X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

কিছু কথা না বললেই নয়

রেজানুর রহমান
২১ নভেম্বর ২০২২, ১৭:৫২আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০২২, ১৭:৫২

কিছু কথা না বললেই নয়। একটি নাটকের দৃশ্য। দূরসম্পর্কের এক খালার বাসায় এসেছে একজন তরুণ চিকিৎসক। খালাই তাকে ডেকেছেন। খালাকে মনে হলো একটা ব্যাপারে বেশ অস্থির হয়ে আছেন। ভাগ্নেকে কাছে পেয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে ভারতের একজন তারকার নাম উল্লেখ করে জানতে চাইলেন– তুমি কি তাকে চেন? তরুণ চিকিৎসক যারপরনাই অবাক। খালা যার নাম বলেছেন তাকে সে চিনে না। তাই সরল মনে খালার কাছে জানতে চাইলো– আপনি কার কথা বলছেন? তিনি কে? কোনও নামকরা চিকিৎসক, বিজ্ঞানী নাকি... খালা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন ভাগ্নেকে। রূপচর্চা করবেন বলে ভারতের ওই তারকা অর্থাৎ কাম বিউটিশিয়ানের খোঁজ-খবর জানতে ভাগ্নেকে ডেকেছেন। কিন্তু ভাগ্নে যে এসবের কিছুই জানে না। খালা ভর্ৎসনা করলেন ভাগ্নেকে- তুমি কীসের ডাক্তার বাপু! তুমি তো দেখি কিছুই জানো না।

একটি টিভি নাটকের এই ভিডিও ক্লিপটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে দাপটের সঙ্গে। নানা জনে নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন। একজন লিখেছেন, টিভি নাটকে এইটা কী ধরনের সংলাপরে ভাই। পাশের দেশের একজন তারকার ব্যাপারে না জানাটি কি আদৌ কোনও অন্যায়, নাকি অযোগ্যতা? তাকে আমি ছোট করে দেখছি না। তিনি নিজের জায়গায় শ্রেষ্ঠ। শ্রদ্ধার পাত্র। তাই বলে কেউ তার নাম না জানলে না চিনলে ক্ষতিটা কোথায় সেটাই বড় প্রশ্ন।

একজন উপস্থাপিকাকে নিয়ে সারা দেশে বেশ তোলপাড় চলছে। আমি এর আগে তার নাম শুনিনি। তার কোনও অনুষ্ঠানও দেখিনি। এটা হয়তো আমার অযোগ্যতা। আমাকেই বা ক’জন মানুষ চেনে? কথা সেটা নয়, কথা হলো শিষ্টাচার, বিনয়, শ্রদ্ধাবোধ স্নেহাশীষ প্রদানের ক্ষেত্রে আমরা কে কতটা উদার? সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে দেশের বরেণ্য অভিনেতা, নির্মাতা মীর সাব্বিরের সঙ্গে পায়েল নামের ওই তরুণী উপস্থাপিকার কথোপকথনের সূত্র ধরে শিষ্টাচারবহির্ভূত বাহাসে আক্রান্ত দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন। ওই অনুষ্ঠানে মীর সাব্বির ও পায়েলের মধ্যে কী ঘটেছে তা প্রায় সবাই ইতোমধ্যে জেনে গেছেন। কারণ, খারাপ খবর বাতাসের আগে ছোটে। একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন ‘ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ’ এটাই সত্য। এটাই গুরুত্বপূর্ণ। একজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছে। পাশের ফ্ল্যাটে মিষ্টি পাঠানোর পরও তাকে কেউ শুভেচ্ছা জানাতে আসে না। মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে একদিন এই ছেলের খোঁজে পুলিশ আসে। কেউ একজন তাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসিয়েছে। কিন্তু এ কথা কেউই বিশ্বাস করতে চাইলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার গৌরব ভুলে গেলো সবাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রটি এখন সবার বিবেচনায় একটি বাজে ছেলে...।

সে রকমই একটি বাজে ঘটনা ঘটে গেছে মীর সাব্বিরের ক্ষেত্রে। সাব্বিরের চরম শত্রুও তার অভিনয়ের প্রশংসা করে। অথচ সেই মীর সাব্বিরের বিরুদ্ধে একজন তরুণী উপস্থাপক রীতিমতো আটঘাট বেঁধে নেমেছেন। এই সুযোগে মীরজাফরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে তৃতীয় পক্ষ। পায়েলকে অনেকেই উসকে দিচ্ছে– তুমি প্রতিবাদ করো। ধুয়ে দাও মীর সাব্বিরকে। বোধকরি সে কারণে পায়েলও কিছুটা দুর্বিনীত। ক্ষমা চাইতে বলেছেন মীর সাব্বিরকে। এই ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারেই আমার একটু আপত্তি আছে। কে কার কাছে ক্ষমা চাইবে? কেন চাইবে? ধরা যাক, মীর সাব্বির পায়েলের কাছে ক্ষমা চাইলেন, তাতে পায়েলের কী এমন লাভ হবে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এজন্য তার কি ফ্যান-ফলোয়ার বাড়বে? সেজন্যই কি তিনি একজন সিনিয়র সহকর্মীকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলছেন? এটা এক ধরনের ধৃষ্টতা। ব্যাপারটা অন্যভাবে সমাধান করা যেতো।

আমি সেই অনুষ্ঠানের ভিডিও ক্লিপটা কয়েকবার দেখেছি। পায়েল কেন মীর সাব্বিরের বিরুদ্ধে এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ অভিযোগ করেছেন তা বোঝার চেষ্টা করেছি। শোবিজের যেকোনও আনন্দমুখর অনুষ্ঠানে প্রায়শই এমন কৌতুকপূর্ণ দৃশ্যের অবতারণা হয়। প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী ফকির আলমগীরের কণ্ঠ হুবহু নকল করতে পারেন অভিনেতা সাজু খাদেম। তারকাদের একটি ঝলমলে অনুষ্ঠানে তিনি প্রকাশ্যে ফকির আলমগীরকে নিয়ে কথা বলেছেন। ফকির আলমগীর এ ব্যাপারে কখনও কোনও অভিযোগ তোলেননি।

মীর সাব্বিরের কথা বলার ভঙ্গি অনুষ্ঠান চলাকালে পায়েল বিষয়টা খারাপভাবে নিয়েছেন বলে মনে হয়নি। তা না হলে তিনি এভাবে হাসি দিয়ে বিষয়টি নিতেন না। আমার ধারণা, আসল ঘটনা ঘটেছে অনুষ্ঠানের পর। তৃতীয় কোনও পক্ষ পায়েলের কান ভারী করেছে। ‘তোকে তো চরম অপমান করেছে মীর সাব্বির। উদলা বলে তোকে উলঙ্গ করেছে। তুই প্রতিবাদ কর।’ ব্যস, কানকথায় প্রতিবাদ করতে নামলেন পায়েল। এতে হয়তো তার ফ্যান-ফলোয়ার বেড়েছে। কিন্তু পায়েল কি আদৌ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার সম্পর্কে মন্তব্যগুলো দেখেছেন, পড়েছেন? পায়েল কি জয়ী হয়েছেন বলে মনে করেন? তবে হ্যাঁ, মীর সাব্বির ও পায়েলের ঘটনার পর আমাদের বোধকরি একটু সচেতন হওয়া উচিত। কোনও অনুষ্ঠানে হুট করে কোনও কথা বলা ঠিক হবে না।

কয়েক দিন আগে ঢাকায় এসেছিলেন পাশের দেশের একজন জনপ্রিয় তারকা নোরা ফাতেহী। তার বাংলাদেশে আসা নিয়ে বেশ ঝামেলা হলো। অবশেষে বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিন্তু যে জন্য এসেছিলেন সেটা করতে পারেননি। অর্থাৎ নাচতে এসেছিলেন। তার নাচ দেখার জন্য জনপ্রতি ১০ হাজার টাকার টিকিট কিনেও অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু নোরা ফাতেহীর নাচ দেখতে না পেরে তারা হতাশ। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে তাদের কারও বক্তব্য শুনে সত্যি কথা বলতে কী আমি অবাক হচ্ছি। একজন নারী দর্শক দুঃখ করে বললেন, আমরা ১০ হাজার দামের টিকিট কিনেছিলাম। অথচ নোরার একটি নাচও দেখার সুযোগ হলো না। কর্তৃপক্ষ আমাদের প্রতি দারুণ অন্যায় করেছেন। এর বিচার হওয়া উচিত। সম্মানিত ওই দর্শক তার পরিবারের আরও দুজন সদস্যকে নিয়ে অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিলেন। তার মানে নোরার অনুষ্ঠান দেখার জন্য তাদের ৩০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। ভাবুন তো একবার, দেশে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি পাওয়া এই কঠিন সময়ে বিদেশি তারকার নাচ দেখার জন্য একটি পরিবারের ৩০ হাজার টাকা খরচ করার যুক্তি কী? তাদের টাকা আছে বলেই খরচ করবেন?

মাগুরার একদল তরুণ বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রিয় দলের ৭ মাইল দীর্ঘ একটি পতাকা বানিয়েছে। এজন্য খরচ হয়েছে ৩০ লাখ টাকার ওপরে। টাকার অঙ্কটা যদি সত্য হয় তাহলে তো বেশ শঙ্কার বিষয়। দেশের এই কঠিন সময়ে এত টাকা খরচ করে ভিন দেশের পতাকা বানানোর যুক্তি কী?

কথার পিঠে অনেক জরুরি কথা জমা হয়ে গেছে। আদালত থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই দুর্ধর্ষ জঙ্গিকে ছাড়িয়ে নিয়েছে তার সাঙ্গপাঙ্গরা। কী সর্বনাশা কথা। আদালতে নেওয়ার পথে দুর্ধর্ষ জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো তার সহযাত্রীরা। সারা দেশে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। যেন চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, সেই আলোচিত প্রবচনের বাস্তব উদাহরণ। জঙ্গি পালিয়ে গেলো। তারপর দেশে রেড অ্যালার্ট জারি হলো। আগে কেন প্রয়োজনীয় সতর্কতা পালন করা হলো না? এই উত্তর কার কাছে খুঁজবো?

লেখাটি শেষ করি। চিনির দাম বেশ ভাবাচ্ছে। মনে হয় এই তো সেদিন চিনির কেজি ছিল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। এখন প্রতি কেজি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। সয়াবিন তেলের দামও বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। শোনা যাচ্ছে বিদ্যুতের দাম নাকি আবারও বাড়ানো হবে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের অধিকাংশ মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা। মাছ, মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে অনেকে। যদি তাই হয় তাহলে তো আমিষের ঘাটতিতে পড়বে তারা। শরীরের সুস্থতার জন্য আমিষ জাতীয় খাদ্য খুবই জরুরি। দেশ উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে এ কথা সত্য। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবন-মান নেমে যাচ্ছে দ্রুত। এটা বড়ই ভাবনার কথা। বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেওয়ার এখনই সময়। অন্যথায় দেশের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক-আনন্দ আলো

 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ