে প্রয়োজনে সবাইকে সাথে নিয়েই আমরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করবো।  

সিনেমায় ‘গল্প বলার স্বাধীনতা চাই’ হঠাৎ কেন এই দাবি উঠলো? তার মানে কি বর্তমান সিনেমায় সময়ের কঠোর বিধি নিষেধ চলছে? সত্যি সত্যি কি কাঁটাতারের বেড়ায় বন্দী সিনেমা নির্মাতারা? তাহলে তো সিনেমার পুরো পরিবার এক সাথে আন্দোলনে নামার কথা। রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে যারা সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন তারা মূলত টেলিভিশন নাটক থেকে উঠে আসা পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রী। সেজন্যই কি এফডিসি ঘরানার কোনও পরিচালক, অভিনয় শিল্পী তাদের সঙ্গে ছিলেন না? এমন কিছু প্রশ্ন বাতাসে ঘুরছে।

মেজবাউর রহমান সুমনের বহুল আলোচিত সিনেমা ‘হাওয়া’য় একটি পাখিকে খাঁচায় বন্দ্বি রাখা ও পরে তাকে রান্না করে খাওয়ার দৃশ্য দেখোনো হয়েছে। এনিয়ে সুমনের বিরুদ্ধে আদালতে ২০ কোটি টাকার মামলা হয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক খ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সিনেমা ‘শনিবার বিকেল’ সাড়ে তিন বছর ধরে সেন্সর বোর্ডের আপিল বিভাগে পড়ে আছে। ‘হাওয়া’র পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা এবং ‘শনিবার বিকেল’ কেন ছাড়পত্র পাচ্ছে না মূলত এই দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই ওই সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এফডিসি কেন্দ্রীক নির্মাতা, পরিচালক ও অভিনয় শিল্পীদের ওই সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিতি না থাকায় প্রশ্ন উঠেছে ‘হাওয়া’ ও ‘শনিবার বিকেল’ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা অথবা সমস্যা কি সমগ্র চলচ্চিত্রের সমস্যা নয়? তাহলে কেন এফডিসি কেন্দ্রীক চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অভিনয় শিল্পীরা ওই সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না অথবা কেন তাদেরকে ডাকা হলো না?

মেজবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। এটা সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করবেন চলচ্চিত্র বিমুখ সময়ে ‘হাওয়া’ সত্যিকার অর্থে একটা প্রশান্তির ‘হাওয়া’ এনে দিয়েছে আমাদের সিনেমায়। দল বেঁধে সিনেমা হলের দিকে সাধারণ দর্শক অতীত দিনের মতোই ছুটতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে একই সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পরাণ’ এর কথাও বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার মতো।

সত্যিকার বলতে কী, হাওয়া আর পরাণ আমাদের স্থবির সিনেমা অঙ্গনকে হঠাৎ করেই জাগিয়ে তুলেছে। ছবি দুটোকে কেন্দ্র করে আমাদের সিনেমার ক্ষেত্রে নতুন করে আসার সঞ্চার হয়েছে। ঠিক সেই মুহূর্তে হাওয়ার পরিচালকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়েরের ঘটনা একটু যেন দ্বিধা দ্বন্দ্বে ফেলেছে সবাইকে। বিষয়টি যেহেতু আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে কাজেই এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না। আদালতের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলছি সিনেমার গল্পে হাত পা বাধা থাকলে বর্তমান সময়ের সিনেমা সত্যিকার অর্থে সামনে এগুতে পারবে না।

এবার আসি মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নতুন সিনেমা ‘শনিবার বিকেল’ প্রসঙ্গে। ছবিটি সেন্সর পেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ছবিটিকে আপিল বোর্ডে পাঠানো হয়। সেই থেকে প্রায় সাড়ে তিন বছর আপিল বোর্ডেই পড়ে আছে শনিবার বিকেল। পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছেন, কেন, কোন কারণে শনিবার বিকেল আপিল বোর্ডে আটকে আছে আমি সঠিক জানি না। সাড়ে ৩ বছর ধরে আমি অপেক্ষা করছি। কিন্তু আমার অপেক্ষার শেষ কোথায় জানি না।

হলি আর্টিজানের সেই নৃশংস ঘটনার ছায়া অবলম্বনে ‘শনিবার বিকেল’ নির্মিত হয়েছে। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম বলেছেন, ‘শনিবার বিকেল’ দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। দুর্দান্ত একটা সিনেমা শনিবার বিকেল। কেন আটকে রাখা হয়েছে আমি তার কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। অভিনেত্রী জয়া আহসান বললেন, হলি আর্টিজানের ঘটনা কি আমরা অস্বীকার করতে পারবো? প্রতি বছর এই নারকীয় ঘটনার ওপর দেশের পত্র-পত্রিকা প্রচার মাধ্যমে খবর প্রকাশ ও প্রচার হয়। সেখানে একটি সিনেমায় ঘটনাটি উঠে আসতে বাঁধা কোথায়? ছবিটিকে এতদিন আটকে রাখারই বা কারণ কী?

শনিবার বিকেল একটি সিনেমা। সাড়ে তিন বছর ধরে সেন্সর বোর্ডে আটকে আছে। অথচ এ ব্যাপারে চলচ্চিত্রের বৃহৎ পরিবারের মধ্যে এনিয়ে কোনও উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নাই। রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সাংবাদিক সম্মেলনে ‘শনিবার বিকেল’ নিয়েও কথা হয়েছে। এফডিসি কেন্দ্রীক সিনেমা নির্মাতাদের কেউই এই সাংবাদিক সম্মেলনে ছিলেন না। এনিয়ে নানান প্রশ্ন উঠেছে। অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, টিভি মিডিয়ায় কাজ করতে করতে যারা সিনেমার জগতে দুর্দান্ত চমক দেখাচ্ছেন তাদের সাথে এফডিসি ঘরানার নির্মাতাদের একটা প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্ব আছে। আবার একই অভিযোগ আছে টেলিভিশন মাধ্যম থেকে উঠে আসা সিনেমা পরিচালকদের বিরুদ্ধেও। তারাও নাকি এফডিসি ঘরানার পরিচালক ও শিল্পীদের তেমন একটা গুরুত্ব দেন না। যদিও এই অভিযোগ কোনও পক্ষই স্বীকার করতে নারাজ।

তবে অভিযোগটি একেবারেই ফেলে দেওয়ার মতো নয়। ‘হাওয়া’ এবং ‘শনিবার বিকেল’ যদি ভালো সিনেমা হয় তাহলে তো সিনেমা পরিবারের সকল সদস্যের  উচিত ভালো সিনেমার পক্ষে দাঁড়ানো। একটা কথা মনে রাখা দরকার, বিভাজন কোনও শিল্পের উন্নতি আনে না। বরং ধ্বংস ডেকে আনে। কাজেই বিভাজন নয় ভালো সিনেমার প্রয়োজনে বৃহত্তর ঐক্যই জরুরি। বাংলা সিনেমার জয় হোক।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উত্তাল চুয়েটে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা, শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ
উত্তাল চুয়েটে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা, শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
‘বিএনপি যে কোনও উপায়ে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে’
‘বিএনপি যে কোনও উপায়ে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে’
ফেসবুকে নিজের সমালোচনা দেখে হাসি পায় সাকিবের
ফেসবুকে নিজের সমালোচনা দেখে হাসি পায় সাকিবের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ