X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কেন ‘সর্বনাশ’ হলো আমাদের ক্রিকেটের?

সাইদুর রহমান শামীম
১১ নভেম্বর ২০২২, ১৭:১০আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০২২, ১৮:২৯

বাংলাদেশের ক্রীড়া দলের আন্তর্জাতিক কোনও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ শেষে দেশে ফেরার পর, তাদের প্রশংসা করে লেখার সুযোগ গত ২৭ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে বলতে গেলে একেবারেই পাইনি।  এই না পাওয়ার আক্ষেপ আছে অনেক বন্ধু-সহকর্মীর। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট ফেরত লাল-সবুজের জাতীয় ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, এমনকি কাবাডি দলের খেলোয়াড়-কর্মকর্তা ভাইয়েরা তাদের প্রশংসা করে লেখার সুযোগ দেননি। অভিমান আরও আছে। অধিকাংশ সময়ে সাফ গেমসের মতো আঞ্চলিক কিংবা বিশ্বকাপের মতো বৈশ্বিক আসর যখন প্রাথমিক রাউন্ডের গা-ঝাড়া শেষে চূড়ান্ত রাউন্ডে পৌঁছে, তখনই আমাদের জাতীয় দল রণেভঙ্গ দিয়ে ঘরে ফেরে।

অস্ট্রেলিয়ায় চলমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেটেও ঘটেছে একই ঘটনা। কাপ নিয়ে উত্তেজনার পারদ যখন তুঙ্গে ততদিনে  টাইগার-ভক্তরা হতাশায় টিভির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে অপেক্ষায় আছেন ফুটবল বিশ্বকাপের। এভাবেই চলছে, হয়তো চলতেই থাকবে। তবে ঐতিহ্য বজায় রেখে আমাদের ক্রিকেট দল প্রতিশ্রুতি-আশ্বাসের বাণী শুনিয়েই যাচ্ছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল আসরে এবার দুটি ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ।

২০০৭’এ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর ১৫ বছর পর সেই কৃতিত্ব ম্লান করে দুটি জয় জিম্বাবুয়ে ও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে থাকা ‘আইসিসি-বেবিস’ এই দুই দলের সঙ্গে জয় পরিসংখ্যানের  হিসাবে হয়তো সেরা। তবে ক্রিকেটীয় স্কিলের বিচারে কতটা তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই। পারফরম্যান্সের বিচারে নয়, দেশের মানুষের তুমুল আগ্রহ ও বাজার বিপণনের কথা মাথায় রেখে ২২ বছর আগে বাংলাদেশকে টেস্ট স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে, এই কথা ২০০০ সালেই বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল খোদ আইসিসি। আশা ছিল– এই জনপ্রিয়তা ও দর্শকদের ভালোবাসা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ দল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করবে। সেই আশা কি পূরণ হয়েছে!

বাংলাদেশ দলকে ২০১৫ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ, ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি এবং ২০১৯’র ওয়ানডে বিশ্বকাপে খুব কাছ থেকে দেখেছি। সেই দেখা থেকে বলতে পারি, শুরুর কয়েক বছরের জড়তা বাদ দিলে ২০১১-১২ থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘লাল-সবুজ’ সম্ভাবনাময় ক্রিকেট শক্তি হিসেবে নিজের পায়ের নিচে শক্ত মাটি পায়।  ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ও ২০১৭’র চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেই উন্নতির গাণিতিক অনুবাদ ছিল কোয়ার্টার ফাইনাল ও  সেমিফাইনালের টিকিট পাওয়া।  মাশরাফির নেতৃত্বে দলে গড়ে ওঠে একটি ‘কোর-গ্রুপ’, ভক্তদের কাছে যার আদুরে নাম ‘পঞ্চপাণ্ডব’।

সেই ‘পঞ্চপাণ্ডব’ দ্যুতি ছড়ানোর আগেই অস্তাচলে গেছে। সম্ভাবনা জাগানো ‘পঞ্চপাণ্ডবদের’ পঞ্চত্ব প্রাপ্তির দায় বিসিবির। পরিস্থিতি সামলানোর তাদের অদক্ষতায় টাইগারদের শক্তির উৎস ক্ষমতা হারিয়েছে। নাসির, মোস্তাফিজ, সাব্বির, মুমিনুলের মতো আগামীতে হালধরার যোগ্যরা নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন। পরীক্ষিত এবং সম্ভাবনাময় পারফরমারদের কাউকে মনোযোগচ্যুত করা, দল নিয়ে অপ্রয়োজনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, কাউকে মানসিক চাপে রাখা, কাউকে জামাই আদর আবার কাউকে কাউকে খেলার পাশাপাশি রাজনীতির মাঠে নামতে উৎসাহিত করার দায় কি বিসিবি’র কর্মকর্তারা এড়াতে পারেন? এভাবে মনোযোগ ও অনুকূল পরিবেশ হারানো টাইগারদের অধোগতি ২০১৯’এর  ওয়ানডে বিশ্বকাপে স্পষ্ট হয়।  এরপর থেকে শুধুই নিচের দিকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে  ছুটে চলা, ঊর্ধ্বমুখিতা আর নেই। ২০১৫ আর ২০১৭’র সঙ্গে আজকের দলটির তুলনা করলে বিনা দ্বিধায় বলা যায়, সম্ভাবনাময় উঠতি একটি দল কীভাবে সব পক্ষের অবহেলা, আনাড়িপনা এবং অযোগ্যতায়  ছন্নছাড়া দলে পরিণত হয়, তার উদাহরণ  এ সময়ের বাংলাদেশ দল। তিন ফরমেটেই সমান বিবর্ণ টাইগাররা। এই পেছনে হাঁটার দায় অবশ্য একা কর্মকর্তাদের নয়। ক্রিকেটার, মিডিয়া, দর্শক-ভক্ত এমনকি সোশাল মিডিয়ার বাসিন্দারাও নিজেদের অজ্ঞতায় ক্ষেত্রবিশেষে অতিরিক্ত ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে প্রিয় দলের সর্বনাশ করেছেন।

বিসিবি এবং ক্রিকেট সংগঠকদের দিয়েই শুরু করি। এটা বাস্তবতা, বাংলাদেশের  ক্রিকেট দুটি পর্বে বিভক্ত। ‘প্রাক- টেস্ট যুগ’ এবং ‘টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তি পরবর্তী সময়’। প্রাক-টেস্ট যুগে এ দেশের ক্রিকেট চর্চা ছিল সৌখিনতার ঘেরাটোপে বন্দি। যা কিছু হতো তাতে পেশাদারিত্বের চেয়ে  হৃদয়ের টান ছিল বেশি। একদল সংগঠক নিজেদের আবেগ, ভালোবাসা দিয়ে ক্রিকেটারদের বড় আসরের জন্য তৈরি করেছেন, আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়নে নিজেদের সর্বোচ্চ মেধা, দূরদর্শিতা, বিনিয়োগ করেছেন। ক্রিকেটারদের পাশাপাশি সংগঠকদের এই নিবেদন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রশংসা পেয়েছে।

সৈয়দ আশরাফুল হক, সাবের হোসেন চৌধুরী, আ.হ.ম. মোস্তফা কামাল, রইস উদ্দিন আহমেদ, তানভীর মাজহার তান্না, আমিনুল হক মনি’রা নিজেদের কৃতিত্বেই আন্তর্জাতিক মানের সংগঠক হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করেছেন, এগিয়ে নিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। প্রাক টেস্ট যুগ মানে, সে সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট ছিল স্কুলের উচ্চশ্রেণির শিক্ষার্থী। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর বাংলাদেশের ক্রিকেট রাতারাতি পৌঁছে গেলো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা তারচেয়ে উঁচু স্তরে।

অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা, ভারত, পাকিস্তানের দলগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে স্পষ্ট হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রশাসনের দুর্বলতা। ক্রিকেটাররা কেউ কেউ হয়তো এই স্তরের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট সংগঠকরা ‘স্কুল শিক্ষার্থী’র স্তর থেকে  দক্ষতা, যোগ্যতায় রাতারাতি নিজেদের বিশ্বমানের যোগ্য সংগঠক হিসেবে প্রমাণ করতে পারেননি।

দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে এসময়ে অধিকাংশ সংগঠকেরই নেই তৃণমূল বা ক্লাব স্তরে কাজ করার অভিজ্ঞতা। আর্থিক ও রাজনৈতিক, সামাজিক প্রভাবে যোগ্য সংগঠকদের সরিয়ে কোটি টাকায় কাউন্সিলরশিপ কিনে বিত্তবানরা বসেছেন ক্রিকেট বোর্ডের উচ্চ পদে। এই ক্ষমতাপ্রাপ্তি তাদের কাছে সামাজিক আভিজাত্যের প্রতীক। মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার, সরকারের উচ্চ মহলের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি, জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে বড় দলের টিকিট, এসবই সহজ প্রাপ্য হয়ে যায় দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর সংস্থার গদিতে বসার সুযোগ পেলে।

এই মৌসুমি সংগঠকরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের উচ্চমানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংগঠক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি, জাতীয় দলকেও কার্যকর সহায়তা দিতে ব্যর্থ। বিসিবি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কূটনীতিতে কতটা পিছিয়ে তার উদাহরণ হলো– যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের কোনও আম্পায়ার এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের একটি ম্যাচও পরিচালনা করার সুযোগ পায়নি। অথচ জিম্বাবুয়ের মতো বাণিজ্যিক সম্ভাবনা ও পারফরম্যান্সে পিছিয়ে থাকা একটি দেশের হয়েও ল্যাংটন রুজেরি পরপর দুদিন আম্পায়ারের দায়িত্ব পান এবং দুদিন দুটো ভুল করেও শাস্তি এড়াতে পেরেছেন।

অন্যদিকে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচে ‘ফেক থ্রো’, পাকিস্তান ম্যাচে সাকিবের আউট ইস্যুতে শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি বিসিবি। দল পরিচালনার ক্ষেত্রেও সংগঠকরা ছিলেন ঘোর অনিশ্চয়তায়। একটি বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট খেলতে যাওয়ার আগে বর্তমান টুর্নামেন্টকে উহ্য রেখে বিশ্বকাপের পরবর্তী আসরকে লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা চরম বালখিল্যতা।

ক্রিকেটাররা মাঠে নামার আগেই তাদের ঠারেঠোরে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এবারের টুর্নামেন্টে ভালো করা অতটা জরুরি নয়, পরেরটা হলেই চলবে।’ এমন অতিকথন বাংলাদেশ দলকে সবচেয়ে বেশি  ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মাঠে টাইগারদের লক্ষ্যহীন পারফরম্যান্স তারই প্রমাণ। এই আসরে বাংলাদেশ ছাড়াও নামিবিয়া, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস মতো ‘মিনোস’ অংশ নিয়েছে, যারা অভিজ্ঞতা স্কিলে লাল-সবুজের ক্রিকেটারদের ধারে-কাছে আসার যোগ্য নয়। তাদের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বিশ্বকাপ নিয়ে লক্ষ্যের কথা হরদম শোনা যায়নি বলে দলগুলো নির্ভার খেলে বড়দের হারিয়ে চমক দেখিয়েছে।  প্রস্তুতি, সম্ভাবনা, শক্তিমত্তা মিলিয়ে এবারের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ আসরে  ‘আউট-সাইডার’ হিসেবে বাংলাদেশ শুরু করে।

টুর্নামেন্ট যেভাবে এগিয়েছে, বৃষ্টি-আইন, পরবর্তী সমীকরণ, ফেভারিটদের পয়েন্ট হারানো, ছোট দলগুলোর চমক সব মিলিয়ে একপর্যায়ে বাংলাদেশের সামনে সেমিফাইনাল এমনকি ফাইনাল খেলার সুযোগ এসেছিল। লক্ষ্য নিয়ে বিভ্রান্তিতে থাকা ক্রিকেটাররা ‘শিক্ষা-সফরের’ মানসিকতায় পড়ে পাওয়া সুযোগটাও কাজে লাগাতে পারেনি। ক্রিকেটারদের সঙ্গে বোঝাপড়া এবং আন্তসম্পর্ক স্থাপনে সফলতা আনতে পারেনি বিসিবি।

অন্যান্য দেশের তারকা ক্রিকেটাররা ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট ছেড়ে বিশ্বকাপ প্রস্তুতিতে জাতীয় ক্যাম্পে যোগ দিয়েছেন। বিপরীত আচরণে বিদেশি লিগকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় দলের ক্যাম্পকে উপেক্ষা করেছেন দেশসেরা তারকা। ট্রফির ফটোশেসন,  বিশ্বকাপ মিশনে দেশ ছাড়ার আগে অফিসিয়াল ফটোসেশন প্রেসব্রিফিংয়ে অধিনায়কের অনুপস্থিতি, শুধু বাংলাদেশ দলের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে। এর দায় শুধু অধিনায়ক, ক্রিকেটারদের নয়, কাউকে কাউকে আশকারা দেওয়ার দায় পরিচালক, প্রশাসকের। কোনও কোনও ক্রিকেটারকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেওয়া  অন্যান্য ক্রিকেটারদের মনে বৈষম্যের অভিযোগ তৈরি করেছে। ফলে দলের সামগ্রিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে বারবার। এর দায় অবশ্যই নীতিনির্ধারকদের। শৃঙ্খলার ব্যতিক্রম ও ‘কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্টের’ ঘটনা তো ভূরি ভূরি। নীতিনির্ধারক হয়ে নীতি প্রণয়নে জড়িত থাকা কেউ কেউ টিম ম্যানেজমেন্টের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে বোর্ডের কাছ থেকে পারিতোষিক নিচ্ছেন, এমন ঘটনা নষ্ট করেছে ক্রিকেটের সার্বিক পরিবেশকে।

১৫/১৬ ক্রিকেটারের জাতীয় দলে হেড কোচ, ব্যাটিং কোচ পেস এবং স্পিন বোলিং কোচ, টেকনিক্যাল কনসালটেন্ট, ফিল্ডিং কোচ মিলিয়ে ৬/৭ জন কোচিং স্টাফের ডাগ আউটে অবস্থান নেওয়া কোনও কাজে আসেনি। বরং পারস্পরিক মতবিরোধের কথাই চাউর হয়েছে। কোচিং ক্যারিয়ার আর বোর্ড পরিচালকসহ একাধিক পদ একই ব্যক্তির ধরে রাখার অভিযোগ তো বেশ পুরনো।  ঘরোয়া লিগে ক্লাবের কোচই বহাল থেকেছেন জাতীয় দলের কোচিং প্যানেলে। দল নির্বাচন নিয়ে ক্রমাগত  সব মহলের অভিযোগ এই কারণেই। কোচিংয়ে উচ্চতর ডিগ্রি থাকলে যথাযথ নিয়ম মেনে কোচিং ক্যারিয়ারেই থাকা উচিত, বিসিবির নীতিনির্ধারণী পদ ধরে রাখা কেন? একাধিক লাভজনক পদে একই নীতিনির্ধারকের দিনের পর দিন বহাল থাকার কুফল দেখছে এ দেশের ক্রিকেট।

প্রশাসনে এমন হ-য-ব-র-ল অবস্থার সুযোগ নিয়ে কোনও কোনও ক্রিকেটার ক্রমাগত শৃঙ্খলা ভেঙেছেন। গুরুত্বপূর্ণ সিরিজে বিশ্রামের নামে দলকে সার্ভিস থেকে বঞ্চিত করা, দলের নিয়মিত অনুশীলনকে অবজ্ঞা করে বিজ্ঞাপন, শুটিংয়ে অংশগ্রহণ, এমনকি রাজনৈতিক, সামাজিক প্রচারণামূলক অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া ক্রিকেটারের পকেট ভারী করেছে। দেশের ক্রিকেটকেও করেছে ক্ষতিগ্রস্ত।

এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দক্ষতা বিসিবি’র সংগঠকদের ছিল না। তারা কেবল আশ্বাসবাণী শোনাচ্ছেন, আগামীর ‘মুলো’ ঝুলাচ্ছেন। ‘আইসিসির তিন মোড়লের অবিচার’, ‘বাজে আম্পায়ারিং’র দোহাই দিয়ে নিজেদের অযোগ্যতাকে আড়াল করেছেন। বিপর্যয়ের পর কখনও নির্বাচক, বিদেশি কোচ কিংবা কোনও কোনও ক্রিকেটারের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে নিজেদের গদির আয়ু বাড়িয়েছেন। দায় আছে মিডিয়ার এবং দর্শকদেরও। পত্রিকার সার্কুলেশন, অনলাইনে হিট, শেয়ার বাড়াতে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ক্রিকেটারদের এমন গুণকীর্তন করেছেন, যাতে বিভ্রান্ত হয়েছে পুরো দেশ।

ফেসবুকের অতি উগ্র জাতীয়তাবাদী ক্রিকেট-ভক্তরা প্রিয় দল, প্রিয় ক্রিকেটারকে অন্ধ সমর্থন করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করেছেন আরও। তারকা ক্রিকেটারদের বিভিন্ন ফ্যান গ্রুপের ফেসবুকে তৎপরতা ভুলিয়ে দেয় ক্রিকেট খেলার আলাদা মর্যাদা দুনিয়াজোড়া। স্বজাতি ক্রীড়া সাংবাদিকদের একাংশ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় নিজের পছন্দের ক্রিকেটারকে দৃষ্টিকটুভাবে প্রমোট, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর ঘটনা ঘটিয়েছেন আকসার। মিডিয়ার অকৃপণ ফোলানো ফাঁপানো প্রশংসা, পকেটে হঠাৎ অর্জিত বেশুমার টাকা, সামাজিক পরিচিতি, প্রতিপত্তি মিডিয়ার হাইপ সবকিছু মিলিয়ে সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা তরুণ ক্রিকেটারদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে।

গত কয়েক বছরে জাতীয় দলের বেশ ক’জন ক্রিকেটারের অসংলগ্ন কাজের ফিরিস্তি, আইন-আদালতের বারান্দায় ঘোরাঘুরি প্রমাণ করে আমরা আমাদের তরুণ প্রতিভাদের সঠিক পরিচর্যা করতে পারিনি। ২০২০ সালের আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জেতা দলের আকবর আলি, হৃদয়, রাকিবুল হাসান, তানজিদ তামিমদের এতদিনেও জাতীয় দলে খেলার যোগ্য না হওয়ার কারণ আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা।

সারা পৃথিবী তরুণ ক্রীড়াবিদদের সঠিক পরিচর্যা করে বিশ্বমানের তারকায় পরিণত করে।

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন কেন ব্যর্থ?

এই দুরবস্থা থেকে উত্তরণ সহজ এবং স্রেফ সময়ের অপেক্ষা বলে  ভাবছেন যারা, তাদের চিন্তায় গলদ আছে। দেশের সামাজিক, আর্থিক অবস্থা, মূল্যবোধের অভাব, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্রীড়াঙ্গনকে রাজনীতিকরণ জনিত  অরাজকতার প্রতিফলন দেখি দেশের ক্রীড়াঙ্গনে , ক্রিকেটাঙ্গনে। অন্যান্য ক্ষেত্রে অনিয়ম, অরাজকতা দূর না হলে ক্রিকেটাঙ্গনেও সুস্থ ও আদর্শ পরিবেশ ফিরবে না। কখনও দু’একটা বিক্ষিপ্ত সাফল্য আসবে। কিন্তু টেকসই হবে না সেই সাফল্য। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অগ্রগতির ইতিহাস তাই বলে।

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, চ্যানেল আই।

 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ