X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তর কোরিয়া কি ঐক্য চায় নাকি যুদ্ধ?

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
০৫ নভেম্বর ২০২২, ১৮:১৪আপডেট : ০৫ নভেম্বর ২০২২, ১৮:১৪

এশিয়া মহাদেশের দুটি রাষ্ট্র উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতি সর্বদা আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের নজর থাকে। এর মধ্যে উত্তর কোরিয়া তার একগুঁয়েমি ও বিশ্বনেতাদের উপেক্ষা করার জন্য বিশেষ পরিচিত। দক্ষিণ কোরিয়া তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য। সাম্প্রতিক উত্তর কোরিয়ার অনিয়ন্ত্রিত সামরিক উসকানিকে কেন্দ্র করে কোরিয়া উপদ্বীপ আবারও সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে।

উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তে যুদ্ধ বিমানের মহড়া দিচ্ছে। প্রতি উত্তরে দক্ষিণ কোরিয়াও তার সামরিক তৎপরতা বাড়িয়েছে। সীমান্তে যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে। ওই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোরিয়া উপদ্ধীপ কি আবারও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে কিনা ওই প্রশ্ন সামনে আসছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোরিয়া উপদ্বীপ বিভক্ত হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া নামে দুটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সমাজতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়া ও পুঁজিবাদী দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে রাজনীতির পাশাপাশি মতাদর্শগত পার্থক্য রয়েছে। ফলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিচালিত দক্ষিণ কোরিয়ায় বার বার ক্ষমতার পালা বদল ঘটলেও উত্তর কোরিয়া ছিল ব্যতিক্রম। দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর হতে এই পর্যন্ত মাত্র তিনজন ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন। এখন ক্ষমতায় আছেন, কিম জং উন। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর বিশ্ববাসী আশা করেছিল নতুন নেতার অধীনে উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করবে।

কোরিয়া উপদ্বীপ জার্মানির পথ অনুসরণ করে ঐক্যবদ্ধ হবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং কিম জং উনের শাসনামলে দুই কোরিয়ার দূরুত্ব বাড়ছে। সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনা তার বড় প্রমাণ।

ঐক্যবদ্ধ কোরিয়া উপদ্বীপ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা বড় বাধা বলে অনেকে মনে করেন। তাদের মতে উত্তর কোরিয়া যেখানে সমাজতন্ত্রের অনুসারী সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ায় পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত। ওই মতাদর্শগত পার্থক্য প্রধানত দেশ দুটির মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূল অন্তরায়। ওই মতের অনুসারীদের কথা কিছুটা সত্য। তবে পুরোপুরি সঠিক এমন ধরে নেওয়ার কারণ নেই। কারণ পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তবে এই ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হবে দুই দেশের নেতাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছা শক্তি। দুই দেশের নেতাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কতটুকু ইচ্ছা আছে তার ওপর পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে।

এছাড়া দুই দেশের মাথার ওপর যে ‘বড় ভাই’ রাষ্ট্রগুলো বসে আছে তারা আদৌ ঐক্য চায় কিনা সেই বিষয়টিও ভেবে দেখতে হবে। উত্তর কোরিয়াকে সমর্থনকারী চীন-রাশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থনকারী যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়ায় কতটুকু সহযোগিতা করবে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। দুই কোরিয়ার মধ্যে বিভাজন সুপার পাওয়ার খ্যাত সবপক্ষই লাভবান হচ্ছে। ফলে তারা কতটা দুই কোরিয়ার ঐক্য চায় তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

উত্তর কোরিয়ার মিত্র গোষ্ঠী বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার ওপরও ঐক্য প্রক্রিয়ার গতিপ্রকৃতি অনেকটা নির্ভর করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের  মতো চীন ও রাশিয়ার দুই কোরিয়ার ঐক্যে আন্তরিক হলে কোরিয়া উপদ্বীপের রাজনৈতিক বিভেদের সীমারেখা অচিরেই মুছে ফেলা সম্ভব। চীন ও রাশিয়া যদি মনে করে দুই কোরিয়া ঐক্যবদ্ধ হলে ওই অঞ্চলে তাদের আঞ্চলিক স্বার্থ অক্ষুন্ন থাকবে তাহলেই কেবলমাত্র তারা ঐক্য প্রক্রিয়ার বাস্তব রূপায়ন চাইবে। বর্তমান দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রভাব থাকলেও পুরো কোরিয়া উপদ্বীপের ওপর তাদের কোনও প্রভাব নেই। উত্তর অঞ্চলে রয়েছে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া আর চীনের প্রভাব। অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে চীন ও রাশিয়া চাইবে না দুই কোরিয়া ঐক্যবদ্ধ হোক। কারণ কোরিয়া উপদ্বীপ ঐক্যবদ্ধ হলে তা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ে চলে যাবে। জার্মানি এক্ষেত্রে বড় প্রমাণ।

বার্লিন দেয়ালের পতনের পর জার্মানিতে রাশিয়ার প্রভাব ধীরে ধীরে কমতে থাকে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বেড়ে যায়। এখন জার্মানি ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র। কোরিয়া উপদ্বীপের এক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ঐক্যবদ্ধ হলে কোরিয়া উপদ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বাড়বে। ফলে চীন-রাশিয়া কখনও চাইবে না কোরিয়া উপদ্বীপের পুরো অঞ্চলের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হোক। তারা প্রথমে নিশ্চিত হতে চাইবে যে কোরিয়া উপদ্বীপ ঐক্যবদ্ধ হলে পুরো অঞ্চলের ওপর তাদের প্রভাব কতটা থাকবে। ওই কারণে বৃহৎ শক্তিবর্গের তথা চীন রাশিয়ার সহায়তায় কখনই কোরিয়া উপদ্বীপের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বরং উভয় রাষ্ট্র কোরিয়া উপদ্ধীপের সংঘাতকে জিইয়ে রাখলে তা তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষা করবে।

তবে ওই বৃহৎ শক্তি বলয়ের বাইরে গিয়েও দুই কোরিয়ার ঐক্য সম্ভব। যদি দুই কোরিয়ার নেতারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে যে, তারা যে কোনও প্রক্রিয়াতে হোক না কেন ঐক্যবদ্ধ কোরিয়া উপদ্বীপ প্রতিষ্ঠা করবে। এই ক্ষেত্রে কোরিয়ান নেতাদের পাশাপাশি জনগণকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। জনগণকেই প্রথম দুই কোরিয়ান নেতাদের চাপ প্রয়োগ করতে হবে যে তারা আর দুই কোরিয়ার মধ্যে বিভাজন চায় না। বরং তারা ঐক্যবদ্ধ কোরিয়া উপদ্বীপ দেখতে চায়। জনগণের প্রবল ইচ্ছা এবং উত্তর ও দক্ষিণের নেতাদের আন্তরিকতা ছাড়া কোনোভাবেই কোরিয়া উপদ্বীপের ঐক্য সম্ভব নয়।

অবশ্যই সাম্প্রতিক সময়ে দুই কোরিয়ার মধ্যে সম্পর্কের সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করে বলা যায় দুই কোরিয়ার ঐক্যবদ্ধ হওয়া এখনও স্বপ্নের পর্যায়ে আছে। বরং কোরিয়া উপদ্বীপের আকাশে এখন কালো মেঘ ঘুরাফেরা করছে। দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধের প্রবল সম্ভবনা দেখা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, চীন রাশিয়া ব্লকের সংকেত পেলে উত্তর কোরিয়ার অস্থির নেতা কিম জং উন কোরিয়া উপদ্বীপে যুদ্ধের সাইরেন বাজাবেন। ওই যুদ্ধে উত্তর কোরিয়া শুধু দক্ষিণ কোরিয়া নয়,  জাপানকেও যুদ্ধে টানতে চাইবে। সাম্প্রতিক জাপানের ওপর দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ তার অন্যতম প্রমাণ।

ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ব নানা সংকটে জর্জরিত। নতুন আর এক ফ্রন্টে যুদ্ধ শুরু হলে খাদ্য সংকটসহ নানা বিপর্যয় আরও বাড়বে। তাই বিশ্ব নেতারদের উচিত উত্তর কোরিয়ার কোনও ফাঁদে পা না দেওয়া। যতক্ষণ সম্ভব কোরিয়া উপদ্বীপকে শান্ত রাখতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। রাশিয়া ও চীন এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তারা উত্তর কোরিয়ার লাগাম টেনে ধরলে কোরিয়া উপদ্বীপে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হবে।

লেখক:  সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected] 

 

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চার কর্মকর্তা নিহত
যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চার কর্মকর্তা নিহত
ঢাকা কর কমিশনারের কার্যালয়ে চাকরির সুযোগ
ঢাকা কর কমিশনারের কার্যালয়ে চাকরির সুযোগ
গরমে মরে যাচ্ছে শাকসবজি গাছ, উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা চাষিদের
গরমে মরে যাচ্ছে শাকসবজি গাছ, উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা চাষিদের
টিভিতে আজকের খেলা (৩০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (৩০ এপ্রিল, ২০২৪)
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ