X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বুদ্ধিজীবী সংস্কৃতির পুনরাগমন হবে কি?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১৩:৪৬আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১৩:৪৬

বাংলাদেশে নানা সময়ে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে, বুদ্ধিজীবীরা কোথায়? অর্থাৎ সমাজে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা খোঁজে মানুষ, কিন্তু সমাজব্যবস্থা নিজে সেটা কতটা বুঝতে পারে, সেটা অজানা।

আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগীরা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। কেবল এই তারিখে নয়, ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকে বিজয়ের আগমুহূর্ত পর্যন্ত তারা এই হত্যাযজ্ঞ চালায়। এর আগে মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা মুহূর্তেও ঘাতক বাহিনী অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে।

অনাদিকাল থেকে নানা দেশে, নানা প্রান্তরে, ইতিহাসের নানা বাঁকে বুদ্ধিজীবীরা বরাবর শিকার হয়েছেন শাসকদের ক্ষমতার বীভৎসতার। ১৯৭১ সালে এই মাটিতেও তাই ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী যখন বুঝতে পারে যে তাদের পরাজয় অনিবার্য, তখন তারা তালিকা করে বাঙালির বরেণ্য সন্তানদের হত্যার পরিকল্পনা করে, লেলিয়ে দেয় আলবদর-আলশামস নামের ঘাতক বাহিনীকে। পরাজয়ের আগমুহূর্তে তারা চূড়ান্ত আঘাত হানে স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার অভিপ্রায়ে। পাকিস্তানি দুঃশাসনের সময় লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা বিবেকের কণ্ঠস্বর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তারা সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। নিজেদের জ্ঞান-মনীষা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জাতিকে পথ দেখিয়েছেন, আলোকিত করেছেন। আর এসব কারণেই তাঁরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের জিঘাংসার শিকার হয়েছেন।

একটা প্রশ্ন এখন প্রতিবছরই উঠে আসে– শহীদ বুদ্ধিজীবীরা যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন সে বাংলাদেশ কি আমরা পেয়েছি? সোজা উত্তর– না, পাইনি। কেন পাইনি, কোন রাজনীতির কারণে পাইনি, সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। শুধু এটুকু বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে কম বেশি জলাঞ্জলি দিয়েছে সব দল, এখনও দিয়ে চলেছে এবং ১৯৭১-এ যারা শহীদ হয়েছেন সে মানের বুদ্ধিজীবী আর আসেননি এদেশে।

একটা শূন্যতা আছে এখন। বলতে গেলে কোনও নাগরিক সমাজের অস্তিত্বই নেই। অনেকে বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে মাঝে মাঝে বিবৃতি দেন বটে, টেলিভিশনে এসে কথা বলেন, তবে এসবের কোনও বড় কোনও প্রভাব সমাজে হয় না। বুদ্ধিজীবী বা নাগরিক সমাজ তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের অধঃপতনের কারণ রাজনীতি। সব পেশাজীবী আজ রাজনৈতিক লাইনে বিভাজিত। বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশও আজ যেন থমকে গেছে। ফলে বুদ্ধিজীবী নামে যারাই কথা বলছেন তাকে মানুষ দেখছে খণ্ডিতভাবে।

বুদ্ধিজীবী বলতে আমরা বুঝি শিল্পী, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার, গবেষক, বরেণ্য সাংবাদিক, নাট্যব্যক্তিত্ব, অভিনেতা প্রমুখ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই শ্রেণির মানুষের রাস্তায় নামার ঘটনা বারবার ঘটেছে, বিশেষ করে পাকিস্তানি শোষণ আর জুলুমের বিরুদ্ধে, স্বাধীন দেশে সামরিক স্বৈরাচারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে শুধু বিবৃতি নয়, আমরা শিক্ষক সমাজ, লেখক সমাজ, সাংবাদিক সমাজ, চলচ্চিত্রকার ও শিল্পী সমাজ এবং একেবারে নির্মোহ জীবন-যাপন করা গবেষক সমাজের মিছিলও দেখেছি। নিশ্চয়ই সেসব মিছিলে রাজনীতি ছিল, কিন্তু কোনও রাজনৈতিক রং থাকতো না। বরং আমরা দেখলাম স্বৈরাচারকে হটিয়ে গণতন্ত্রে ফেরার পর সমাজকে বেশি বিভাজিত করা হয়েছে এবং বুদ্ধিজীবিতায়ও রং লেগেছে। এখন আর বুদ্ধিজীবীরা রাস্তায় নামেন না। তারা রাজানীতির অনুগ্রহ লাভে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছেন।

সবাইকে এক পাল্লায় ফেলা যাবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো একটি সুশাসিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে উদ্যোগী ও উদ্যোমী বুদ্ধিজীবীর বড় অভাব এখন। গণতন্ত্র বিরোধী আচরণ, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, সহিংসতা, কালাকানুন সহ অনেক কিছু দেখেও নীরব আছেন আমাদের বুদ্ধিজীবীরা। তবে এমন মনে করার কারণ নেই যে, তাঁরা সব কিছুতেই চোখ বুজে আছেন বা সমর্থন করছেন। তাঁরা চুপ করে আছেন মূলত একটাই কারণে, তা হলো এসব সমাজ বিরোধী শক্তির সঙ্গে লড়াই করার যে রাজনীতি দেশে থাকা দরকার সেটি নেই।

বাঙালি বুদ্ধিজীবী সংস্কৃতির পুনরাগমন প্রয়োজন। ধর্মীয় বিদ্বেষ আর রাজনৈতিক-বিদ্বেষকে দূরে ঠেলতে পারলেই সেটা সম্ভব। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ কোটি কোটি কালো টাকা, করপোরেট দখলবাজদের সঙ্গে ওঠাবসা, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আর পাঁচতারা হোটেলে বসে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার নেশা ছাড়তে পারলে একটা জায়গা তৈরি হতে পারতো হয়তো।  

রাজনীতি ছাড়া জীবন নেই। জীবনের পরতে পরতে, ব্যক্তিগত, পারিবারিক থেকে সামাজিক, কর্মক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় সব স্তরেই তা জড়িয়ে আছে। সোজা কথায়, জীবনের প্রতিটি স্তরেই আছে ক্ষমতার অস্তিত্ব ও তা প্রয়োগের সংগঠন এবং কৃৎকৌশল এবং সেটাই রাজনীতি। কিন্তু দলীয় রাজনীতির ভেতর দিয়েই যখন আমাদের দিনানিপাত, তখন দলই হয়ে ওঠে এক নতুন ব্যবস্থা। তখন নির্যাতিত বা নিপীড়িত মানুষের রাজনৈতিক পরিচয় দেখে প্রতিক্রিয়া বের হয় আমাদের নাগরিক সমাজের। যোগাযোগ প্রযুক্তির মহাবিপ্লবে সেটা আরও শাণিত হয়েছে। কে কাকে কোন দলে ফেলে ট্রল করছে বা করবে সে এক আতংক যা বিভাজনকে আরও স্পষ্ট করে তুলছে।

নাগরিক জনপরিসরের এই ক্রমব্যাপ্তির ঝলক দেখা গেছে  মিশর-সহ আরব দুনিয়ার নানা দেশে- আরব বসন্ত নামে। আমাদের শাহবাগেও দেখেছি মানুষের নতুন জাগরণ। কিন্তু সেটাও ধরে রাখা যায়নি। জনপরিসরের এই বিপুল ব্যাপ্তি ও শক্তির যুগেও কেন আমাদের নাগরিক সমাজ তার নিজের শক্তিকে চিনতে পারছে না, সে জিজ্ঞাসা হোক আজকের দিনে। দলীয় বিভাজনে কেন সে নিজেকে জড়িয়ে সে নিজের ক্ষয় করছে, এই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সেটাই হোক আসল ভাবনা।

লেখক: সাংবাদিক  

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ