X
বুধবার, ১৫ মে ২০২৪
৩১ বৈশাখ ১৪৩১

মেসির মহাকাব্যিক রূপকথা

জনি হক
১৯ ডিসেম্বর ২০২২, ২০:০২আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০২২, ২০:৪৩

লিওনেল মেসির বিশ্বকাপ গল্পের চূড়ান্ত অধ্যায়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থ্রিলারে ঠাসা। যে গল্পের পরতে পরতে নাটকীয়তা। সবশেষে জয় আর্জেন্টিনা মহানায়কের। তার মহাকাব্যিক রূপকথার সফল সমাপ্তি হলো। ফুটবল জাদুকরের নাগালের বাইরে থেকে যাওয়া আরাধ্য বিশ্বকাপ ট্রফি অবশেষে ধরা দিলো। তামাম দুনিয়ার স্পটলাইটে এখন তিনিই।

বাংলাদেশের আর্জেন্টিনা সমর্থকদের দীর্ঘদিনের আশা পূরণ হয়েছে। মেসি সোনালি ট্রফি স্পর্শ করলেন আর টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার কলিজা যেন ঠান্ডা হয়ে গেলো! আর্জেন্টিনার জয়কে ছাপিয়ে তার স্বপ্নপূরণই যেন সবার কাছে প্রশান্তির। ফুটবলকে যিনি নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়েছেন, তার ক্যারিয়ারে দাঁড়ি পড়বে কিনা বিশ্বকাপহীন! নিয়তি কি এত নিষ্ঠুর হতে পারে? নিশ্চয়ই না! ঈশ্বরও চেয়েছেন বলেই ১৫ ইঞ্চির সোনালি ট্রফিটা অনেক বাধা পেরিয়ে জয় করেছেন মেসি। রক্তের কিংবা দূরসম্পর্কের আত্মীয় না হওয়ার পরও তার এই সাফল্যের জন্য বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে কেউ মোনাজাত ধরেছেন, কেউ বা উপাসনালয়ে মুক্তহস্তে দান করেছেন। কয়েকজন দিনমজুর রিকশাচালক ভাড়া ছাড়াই যাত্রীসেবা দিয়েছেন। অনেকে নিজেদের বাড়ি পুরোটাই আকাশি-সাদায় রাঙিয়েছেন। তরুণরা পকেট খরচ বাঁচিয়ে জার্সি আর পতাকা কিনে একাত্ম হয়েছেন। ফুটবলের আবেগ বরাবরই অন্যরকম। তবে মেসির জন্য বাংলাদেশে এবার যা কিছু হয়েছে তাতে বিস্মিত গোটা আর্জেন্টিনা। সেজন্য ঢাকায় দূতাবাস খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটি। একজন মেসিকে কেন্দ্র করেই এই উন্মাদনা ও অফুরান ভালোবাসা। ম্যারাডোনার পর তিনিই দেশে দেশে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আর্জেন্টিনার সমর্থক সংখ্যা বাড়িয়ে তুলতে পেরেছেন।

ইংরেজি জি.ও.এ.টি অক্ষর চারটি হলো ‘গ্রেটেস্ট অব অল টাইম’ (সর্বকালের সেরা) কথার সংক্ষিপ্ত রূপ। লিওনেল মেসিকে নিয়ে এই খেতাব অনেকের মুখে উচ্চারিত হয়েছে। ১৭ বছর ধরে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে এবং ক্লাব ফুটবলে তিনি যেসব কীর্তি গড়েছেন, তাতে তাকে এমন ভাবা অস্বাভাবিক নয় মোটেই। যদিও নিন্দুকেরা প্রশ্ন তুলতেন- ডিয়েগো ম্যারাডোনা তো আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন, মেসি কী করেছেন? মেসির অনেক বাহাদুরির কথা বুক ফুলিয়ে বলা গেলেও এই একটি প্রশ্নের বেলায় নিশ্চুপ হয়ে যেতে হয়েছে আর্জেন্টিনা সমর্থকদের। অবশেষে তাদের চাওয়া পূর্ণতা পেয়েছে। বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নপূরণ হয়েছে মেসির। এবার আর নিশ্চয়ই বিতর্ক থাকবে না মেসিই সর্বকালের সেরা। কেউই এখন থেকে আর অস্বীকার করতে পারবে না, পেলে-ম্যারাডোনার কাতারে চলে এসেছেন তিনি।

১৯৮৬ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ জিতে অমর হয়ে গেছেন ম্যারাডোনা। পারস্য উপসাগরের তীরে ৩৬ বছরের অপেক্ষার পর আবারও শিরোপা জিতলো আর্জেন্টিনা। আলবিসেলেস্তেদের দীর্ঘদিনের সেই খরা ঘুচলো। তাছাড়া কুড়ি বছর পর লাতিন আমেরিকায় গেলো এই স্বীকৃতি। ২০০২ সালে এশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ জিতেছিল ব্রাজিল। এরপর থেকে বিশ্বকাপে দেখা গেছে ইউরোপীয় আধিপত্য। ২০০৬ সালে ইতালি, ২০১০ সালে স্পেন, ২০১৪ সালে জার্মানি এবং ২০১৮ সালে ফ্রান্স শিরোপা জেতে। কাতারে লাতিন ফুটবলের নান্দনিকতা উপহার দিয়েছে লিওনের মেসির দল। তার পায়ে যতবারই বল গেছে ততবারই যেন লেখা হচ্ছিল কবিতা! প্রতিটি ম্যাচে পায়ে পায়ে নিপুণ শিল্পীর মতো মাঠে ছবি এঁকেছেন ৩৫ বছর বয়সী এই খেলোয়াড়। কাতার বিশ্বকাপটা মেসির বিশ্বকাপ বললে অতিরঞ্জিত কিছু মনে হবে না। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে কোনও বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব, রাউন্ড অব সিক্সটিন, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল ও ফাইনালে গোল করার কীর্তি গড়েছেন মেসি।

মেসির এমন ম্যাজিক সমর্থকরা বাংলাদেশে রাত জেগে টিভি সেটের বহুবার দেখেছে। ক্লাব ফুটবলে তার অর্জন নিয়ে লিখতে গেলে উপন্যাস হয়ে যেতে পারে! বার্সেলোনার হয়ে ১০টি লা লিগা, ৭টি কোপা দেল রে ও ৪টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং আর্জেন্টিনার জার্সিতে ১টি কোপা আমেরিকা জিতেছেন। রেকর্ড সাতবার ব্যালন ডি’অর শোভা পাচ্ছে ঘরে। লা লিগায় রেকর্ড ৪৭৪টি গোল, লা লিগা ও ইউরোপীয় লিগে এক মৌসুমে সর্বাধিক ৫০টি গোল, লা লিগায় সবচেয়ে বেশি ৩৬টি ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ৮টি হ্যাটট্রিক, লা লিগায় সবচেয়ে বেশি ১৯২টি অ্যাসিস্ট, লা লিগায় এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ২১টি অ্যাসিস্ট, দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবলার হিসেবে সবচেয়ে বেশি ৯৮টি আন্তর্জাতিক গোল, বার্সেলোনার জার্সিতে সবচেয়ে বেশি ৬৭২ গোল এবং ক্লাব ও দেশের হয়ে ৭৫০-এর বেশি গোল তার।

তবু কোথায় যেন ছিল শূন্যতা। অবশেষে সেটি পূর্ণতা পেলো। দোহার লুসাইল স্টেডিয়ামে গতকাল রাতে যা কিছু হয়েছে তা বহুদিন সবার মনে থাকবে। এটাই সর্বকালের সেরা ফাইনাল কিনা তা নিয়ে আলোচনা করা যেতেই পারে। শেষমেশ স্বপ্নপূরণ হলো মেসির।

একটা কাকতালীয় ব্যাপার বলি। ২০০১ সালে প্যারিস সেন্ট-জার্মেইতে (পিএসজি) যোগ দেন ব্রাজিলের রোনালদিনহো। ২০০২ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপ জেতে। ২০১৭ সালে পিএসজি’তে যোগ দেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। ২০১৮ সালে ফ্রান্স শিরোপা জেতে। ২০২১ সালে বার্সেলোনা ছেড়ে পিএসজি’তে আসেন মেসি। তাই কাতার বিশ্বকাপে কৌতূহল ছিল আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ পায় কিনা। পেলোই তো!

আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জেতার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন অদ্ভুত অনেক কিছুই চোখে পড়ছে। মেসির হাতেই যে শিরোপা উঠবে সেটা সাত বছর আগেই ঘোষণা দেওয়া হয়ে গিয়েছিল! হোসে মিগুয়েল পোলাঙ্কো নামের এক পর্যটক ২০১৫ সালের ২১ মার্চ টুইটে লিখেছিলেন, ‘২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর মেসির হাতে বিশ্বকাপ উঠবে এবং তিনি সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় হয়ে যাবেন। সাত বছর পর আমার এই মন্তব্যের প্রমাণ পাবেন।’

হোসে মিগুয়েল পোলাঙ্কোকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে জানতে পারলাম, ২০০৬ সালে লিওনেল মেসির প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচ গ্যালারিতে বসে দেখেছেন এই লোকটি। কাতারে আর্জেন্টিনা অধিনায়কের শিরোপা জয়ের মুহূর্তেরও সাক্ষী হয়েছেন তিনি।

২০০৬ সালের ১৬ জুন সার্বিয়া ও মন্টেনেগ্রোর বিপক্ষে বদলি হিসেবে নেমে বিশ্বকাপে প্রথম গোল পান মেসি। পরেরটির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে পাক্কা আট বছর। ২০১৪ সালের ১৫ জুন বসনিয়া ও হারজেগোভিনার বিপক্ষে গোল করেন তিনি। এরপর ইরান ও নাইজেরিয়ার বিপক্ষে তার পা থেকে এসেছে তিনটি গোল। ২০১৮ সালের ২৬ জুন নাইজেরিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপে নিজের ষষ্ঠ গোল পান তিনি। আগের চার বিশ্বকাপে সব মিলিয়ে ছয় গোল করা মেসি কাতারের মরু প্রান্তর রাঙিয়েছেন আপন মহিমায়। নিজের পঞ্চম বিশ্বকাপে আগের চারবারের মোট সংখ্যাকে ছাড়িয়ে সাত গোল করেছেন তিনি।

কাতারে আরও অনেক রেকর্ড গড়েছেন লিওনেল মেসি। পাঁচটি বিশ্বকাপ খেলা হাতেগোনা ফুটবলারদের মধ্যে তিনি একজন। এক্ষেত্রে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে রেকর্ডটি তার। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ২৬টি ম্যাচ খেলেছেন। অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি (১৯টি) ম্যাচ খেলেছেন। আর্জেন্টিনার হয়ে সবচেয়ে বেশি ১৩টি গোল করার রেকর্ড তার দখলে। বিশ্বকাপে তার অ্যাসিস্ট আছে ম্যারাডোনার সমান ৮টি। একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের পাঁচটি ভিন্ন আসরে অ্যাসিস্ট করেছেন মেসি। নকআউট পর্বে সবচেয়ে বেশি ৬টি অ্যাসিস্টের রেকর্ড পেলে ও মেসির। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ১৭টি জয় পাওয়া জার্মানির মিরোস্লাভ ক্লোসাকে ছুঁয়েছেন তিনি। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ১১টি ম্যাচসেরার পুরস্কার উঠেছে মেসির হাতে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে দুটি গোল্ডেন বল জয়ের রেকর্ড গড়ছেন তিনি।

টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থেকে কাতারে আসা আর্জেন্টিনা নিজেদের প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে হেরে বসে। এরপর থেকেই শুরু হয় সংশয়! মেসি কি বিশ্বকাপহীনই থেকে যাবেন তাহলে? তবে তিনি বিশ্বাস রাখতে বলেছিলেন দলটার ওপর। কারণ, তার নিজের ওপর বিশ্বাস ছিল। যে বিশ্বাসের সিঁড়ি বেয়ে শিরোপার আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছেন আর্জেন্টাইন সুপারস্টার।  

ম্যাজিশিয়ানরাই ম্যাজিক দেখান। মেসিকে ভক্তরা ভালোবেসে ডাকে মেসিশিয়ান। তিনিও জাদু দেখিয়েছেন। মেসিশিয়ানের ম্যাজিক চলবে আরও কিছু দিন। নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে তো গেছেনই। এবার কোথায় থামেন দেখি। আপাতত অভিনন্দন আর্জেন্টিনা। ভামোস!

লেখক: ডেপুটি নিউজ এডিটর, বাংলা ট্রিবিউন


/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পর্দা উঠলো কান উৎসবের, মেরিল স্ট্রিপ ও মেসির ফেরা
কান উৎসব ২০২৪পর্দা উঠলো কান উৎসবের, মেরিল স্ট্রিপ ও মেসির ফেরা
বাংলা ট্রিবিউনের প্রশ্নের জবাবে যা বললেন লিলি
কান উৎসব ২০২৪বাংলা ট্রিবিউনের প্রশ্নের জবাবে যা বললেন লিলি
এমবাপ্পে রিয়ালে খেলবেন, নিশ্চিত করলেন লা লিগা প্রধান
এমবাপ্পে রিয়ালে খেলবেন, নিশ্চিত করলেন লা লিগা প্রধান
লখনউকে হারিয়ে রাজস্থানকে প্লে অফে তুললো দিল্লি
লখনউকে হারিয়ে রাজস্থানকে প্লে অফে তুললো দিল্লি
সর্বশেষসর্বাধিক